শীতের আমেজ শুরু হতেই পৌষল্যা বা বনভোজনের কথা মনে পড়ে এখন যার পোষাকি নাম বা ইংরেজিতে নাম পিকনিক। তখন ক্লাসের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়ে যেত ডিসেম্বর মাসে। নতুন বছরে নতুন ক্লাস শুরু হতো, পড়াশোনার চাপ নেই বললেই চলে, সুতরাং পৌষল্যা নিয়ে গজল্লা বেশ রসিয়ে রসিয়ে চলত। কোথায় পৌষল্যা হবে সেটা নিয়েও তর্ক বিতর্ক বেশ জোরদার হতো এমন কি মতান্তর মনান্তরের পর্যায়েও চলে যেত। কিন্তু একটা কথা মানতেই হবে যে পৌষল্যা বা বনভোজন নিয়ে একটা ভালরকমের উন্মাদনা থাকত।
স্থান নির্বাচনের ভার তিন চারজন ডাকাবুকোদের উপর থাকত যারা নিভৃত জায়গার সঙ্গে সঙ্গে খাওয়ার জলের ব্যবস্থা আছে এই কথাটা মাথায় রাখত। বন্ধু সার্কেল পাড়ার মধ্যে হলে সেরকম কিছু জাঁকজমক থাকত না কিন্তু ক্লাব স্তরে হলে বিভিন্ন পাড়ার ছেলেদের সমন্বয়ে বেশ বড়সড় বনভোজন বা পিকনিক হতো। সুতরাং পৌষল্যা হচ্ছে ছোট স্তরে ( খেলার মধ্যে দুধভাত যেমন) এবং বনভোজন বা পিকনিক হচ্ছে একটু বড় লেভেলে । যে কোন খেলায় কাউকে দুধ ভাতে বলা হতো যে একেবারেই ধর্তব্যের মধ্যে নয় অথচ তাকে বাদ ও দেওয়া যাবেনা।এটা একটা প্রেস্টিজ ইস্যু হয়ে যেত কারণ যাকে দুধভাতে রাখা হতো সে সবসময়ই মনে করত যে সে অন্যদের সমকক্ষ কিন্তু তার বন্ধুদের চোখে বাচ্চা বা আনাড়ি। যাই হোক, পৌষল্যা বা বনভোজন হতো সাধারণতঃ লোকালয়ের বাইরে কোন বড়সড় পুকুর বা বিলের পাড়ে কিংবা কোন বনের মাঝে কালিবাড়ির কাছে একটা বড়সড় গাছের নীচে যেখানে একটা চাদর বা বেডকভার টাঙিয়ে নেওয়া হতো এবং তার নীচে রান্নার ব্যবস্থা করা হতো। খাবার জল কালীবাড়ির টিউব ওয়েল থেকে নেওয়া হতো এবং অন্য সব কিছু বিলের জলে করা হতো। রান্না সেরকম বিশেষ কিছু হতো না-- ভাত, ডাল, আলুভাজা বা বেগুন ভাজা, ফুলকপির তরকারি ও ডিমের ঝোল এবং শেষ পাতে একটু বোঁদে ও রসগোল্লা । মাংস করলে খরচাও বেশী যা বাচ্চাদের পক্ষে বাবা মায়ের কাছে চাওয়া যেতনা এবং কেউ একটু বেশী পেল বা কম পেল তাই নিয়ে মন কষাকষির সম্ভাবনা থাকতো । সুতরাং মাংস বাদ আর কম খরচের মাংস বা চিকেন ছিল ই না তখন। নিজেরাই জায়গা পরিষ্কার করা,মশলা বাঁটা (তখন গুঁড়ো মশলার চল ছিলনা), গর্ত করে উনুন বানানো,চারদিকে গাছগাছড়া থাকায় কাঠের অভাব হতো না এবং রান্নায় নুন কম বা ঝাল বেশী নিয়ে কেউ মাথাই ঘামাতো না। রান্নার বাসনকোসন কোন গরীব লোককে দিয়ে মাজিয়ে নেওয়া হতো কিছু খাবার ও সামান্য পয়সার বিনিময়ে । দুর্দান্ত আনন্দ হতো এই পৌষল্যায়। সাধারণত বাড়িতে আধখানা ডিম খাওয়া হতো কিন্তু এই পৌষল্যায় গোটা ডিম খাওয়া একটা বিরাট ব্যাপার। মোদ্দা কথা, অল্পতেই সন্তুষ্টি কারণ সেই সময় প্রত্যেক বাড়িতেই পাঁচ সাতটা ছেলেমেয়ে নিয়ে কোন পিসি বা কাকা থাকায় প্রায় দশজনের মুখে খাবার জোগানো বড় সহজ ব্যাপার ছিলনা। নিজেরা সমস্ত কাজ করায় আনন্দের মাত্রা ছিল আকাশ ছোঁয়া।
ক্লাব স্তরে যখন পিকনিক হতো তখন আমরা নিতান্ত ছোট হওয়ায় ক্লাবের দাদারাই সব মাথা এবং ব্যবস্থাপনা তাদের ই। সকাল বেলায় স্নান করে ক্লাবে হাজির হওয়া এবং লাইন দিয়ে মাড়োয়ারি বাগানে যাওয়া। ঐ বিশাল বাগানবাড়ির নাম কেন মাড়োয়ারি বাগান হয়েছিল তা জানিনা তবে পঞ্চানন তলা থেকে জঙ্গলের পথে আরও মাইলখানেক গেলে পড়ত সেই ফাটক ওয়ালা বিশাল বাগানবাড়ি। অনেকগুলো বাঁধানো পুকুর , নানা ফুল ফলের গাছে ভরা বিশাল বাগানের মধ্যে এক পোড়ো রাজবাড়ি যার আশে পাশে গেলেই গা ছমছম করতো। ভুটানদার ওপর ভার ছিল আমাদের সামলানো। আমার দেখা একজন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ভদ্রলোক যাঁর হাতের ছড়ি কখন যে কার মাথায় পড়বে একটু বেচাল হলেই , কেউ বলতে পারতনা। আর এইরকম দুর্ধর্ষ বোম্বেটেদের সামলানো ঐ ছড়ি ছাড়া সম্ভব হতো না বলেই মনে হয়। কিন্তু কাজ যে একেবারেই কিছু করতে হতো না তা হয়, নতুন আলুর খোসা বস্তায় ঘসে ওঠাতে হতো। রান্নার ভার রঘুদার ওপর। দুলু দা, বুড়োদা, শক্তি দা, মনা দা, চঞ্চলদা, দোদা দা,মোহন দা, মদন দা, রবি দা, প্রণব দা, কাজল দা, ভুটান দা, পল্টু দা, মিলি দা, ছোকুদা, বীরেনদা ছাড়াও আরও অনেকেই থাকতেন এই পিকনিকে । খাওয়াদাওয়া সারতে সারতে ছোট দিনের বেলা গড়িয়ে যে কখন সন্ধে হয়ে যেত বুঝতেই পারতাম না। সকাল বেলায় পিকনিক স্পটে পৌঁছানোর পর ডিমসেদ্ধ, পাঁউরুটি ও কলা দিয়ে টিফিন খাওয়া হতো। আলুর খোসা ছাড়ানোর পরেই দড়ি ছাড়া গরুর মতো এদিক সেদিক করে কুল বা পেয়ারা পেড়ে খাওয়া হতো। লম্বা লম্বা নারকেল গাছ থেকে নারকেল পাড়া আমাদের কম্মো ছিলনা কিন্তু ব্রজেন দা পুকুর পাড়ে নারকেল গাছে তরতরিয়ে উঠত এবং নারকেল পাড়তো। কোন কোন সময় দুচারটে নারকেল পুকুরের জলেও পড়ে যেত। পুকুরগুলো সব বাঁধানো ছিল মানে যাঁদের বাড়ি ছিল তাঁরা বেশ বড়মাপের জমিদার বা রাজা ছিলেন। অত লোকের রান্না হতে যথেষ্ট সময় লাগত আর এর মধ্যেই মনাদার গল্প ও চুটকি সবার মন ভরিয়ে দিত। এইরকম জমজমাট পিকনিক জীবনেও ভোলার নয় কারণ এখানে ছোট বড়সড় সবাইকেই কিছু দায়িত্ব দেওয়া হতো এবং প্রত্যেকেই সেটা আনন্দের সঙ্গে করতো যেটা এখনকার পিকনিকের থেকে অনেক আলাদা। এখন কাছাকাছি পিকনিক স্পট নেই বললেই চলে। লোকসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য আশপাশের ফাঁকা জায়গাগুলোয় বাড়ি ঘর হয়ে গেছে এবং বড়সড় জায়গা খুঁজতে গেলে যেতে হবে গাড়িতে বা বাসে বা ট্রেনে । লোকসংখ্যা বেশী হলে একটা বাসেও হবেনা, অনেক গাড়ি বা বাসের সংখ্যা বাড়াতে হবে। এ ছাড়া লোকজন বেশী হলে গ্রুপের মধ্যে যে বাঁধন সেটা বহুলাংশেই শিথিল হয়ে যায় । তখন নামেই একটা বড়দলের পিকনিক কিন্তু তা ছোট ছোট অনেক গ্রুপের সমন্বয় । এই গ্রুপের লোকের সঙ্গে ঐ গ্রুপের লোকের বিশেষ সদ্ভাব নেই। সুতরাং জমাটে পিকনিক হবার সম্ভাবনা খুব কম । এ ছাড়া নিজেদের যোগদান, না থাকার ই সামিল। চাঁদা দিয়েই খালাস। কতটা পেলাম প্রতিদানে এই নিয়ে হিসেব কষতে কষতেই আনন্দের দফারফা। এছাড়া রয়েছে ক্যাটারার, তারাই খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারটা দেখে বলে পিকনিকে অংশগ্রহণকারীদের ভূমিকা অত্যন্ত নগণ্য। তবুও এরই মধ্যে দুএকজন বিশেষ ভূমিকা পালন করেন বলে এখনও এর মধ্যেই কিছু আনন্দ পাওয়া যায় । এঁরা যদি কোন কারণে দায়িত্ব না নেন তাহলে পিকনিকটাই হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে। এখন সবকিছুই যেমন নিউক্লিয়ার, গ্রুপটাও সেরকম নিউক্লিয়ার বাঊ আঁটোসাঁটো হওয়া দরকার । এঁরা আছেন বলে আজ ও কিছু আনন্দ পিকনিকে পাওয়া যায়।
আজকের দিনে পিকনিক অবশ্য সারাবছর ধরেই হয় বলে এখানে সেখানে বহু রিসর্ট হয়েছে এবং ঠা ঠা রোদেও এয়ার কণ্ডিশনড ঘরে বসে দিব্যি রমরম করে পিকনিক ও চলছে আর রিসর্টগুলোও চলছে। এখন পৌষল্যা পৌষমাসেই আবদ্ধ নেই, নাম বদলে পিকনিক হয়েছে এবং বার মাস ধরে চলছে।