Thursday, 5 June 2025

পোষ্য

অনেক দূরের পাড়ি, সুতরাং গোটা তিনেক বাস ছেড়ে জানলার ধারে একটা সিট নিয়ে বসে আছি । বাস টার্মিনাসের পাশেই এক অনুষ্ঠান বাড়ি যা সব সময়ই ভর্তি থাকে কারণ বাড়িটার অবস্থান। আগের দিন রাতেই একটা বড়মাপের অনুষ্ঠান  হয়ে গেছে। অনেক বাড়তি উচ্ছিষ্ট খাবার পাশের ভ্যাটে পড়েছে যেখান থেকে ফুটপাতে থাকা কিছু  গরীব মানুষ এবং রাস্তার একদল কুকুর প্রতিযোগিতায় নেমেছে কে কতটা খাবার জোগাড় করতে পারে । মানুষগুলো মাঝে মাঝেই  রাস্তায় পড়ে থাকা ইঁট কুড়িয়ে কুকুরগুলোর দিকে তাক করছে এবং  এরই মধ্যে কুকুরগুলোও কিছু কিছু খাবার নিয়ে  পালাচ্ছে এবং নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি করছে। মানুষ এবং কুকুরের প্রতিযোগীতা দেখতে দেখতেই সময়টা কেটে যাচ্ছে কিন্তু বাস ছাড়তে এখনও বেশ খানিকটা দেরী আছে। হঠাৎই জানলার উল্টোদিকে একটা সুন্দর ল্যাব্রাডর কুকুরের দিকে চোখ পড়ল। কুকুরটা আমার ই মতো সেই খাবার কাড়াকাড়ি দেখছে একদৃষ্টে কিন্তু কোথায়  যেন তার সম্মানে বাধছে সেই প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করতে । দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে খুব খিদে পেয়েছে কিন্তু কিছুতেই সে ঐদিকে যাচ্ছেনা । অথচ গেলেই ওর চেহারা দেখে কি মানুষ বা কি কুকুরের দল ভয়ে পালাবে। কিন্তু সে ভীষণ দ্বিধাগ্রস্ত। একদিকে তার খিদে আর অন্যদিকে তার সম্মান । 
ভাবতে চেষ্টা করলাম  এইরকম সুন্দর একটা কুকুরকে কে ছেড়ে যেতে পারে?  কিছু লোক আছে যারা বাড়িতে দারুণ একটা কুকুর  পুষবে এবং তাদের নাম ও কোন ছেলের বা মেয়ের নামে রাখবে কুকুরের লিঙ্গ অনুসারে। বাইরের  কোনও লোক তাকে কুকুর বললে তারা খুব রাগ করে এবং তাকে তখন নিজের ছেলে বা মেয়ে বলে মনে করে।  ভালবাসা তো সত্যিই ভাল জিনিস । হৃদয়ের কোমল দিক থাকা তো সত্যিই প্রশংসনীয় কিন্তু কুকুরটা যখন বুড়ো হয়ে যাবে বা নিজেরা যখন বদলি হয়ে যাবে অন্যত্র তখন পোষ্যকে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে তাকে তার ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেওয়া এক ভীষণ অমানবিক কাজ। অনেক লোকই আছেন যাঁরা  পোষ্যকে নিজেদের সঙ্গে নিয়ে যান বা তাঁর ঘনিষ্ট কোনও বন্ধুর কাছে জিম্মা করে দিয়ে যান। এতে তাঁদের মনেও একটা শান্তি থাকে এবং পোষ্য ও ভাল থাকে। 
যাই হোক,  কুকুরটার ঐ অবস্থা দেখে এক প্যাকেট বিস্কুট  কিনে দুটো বিস্কুট দূর থেকে  ছুঁড়ে দিলাম কারণ বেশ ভয় লাগছিল  ঐ বড়সড় কুকুরটাকে দেখে। কিন্তু কুকুরটা একবার বিস্কুটের দিকে তাকিয়ে  মুখটা ফিরিয়ে  নিল কারণ খিদে লাগলেও সে অভ্যস্ত নয়  এরকমভাবে খেতে। মনে একটু সাহস সঞ্চয়  করে এগিয়ে গেলাম তার দিকে, বিস্কুটের প্যাকেট থেকে  একটা বের করে ওর মুখে দিলাম , ও আমার দিকে  একবার তাকালো, কি মনে হলো ওর যেন ওর পুরনো মনিব ই ওকে খেতে দিচ্ছে। একদৃষ্টে চেয়ে রইল আমার পানে, লক্ষ্য  করলাম ওর চোখের কোণে একটু জল।সন্দেহ করছে যে আমার মনিবের চেহারাটা কেমন করে এতটা বদলে গেল । অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে আস্তে করে আমার হাত থেকে বিস্কুট সে নিয়ে চিবোতে লাগল। আমিও সাহস পেয়ে প্যাকেট থেকে একটা একটা করে বিস্কুট নিয়ে ওকে খাওয়াতে থাকলাম আর ও ধীরে ধীরে লেজ নাড়াতে নাড়াতে খেতে থাকল। ইতিমধ্যে বাস ছাড়ার সময় হয়ে গেল বুঝতে পারলাম কণ্ডাক্টরের কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে উঠতে দেখে। মাথায় বার বার করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বাসে উঠলাম । জানলা দিয়ে দেখি সে আবার ও তার মনিবকে হারিয়ে ফেলল ভেবে অপলক দৃষ্টিতে অপসৃয়মান বাসের দিকে চেয়ে আছে। মনটা ভীষণ ভারাক্রান্ত হয়ে গেল । ফিরে আসলাম কয়েকদিন পরে এবং  ফিরে এসে খুঁজতে থাকলাম সেই সুন্দর ল্যাব্রাডর কুকুরটাকে কিন্তু কেউ কোন হদিস দিতে পারল না। কোথায় যে উধাও হয়ে গেল কেউ জানেনা ।

Monday, 2 June 2025

শুধু যাওয়া আসা

ব্যস্ত শহরে প্রায় সব পরিবারের চেহারাই মোটামুটি এক। ছিমছাম সংসার স্বামী, স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে ভরপূর। স্বামী এবং  স্ত্রী দুজনের ই বাবা ও মা জীবিত, সুতরাং বাচ্চারা দুই তরফের দাদু, দিদিমা ও ঠাকুর্দা, ঠাকুমার সাহচর্য পায় এবং বাচ্চারা ছুটির সময় আনন্দে  টইটুম্বুর। একই শহরে হলে কিছুদিন এবাড়ি আর কিছুদিন ও বাড়ি আর ভিন্ন শহরে হলে গরমের ছুটি এখানে তো ক্রিসমাসে অন্যখানে। মাঝে মাঝে  দুইপক্ষের দাদু, দিদাদের নিয়ে ছুটি কাটানো। কিন্তু এটা একটা আদর্শ কল্পনায় ভরপূর চিত্র। বেশীরভাগ সময়ই এই ছবি অনুপস্থিত  বিভিন্ন কারণে। যাক ঐসব নিয়ে অন্য কোন সময়‌ আলোচনা করা যাবে।
বড় শহরে স্বামী, স্ত্রী দুজনকেই চাকরি করতে হয় আজকাল  সংসারে  সচ্ছলতা বজায় রাখতে । আগের দিনের মতো একেবারে নিপাট গৃহকর্ত্রী পাওয়া খুবই মুশকিল । তবে একেবারে  যে অমিল তা নয়। হয় স্বামীর বিরাট ব্যবসা কিংবা স্বামী খুবই নামজাদা ডাক্তার বা উকিল,  সেক্ষেত্রে স্ত্রীকে চাকরি নাও করতে হতে পারে তবে সেখানে স্ত্রীরা নানারকম সামাজিক কাজকর্মে ব্যস্ত থাকেন যার নীট ফল বাচ্চারা মানুষ  হচ্ছে কাজের লোক বা একটু গম্ভীর ভাবে বললে বলতে হয় ন্যানির কাছে। যে যেরকম ওজনদার লোক তাদের ন্যানিরাও সেইরকম ই ওজনদার ।
বিভিন্ন ধরণের সংস্থা রয়েছেন যারা  এই কাজের লোক ( আয়া) বা ন্যানি সরবরাহ করে এবং  বহু লোক সাধারণ ভাবে  বা রিটায়ার করার  পরে এই রমরমা ব্যবসার সঙ্গে  যুক্ত । এখানে বিনিয়োগ সাঙ্ঘাতিক কিছু বেশী নয় তবে পরিচিতি এখানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ । যার পরিচিতির ব্যাপ্তি যত বেশী সে তত ভালভাবে  ব্যবসা করবে। আর একবার এই বাজারে ঢুকলে তার ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠতে বাধ্য।  এদের একটা ডেটা বেস তৈরী করতে হয় কারণ বিভিন্ন লোকের চাহিদা বিভিন্ন রকম। শুধু বড় শহর ই নয় সব জায়গায়ই এই ব্যবসা এখন রমরমিয়ে চলছে। ছোট শহরে রোজগারের পরিমাণ কম আর বড় শহরে সরকারী  চাকরির  চেয়ে কোন অংশে কম নয়। তাদের মাসে চারদিন ছুটি, খাওয়া দাওয়া সমেত একমাসের বোনাস। যদি সে অন্য  শহর থেকে  আসা লোক হয়ে তবে তাকে বছরে  এক বার/ দুবার ছুটি এবং  যাতায়াত বাবদ এসিতে বাড়ি যাওয়া আসার খরচ দিতে হবে। মফস্বল বা ছোট শহরে আগে যেমন ঠিকে কাজের লোক থাকত এখনও  তা আছে তবে তারা চারটে পাঁচটা বাড়িতে কাজ করে যে পরিমাণ টাকা রোজগার করে তা সিভিক ভলান্টিয়াররাও পায়না। সিভিক ভলান্টিয়ারদের পনের ঘন্টা ষোল ঘন্টা কাজ করার পর তাদের ঊর্ধতন কর্মচারীদের গালমন্দ ও শুনতে হয় এবং  বিনিময়ে তারা পায় মাত্র নয়  হাজার টাকা। সুতরাং,  তারা সুযোগ  পেলেই যে চুরি করবে তাতে আর আশ্চর্য কি?  যারা আবার একটু চালাক চতুর তারা তাদের ওপরয়ালার হয়ে টাকা সংগ্রহ করে এবং সেখান থেকে  একটা ভাল টাকা ভাগ হিসেবে পেয়ে থাকে। আর ভদ্রবেশী ওপর ওয়ালা  সামনে সুন্দর  মুখোশ পড়ে ঐ সিভিক ভলান্টিয়ারকে পিছনে লেলিয়ে দিয়ে সেখান থেকে  দাঁও মারে। কিন্তু ঠিকে কাজের লোকেরা মোটামুটি  সাত আট ঘন্টা কাজ করে পনের  বিশ হাজার টাকা কামিয়ে নেয় । আসা যাওয়ার জন্য‌ বিনে পয়সার ট্রেন এবং যেসমস্ত বাড়িতে কাজকর্ম করছে সেখানে চা, জলখাবার ও দিনের  খাওয়া হয়ে যায়। এছাড়া সরকারী  অনুদান তো আছেই । বড় শহরে আয়া সেন্টার রা বারঘন্টা বা চব্বিশ ঘন্টার লোক সরবরাহ করে এবং তাদের সাম্মানিক মূল্য একমাসের টাকা। আগে গ্রামের লোক গ্রামের  বাইরে প্রায়‌ আসতো ই না কিন্তু যানবাহনের সুযোগ বৃদ্ধি ঘটায় তাদের কাজের সন্ধানে বেরিয়ে আসতে হচ্ছে এবং প্রত্যেক  মানুষ ই চায় তাদের শ্রী বৃদ্ধি  হোক। চাকুরীরত স্বামী স্ত্রীদের ও লোকজন ছাড়া চলবে না কারণ তাদের বাচ্চা না সামলালে তারা দুজনেই  কাজে বেরোতে পারবেন না আর এই কাজের লোকেরা রোজগার করে তাদের ছেলেমেয়েদের ভাল খাওয়া দাওয়া এবং শিক্ষার  ব্যবস্থা করতে পারছে আর মাঝখানে এই আয়া সেন্টারের পরিচালকরা দুইপক্ষের  যোগাযোগ ঘটিয়ে দিয়ে টাকা রোজগার করছে অনেকটা উবের, ওলা বা এয়ার বি এন বির মতো।
এখন এই বাচ্চাগুলোর কি অবস্থা সেটা একটু দেখা যাক। এই কাজের লোক বা ন্যানিরা কাজ না পোষালে চলে যাচ্ছে এবং  আয়া সরবরাহকারী সংস্থারা অন্য  ন্যানিকে দিচ্ছে এবং  নতুন  ন্যানির সঙ্গে একটু মেলবন্ধন হতে না হতেই পুরনো ন্যানি আবার উপস্থিত কারণ নতুন  জায়গায় ডাল না গলায় তিনি আবার  পুরনো জায়গায়  ফিরে এসেছেন এবং  বাচ্চাটাও পুরনো ন্যানিকে ফিরে পেয়ে স্বাভাবিক  হয়েছে  কিন্তু নতুন ন্যানির দোষ টা কি? কিছুই নয়, কারণ যে কোন লোক  নতুন  জায়গায়  এসে মানিয়ে নিতে কিছুটা সময়ই নেবেই কিন্তু না বাচ্চার মা না বাচ্চাটি সেই সময় দিতে রাজী নয়। অতএব  তাকে চোখের  জল নিয়ে বিদায় নিতে ই হবে যদিও তার সেরকম দোষ হয়তো  নাই। তাকে ছলছলে চোখ নিয়েই বিদায় নিতে হবে কারণ তার  সবচেয়ে  বড় শত্রু সময়।

Thursday, 29 May 2025

তারা রা আজ কোথায় গেল

ছোট বেলায় সূর্য অস্ত যেতে না যেতেই অন্ধকার এসে গ্রাস করত পৃথিবীকে আর নীল আকাশে একটা একটা করে হঠাৎ লক্ষ লক্ষ তারা আকাশটাকে ভরিয়ে দিত তাদের ঝিকিমিকি আলো দিয়ে। কৃষ্ণ পক্ষে চাঁদ যখন ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশে ব্যস্ত তখন পৃথিবীর নিকষ কালো অন্ধকার মহিমাণ্বিত হয়ে উঠত এই ছোট ছোট  তারাদের ঝিকিমিকি আলোতে।  খানিকক্ষণের মধ্যেই গোটা আকাশ জুড়ে তারাদের ভিড়, একদৃষ্টে চেয়ে দেখতাম সপ্তর্ষি মণ্ডল, কালপুরুষ ও ধ্রুবতারা এবং অন্ধকার আকাশের অপূর্ব রূপ । বড়মা বলতেন দাদুও আমাদের ছেড়ে তারাদের মধ্যে মিশে  গেছেন । খুঁজতাম দাদুকে ঐ তারাদের ভিড়ে। কখনো মনে হতো এই তারাটাই আমার দাদু,  আমাকে দেখে হাসছেন আর বলছেন বড় হয়ে ভাল করে পড়াশোনা করলে আমিও একদিন দাদুর মতো তারা  হয়ে যাব। খুব আনন্দ হতো দাদুর কাছে  যেতে পারব বলে কারণ দাদু ই তো আমার সঙ্গে খেলতেন আর বলতেন,"ছুটকু আমার সিগারটা নিয়ে আয় তো।" ঐ মোটা সিগার লাইটার জ্বালিয়ে ধরিয়ে সুখটান দিয়েই মিলটনের লিসিডাস বা শেক্সপিয়ারের কোন অংশ আবৃত্তি করতেন। দাদু ছিলেন আমার আইডল এবং খেলার সাথি । সেইদাদু চলে যাওয়ার পর আমাকে বলা হলো দাদু আকাশের তারাদের মধ্যে মিশে গেছেন এবং আমিও তা কখনোই অবিশ্বাস করিনি। স্কুলে স্যারেরা বলতেন উপগ্রহের আলো স্থির আর তারাদের ঝিকিমিকি আর এটাই তাদের পার্থক্য চেনার জন্য‌ । সময়‌ গড়িয়েছে , আমরাও বড় হয়ে জীবনের উপান্তে এসে গেছি,  বিজ্ঞানের অগ্রগতি হয়েছে, জীবন যাপন ও অনেক সহজ হয়েছে, আমাদের কষ্ট করার ক্ষমতাও অনেক কমে গেছে এবং ব্যস্ততার মধ্যে প্রকৃতির সেই অপূর্ব রূপ দেখার চোখ  ও আমরা হারিয়ে ফেলেছি এবং প্রকৃতিও যেন কেমন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে । 
আমরা সাজি অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। গ্রামের মেয়ের সাজ একরকম, শহরের তা থেকে অনেক আলাদা। অবশ্য বিশ্বায়নের দৌলতে গ্রামের মেয়েরাও আর পিছিয়ে নেই, এমন কি কোন কোন সময় তারা শহরের মেয়েদের ও হার মানিয়ে দেয়। শুক্লপক্ষে চাঁদ ধীরে ধীরে পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় এবং  সারা আকাশ একটা অপূর্ব স্নিগ্ধতায় ভরে যায় এবং ঝলমলে আকাশ চাঁদের আলোয় মন ভরিয়ে দেয় কিন্তু  পরদিন ই চাঁদের ম্লান রূপ দেখে মনটা একটু বিষণ্ণ হলেও তার রূপ ও ভোলার নয়। রঙটা একটু চাপা কিন্তু তার গরিমা এতটুকুও কম নয় । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাধেই কি লিখেছিলেন, " কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের  লোক, মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে, কালো মেয়ের কালো হরিণ চোখ।" কালো মেয়ের কালো রূপ ও যে অসাধারণ হতে পারে তা তাঁর কবিতায় ও গানে প্রকাশ হয়েছে । আদিবাসীদের মধ্যেও কালো ছেলেমেয়েদের চুল, দাঁত ও চোখ দারুণ সুন্দর দেখা যায়।। সুতরাং,  এই ছেলেমেয়েদের মতোই কৃষ্ণপক্ষের আকাশভরা সূর্য তারার রূপ কিসে কম? শুধু দেখবার মতো চোখ চাই।
কিন্তু বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে শিল্পায়নের ও অগ্রগতি হয়েছে  আর প্রকৃতিও হারিয়েছে তার নিজস্ব সত্ত্বা ও রূপ। সন্ধে হলেই আগে যেমন আকাশে ফুটে উঠত তারার মেলা, এখন তা আর দেখা যায়না দূষণের জন্য । এই দূষণ ছড়িয়েছে প্রত্যন্ত গ্রামেও, সেখানেও আর তারারা দূষণের স্তর ভেদ করে প্রকাশ হয়না যেমন আগের দিনের প্রতিভাবান ব্যক্তিরা ( কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবিরা)  সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেলেও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন কিন্তু বর্তমানে অন্যায়টাই যখন ন্যায় হয়ে দাঁড়িয়েছে  তখন এই তথাকথিত পণ্ডিত বা বুদ্ধিজীবিরা প্রতিবাদে মুখর হন না। তাঁরাও আজ তারাদের মতোই লুকিয়ে পড়েছেন।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ স্বরূপ নাইটহুড খেতাব ত্যাগ করেছিলেন, আজকের পণ্ডিত ব্যক্তিরা তাঁদের  ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধে উঠে একটুও কি  প্রতিবাদ মুখর হতে পারেননা? তাঁরাও কি সেই সপ্তর্ষি মণ্ডল, ধ্রুবতারা  বা কালপুরুষ,  নীহারিকাদের মতন হারিয়ে যাবেন ? 

বৃষ্টিস্নাত মধ্যাহ্নে পাখিদের কলতান

মাঝে মাঝেই ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে আর রাস্তাটা একটু শুকনো হতে না হতেই আবার ভিজিয়ে দিচ্ছে। আকাশ মুখ ভার করে রয়েছে সবসময়ই কিন্তু এর ফাঁকেই যেই না রোদের ঝলক দেখা দিচ্ছে অমনি পাখিগুলো এসে খেতে চাইছে। ওরা রোজ ই আসে খাবার খেতে এবং ওদের আসার সময় ও ভিন্ন । সাতসকালেই পায়রা আসবে ছোলা খেতে এবং এক প্রস্থ খাওয়া হয়ে গেলেও কাকেরা যখন আসে বিস্কুট খেতে  তখন ও তারা আসবে এবং কাকগুলোকে রীতিমতো সুমো কুস্তিগিরের মতো তেড়ে গিয়ে তাড়িয়ে দিয়ে বিস্কুট খেয়ে নেবে। কাকের অত বড় ঠোঁট থাকা সত্ত্বেও কেন জানিনা ওরা রণে ভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে যায়। শালিক যেন চশমা পড়া পণ্ডিত মশাই কিন্তু ঝগড়া করার সময় ওর কাছাকাছি কেউ আসতে পারেনা। বুলবুলিরা আসে এবং ডাকতে যখন থাকে তখন  যেন মনে হয় পায়ে ঝুমুর বেঁধে কেউ আসছে। কাঠঠোকরা মাঝে মধ্যে আসে এবং পড়ে থাকা বিস্কুটের গুঁড়োগুলো যখন খায় তখন তার সারা শরীরটা কার্নিশের নীচে ঝুলতে থাকে এবং তার ঝুঁটিওলা মাথা দেখে বোঝা যায় যে তারা এসেছে এবং  সুন্দরভাবে গুঁড়োবিস্কুটগুলো খেয়ে নিয়ে তির তির তির তির  করে ডাকতে ডাকতে উড়ে যায়। সাদা কালোয় মনোমুগ্ধকর গাঙ শালিকের দেখাও মাঝে মাঝে মেলে যারা আসে খাবার খেতে কিংবা জল খেতে। আসে ধূসর রঙের ডানায় সবুজ সবুজের ছিটেওলা ঘুঘু যার চোখ দুটো পায়রার চেয়ে ছোট কিন্তু তাদের মতোই গোল গোল চোখ নিয়ে  কিন্তু তারা প্লাস্টিকের ছোট গামলায় রাখা জল খেতে পারেনা, তারা টবের নীচে রাখা চ্যাপ্টা থালার মধ্যে রাখা  জল যায়। অনেকে বলে ঘুঘু আসা নাকি খুব অলক্ষুণে কিন্তু আমার কিন্তু খুব ভাল লাগে ওরা এলে। আসে ছাতারে পাখি, অনেকটা চড়াই পাখির মতো কিন্তু আকারে বড়, দল বেঁধে এবং কর্কশ গলায় হৈচৈ করে খেয়েদেয়ে জল খেয়ে চলে যায়। চড়াই পাখি ভীষণ ভীতু এবং লাজুক, চোখাচোখি হলেই ফুরুৎ করে পালায়। হলুদ শরীরে বাদামী ডানার বসন্তবাউড়ি বা বসন্তবাহারি আসে শীতে কিন্তু অন্য সময়ে যে কোথায় তারা থাকে তার দিশে পাইনে।
বৃষ্টি এখন ধরেছে। রোদ না উঠলেও আলোর আভা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে । কাকগুলো ভিজে একশা হয়ে গেছে। মাঝে মাঝেই ডানা ঝেড়ে জলটা ফেলে শরীর শুকানোর চেষ্টা করছে। হঠাৎই কা কা শব্দে প্রায় গোটা পঞ্চাশেক কাক একটা এমার্জেন্সি মিটিং করতে পাশের বাড়ির ছাদের কার্নিশের উপর বসল এবং মিনিট পাঁচেক পরেই কি সিদ্ধান্ত হলো কে জানে আবার যে যেখান থেকে  এসেছিল ফিরে গেল। একটু দূরে সেগুন গাছের মগডালে একটা খুবই সরু ডালের উপর ছোট্ট একটা কালো পাখি কিন্তু গলার আওয়াজ অত্যন্ত তীক্ষ্ণ  ডেকে চলেছে  চুঁ চুঁ চুঁ-----চুঁ উ চুঁ। কি যে বার্তা তার বুঝে উঠতে পারিনা। এই পাখিটার ডাক ই শুনতে পাই রাত্রি দুটো আড়াইটায়। এত যে কি কাজের তাড়া বুঝিনা কিন্তু সর্বপ্রথম এই সবাইকে সচকিত করে দেয় ভোর হয়েছে, উঠে পড়।
পার্কের বাদামগাছের পাতাগুলো হয়েছে ঘন সবুজ, আঁশফলের গাছেও এসেছে ফল, কাঁঠাল গাছে আসা এঁচোড় পেড়ে নেওয়া হয়েছে চোরের উপদ্রবে। সেই  তুলনায় সেগুন গাছের  পাতাগুলো এখনও হাল্কা সবুজ রয়েছে । এই সেগুন গাছের একটা বিশেষত্ব রয়েছে যে নীচের দিকের পাতাগুলো  বেজায়  বড় কিন্তু উপরের দিকে পাতাগুলো  ধীরে ধীরে ছোট হয়ে গেছে। একটু দূরে রাধাচূড়া গাছের হলুদ ফুল শুকিয়ে বাদামী রঙের ফল হয়েছে  কিন্তু নীচের দিকে এখনও কিছু ফুল অবশিষ্ট আছে এবং জাহির করছে যে আমরা এখনও শেষ হয়ে যাইনি। ঠাণ্ডা একটা আমেজ, দুটো টিয়া পাখি সেগুন গাছের ডালে এসে বসল কিন্তু কি মনে হলো ট্যাঁ ট্যাঁ করে ডাকতে ডাকতে কোথায় উধাও হয়ে গেল । একটা চিল উড়তে উড়তে হয়তো ক্লান্ত বোধ করায় একটু বসতে না বসতেই কোথা থেকে ছুটে এল একদল কাক কা কা করতে করতে এবং  তাড়া করল সেই ক্লান্ত চিলটাকে। খানিকক্ষণ উপেক্ষা করলেও বেশীক্ষণ টিকতে পারলনা সে , উড়ে চলে গেল দিগন্তের পানে,  হদিশ পেলনা কাকের দল।
আবার শুরু হলো বৃষ্টি, এবার ঝিরঝিরানিটা একটু জোরে। এত যে পাখির দল এখানে সেখানে কলতানে মত্ত ছিল কোথায় উধাও  হলো‌ কে জানে? 

Friday, 23 May 2025

আমফানের পাঁচ বছরের জন্মদিন

দেখতে দেখতে  আমফান পাঁচ বছরে পা দিল। ভয়ঙ্কর সেই অভিজ্ঞতা মনে এখনও  দগদগে ঘায়ের মতো রয়েছে ।ছেলেমেয়েদের পাঁচ বছরের জন্মদিন আজকাল খুব ঘটা করে পালন করা হয়। বাচ্চাদের জন্মদিন মানে সে এক ঘনঘটা। আগে বাড়িতে মা কাকিমারা একটু পায়েস করে দিত, সঙ্গে একটু দু চার রকমের ভাজা আর একটু মাংস। তখন খুব কম বাড়িতে মুরগীর মাংস ঢুকত। যৌথ পরিবারে এর বেশী সম্ভব হতো না। এখন পরিবার  হয়েছে ছোট,  বলা যায় সংক্ষিপ্ততম( যদি হয় একটা বাচ্চা) আর যদি একের থেকে দুই হয়। তাহলে পরিবার সম্পূর্ণ। কাকা, কাকিমা , জ্যাঠামশাই, জেঠিমা নামগুলো কেমন যেন  অচেনা শব্দ শোনায়। ঠাকু্র্দা, ঠাকুমাও যেন শোনা শোনা মনে হয়। তবু মন্দের ভাল মাসিমা ও মেসোমশাই যেটা তার মেদ বর্জন করে হয়েছে মাসি ও মেসো এবং দাদু ও দিদু( দিদিমাও ফিগার নিয়ে সচেতন)একটু চেনা চেনা মনে হয় এবং ইংরেজিতে কাজিন বললে মাসতুতো ও মামাতো ভাইবোনদের বোঝায়, পিসতুতো,  খুড়তুতো ও জ্যাঠতুতো ভাইবোনদের  একটা আলাদা  ইংরেজি প্রতিশব্দের খোঁজে আছেন অভিধান প্রণয়িতারা। যাই হোক  বাচ্চাদের জন্মদিনে এখন কেক কাটা আবশ্যিক, পায়েস হলেও সেটা এক চামচ বা বড়জোর দুচামচ । বাচ্চারা আজকাল  মিষ্টি এড়িয়ে চলে মোটা হয়ে যাবার ভয়ে। সারাদিন  স্কুল,  টিউশন করে খেলাধূলোর সময় নেই,  তাহলে গোলগাল লাল্লু লাল্লু হবে না তো কি হবে?  তাদের মিষ্টি বর্জন তো স্বাভাবিক । এখন বাচ্চাদের বন্ধুবান্ধব এবং  তারা একা আসতে পারবে না বলে তাদের বাবা, মাকে( নিদেন পক্ষে মা) বলতেই হয় আর তা ও সম্ভব না হলে বাচ্চাদের ন্যানিকে নিয়ে আসতে হয়। জন্মদিনের এই ঘনঘটা পাঁচ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে সে এক মহাসমারোহ।

আমফান এর পাঁচবছর পূর্তি আমরা কেউ সেইভাবে মানাতে পারিনি কারণ তার দাপাদাপির ভয়ানক নির্ঘোষ আজও  মনে আছে ভীষণভাবে । গোঁ গোঁ শব্দে ১৫০/১৬০ কিলোমিটার বেগে উত্তর পূর্ব দিক থেকে ধেয়ে আসা ঝড়ের গতি যে কি ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরী করে তা যারা না দেখেছেন তাঁরা কিছুতেই বুঝতে পারবেন না। কলকাতা শহর তো সমুদ্র থেকে প্রায়‌ দুশো কিলোমিটার দূরে  কিন্তু তা সত্ত্বেও তার যা প্রকোপ পড়েছে তাহলে সমুদ্রের ধারে  যে কি অবস্থা তা সহজেই অনুমেয় । কংক্রিটের  বিরাটজঙ্গলে ভরা কলকাতা শহরের গল্ফগ্রীন তো সবুজে সবুজময় গাছপালার আধিক্য এখানে অনেক বেশী অন্য জায়গার তুলনায় । সবুজ গল্ফগ্রীনে তাই ঝড়ের মাতন আলাদা। গাছগুলো প্রাণপণ চেষ্টা করছে তাদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে কিন্তু নাছোড়বান্দা ঝড়ের সঙ্গে কতক্ষণ যুঝতে পারে সেটাই  দেখার বিষয় । দক্ষিণ দিকে একটা বিরাট দারুণ সুন্দরী ইউক্যালিপটাস গাছ ঝড়ের কাছে হাত জোড় করে মিনতি করছে তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য কিন্তু নির্দয় আমফানের হৃদয় গলে না কিন্তু তাকে একেবারে মেরে না ফেলে তার অঙ্গ ছেদন করে ছেড়ে দিল । সুন্দরী ইউক্যালিপটাস মনের দুঃখে অন্নজল ত্যাগ করে মৃত্যু বরণ করল। এদিকে ওদিকে যারা বড় যোদ্ধা বলে নিজেদের উপস্থিতি জাহির করত তাদের  একে একে সমূলে উৎপাটিত করে ফেলল আমফান ।  ফেজ থ্রি অ্যাসোসিয়েশন হলের বাঁ দিকে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ ও ডানদিকে একটা রাধাচূড়া গাছ পরস্পর পরস্পরের সম্পূরক ছিল। কৃষ্ণচূড়ার লাল রং আমফানের সহ্য হলো না, তাকে সমূলে উৎপাটিত করে ফেলল আর অনেক কাকুতি মিনতি করায় রাধাচূড়োর ঝুঁটি ছেঁটে দিয়ে তাকে অব্যাহতি দিল। পিছনের হিলহিলে সুপুরী গাছ আমফান যা বলে তাই করে, সুতরাং সে একেবারই ছাড় পেয়ে গেল কিন্তু সে তার পাঁচ বছরের জন্মদিন পালন করতে পারল না, অসুস্থতার কারণে  কর্পোরেশনের লোকজন তাকে কেটে ফেলল। একটা ছোট্ট তিন কোণা পার্কে দুটো কাঠবাদামের গাছ তারাও একদম ছাড় পেলনা কিন্তু তাদের গোস্তাখি সেবারের মতো মাফ করে দিল কিন্তু অবশ‌্য ই তাদের হাত পা ভেঙে দিয়ে।
হাজার হলেও  আমফান তো নিছক ঝড় নয়, সে প্রবল সামুদ্রিক ঝড়। তাকে তো সম্মান জানাতেই হয়। তার জন্মদিনে আমরা ফেজ থ্রির অধিবাসীরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটকের গানের রিহার্সাল দিচ্ছিলাম। যেই না শেষ হলো রিহার্সাল,  অমনি শুরু হলো গোঁ গোঁ আওয়াজে আমফানের পদধ্বনি। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসে জানলা, দরজা বন্ধ করে তাকে স্বাগত জানালাম । আমফান  মোটামুটি খুশী যে আমরা তাকে ভুলে যাইনি এবং একটা সাময়িক ঝলকে আমাদের  গা হাত পা জ্বলে যাওয়া গরম থেকে নিষ্কৃতি দিয়ে তার আমাদের  প্রতি খুশীর বার্তা দিয়ে বলে গেল," ভুলিও না মোরে কভু, ছিলেম আমি, আছি আমি, থাকব সদাই তবু।"

Thursday, 22 May 2025

শিল্পী ও শিল্প

হারু বাবু বা হারান বন্দোপাধ্যায় একজন নামী ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত  শিল্পী বালির খটখটিবাগানে থাকতেন । শ্রদ্ধেয় সঙ্গীত শিল্পী তারাপদ চক্রবর্তীর অত্যন্ত প্রিয় ছাত্র এবং তাঁর তত্ত্বাবধানে তের বছর সঙ্গীত সাধনা  করেছেন এবং তাঁর অনেক ছাত্রছাত্রী।  কোন‌‌ বাঁধা চাকরি বাকরি করেন নি কোনদিন তিনি , একটাই ভয়ে যে বাঁধাধরা চাকরিতে‌‌‌ তাঁর শিল্প সাধনা ব্যাহত হবে। অল্প বয়স তখন, মনের সুখে সাধনা করে চলেছেন একনিষ্ঠ ভাবে, নাম ছড়িয়ে পড়ছেএই শহর থেকে  ওই শহরে আর খুশীর জোয়ারে ভেসে চলেছেন তিনি । শ্রদ্ধেয় শিল্পী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য তাঁর  অগ্রজ প্রতিম এবং  তাঁর ভাই পান্নালাল ভট্টাচার্য তাঁর বন্ধু। তাঁরা তিনজনই আকাশবাণীর  নিয়মিত শিল্পী। হারু বাবু গান ক্ল্যাসিক্যাল  এবং ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য ও পান্নালাল ভট্টাচার্য গান ভক্তিগীতি এবং তিনজনই স্ব স্ব ক্ষেত্রে সমুজ্জ্বল । তখন বালি, বেলুড় ও উত্তরপাড়া অঞ্চল সঙ্গীত সাধনায় খুবই অগ্রণী ছিল। প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই সকাল সন্ধ্যায় কিছু না কিছু সঙ্গীত চর্চা শোনা যেত এবং সঙ্গীত শিক্ষকদের ছিল রমরমা বাজার। সুতরাং কেন তাঁরা বাঁধাধরা চাকরিতে‌‌‌  যাবেন? 
কিন্তু পরিবর্তন এল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে । এখন সকাল সন্ধে বেলুড়, বালি, উত্তরপাড়ার ঘরে ঘরে হারমোনিয়াম বা সেতার, সরোদের আওয়াজ বা তার সঙ্গে তবলা সঙ্গতের আওয়াজ শোনা যায়না। হারমোনিয়াম বা তানপুরা বিক্রি ভয়ানকভাবে কমে গেছে । এখন এসেছে টেকনোলজির যুগ। কি বোর্ড এবং  সিনথেজাইজারের সঙ্গে  আরও অনেক যন্ত্রের মিশ্রণে গাওয়া গানে গলার উৎকর্ষতা ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। কে ভাল আর কে একটু কম ভাল তা বিচার করা খুবই কঠিন এবং  বিচারকের আসনে যাঁরা বসেন তাঁদের পছন্দ অপছন্দ ই শেষ কথা এবং  সেইখানেও  যাঁরা শ্রোতা তাঁরাও হতভম্ব হয়ে যান। অবশ্য সব যুগেই এটা ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এই যুগে আগের মতন আর দারুণ অনুশীলনে খুব কম জনকেই ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় কারণ পড়াশোনার চাপ এবং  প্রত্যেক শিশুকেই তার বাবা মায়েরা নানা বিষয়ে সেরার সেরা হিসেবে দেখতে চায় যার অবশ্যম্ভাবী ফল সব জিনিস  তারা অল্পবিস্তর জানে কিন্তু কোনটাই তারা ভালভাবে জানেনা। একটু শিখতে শিখতেই বাবামায়েরা তাদের নানাধরণের প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করাতে নিয়ে যান। বনিয়াদ একটু মজবুত না হওয়ায় এদের  বেশীরভাগ ছেলেমেয়েই বিস্মৃতির আড়ালে চলে যায় । এ ছাড়া এদিক সেদিকে নানারকম স্কুল  ব্যাঙের ছাতার মতন গজিয়ে ওঠায় বাবামায়েদের ও বিভ্রান্তির একশেষ। কিন্তু এদের মধ্যেই যারা একনিষ্ঠভাবে এগিয়ে যায় তারা এই প্রতিযোগিতায় টিকে যায়।
হারুবাবু ও এই পরিবর্তন একদম বুঝতে পারেন নি তাঁর ই মতো অন্যান্য অনেক শিল্পীদের মতন। চাকরি বাকরি ও নেই,  নেই কোন বাঁধা আয়ের ব্যবস্থা, ছেলেমেয়েদের মধ্যেও কমে গেছে ক্ল্যাসিক্যাল গান শেখার ইচ্ছা এবং বেড়েছে চটুল‌ গান শিখে টিভি ও অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে পাদপ্রদীপের আলোয় আসা। এক সময় চারদিক আলো করে থাকা শিল্পী যাঁর চারপাশে থাকত‌ চামচার দল তারা এখন কোথায় যেন হারিয়ে গেছে । ছাত্রের জন্য‌ একে তাকে অনুরোধ করা এবং শুকনো কথায় চিঁড়ে না ভেজায় উনি বুঝতে পেরে গেছেন যে এইসব স্তাবকের‌ দল তাঁকে এড়িয়ে‌ যাচ্ছে‌ এবং আজকাল আর কাউকে বলেন না। তবে খুবই ঘনিষ্ঠ ছাত্রদের বলেন যে যদি কোন ছোটখাটো একটা কাজের সন্ধান‌ দেয়।‌ অন্তরে সবসময়ই কেঁদে চলেছেন হারুবাবু কি করে এত বড় সংসারটাকে চালাবেন। যখন প্রচুর পয়সা আসতো তখন দুহাত খুলে খরচা করেছেন, বহু লোককে অর্থ সাহায্য করেছেন কিন্তু কোনদিন  তারা সেই অর্থ ফিরিয়ে দেয়নি, বলাই বাহুল্য হারুবাবু মুখ ফুটে কোনদিন তাদের বলতে পারেন নি এবং তারাও সেই দুর্বলতার পুরো সুযোগ নিয়েছে। মাঝে দোকানদার ধারে মাল দিত কিন্তু  ঠিক সময়ের মধ্যে পয়সা না দিতে পারার জন্য তারাও মাল দেওয়া বন্ধ করেছে। চার মেয়ের বড়জন যে খুব ভাল গান করত এবং  হারুবাবু যার ওপর খুব ভরসা করতেন, সে‌ সরস্বতী পূজোর দিন বাড়ি থেকে চলে গেছে একটা ছেলের হাত ধরে যা হারুবাবুকে একদম ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। একমাত্র ছেলে যে বি কম পড়তো সে ও তার তবলার অনুশীলনে ব্যাঘাত ঘটছে দেখে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে। সে মোটামুটি রোজগার করেএবং  বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছে। অসুস্থ হারুবাবু আজকাল আর গান গাইতে পারেন না, মেজ মেয়ে এখানে সেখানে ফাংশন করে‌ যা পায়‌ তাই দিয়ে কোনরকমে চলে সংসার।
দীর্ঘদিন  পরে তাঁরই এক ছাত্র  বিদেশ থেকে  এসেছেন তার মাস্টারমশায়ের সঙ্গে দেখা করতে। অশক্ত শরীর নিয়ে  হারু বাবুর আর সেই  সাধ্য নেই প্রিয় ছাত্রকে বুকে জড়িয়ে ধরার , ক্ষীণ স্বরে বললেন, " অশোক, এসেছো, কেমন আছো ?"  অশোক প্লাস্টিকের বেত ওয়ালা চেয়ার টেনে সমস্ত খবর নিল এবং  " মাস্টারমশাই,  আমি এখনই আসছি '' বলে বাইরে বেরিয়ে গেল এবং  কাছাকাছি  এ টি এম থেকে টাকা তুলে নিয়ে এল এবং  মাস্টারমশাই এর হাতে দিল কুড়ি হাজার টাকা এবং  আরও বলল যে মাস্টারমশাই  আমি আবার  আসব । ইতিমধ্যে মাস্টারমশাই এর স্ত্রী চা করে এনেছেন । তাঁর পরনের শাড়ি দেখেই অশোক  বুঝতে পারল‌ যে‌ কি অবস্থার  মধ্য দিয়ে  সংসারটা চলছে। ইতিমধ্যে  তাঁর মেজমেয়ে কোথাও গান শিখিয়ে ফিরে এসেছে এবং সংক্ষেপে সংসারের অবস্থা বলল। চোখের জল ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে দেখে অশোক তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল এবং তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের বিশদ বিবরণ নিয়ে নিল এবং  ফিরে যাওয়ার আগে আবার আসবে বলে বিদায় নিল।
ফিরে যাওয়ার বেশীদিন বাকি ছিলনা, অশোকের  আর মাস্টারমশাইদের বাড়ি যাওয়া হয়ে ওঠেনি কিন্তু  যাবার আগে মাস্টারমশাই এর মেয়ের অ্যাকাউন্টে একলক্ষ টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে । জানে সে যে এই টাকায় বেশীদিন  চলবে না তবে প্রিয় মাস্টারমশাইকে সে মাঝে মাঝেই কিছু টাকা পাঠাবে বলে মনস্থ করেছে।
এই হচ্ছে  সাবেকি মাস্টারমশাইদের অবস্থা যাঁরা সময়ের সঙ্গে চটুল গান স্বীকার করে নিতে পারেন নি।সরকার এই দুর্দশাগ্রস্ত শিল্পীদের পাশে যদি না দাঁড়ান তবে এই শিল্পীরা নিঃশেষ হয়ে যাবেন এবং শিল্পী ই  যদি না থাকেন তবে শিল্প কি করে সৃষ্টি হবে? 

Saturday, 17 May 2025

দীনবন্ধু মোটর ওয়ার্কস

কলকাতা থেকে এনবিএসটিসির বাসে বহরমপুরের পথে। মাঝে রাস্তাটা খুব খারাপ  থাকায় পৌঁছতে প্রায় ছঘন্টা লেগে গেল ।বিষ্ণুপুর কালীবাড়ির মোড়ের কাছে  এক বিশাল জ্যাম। বাড়ি পৌঁছতে এমনিতেই দেরী হয়েছে, তার উপর বাড়ির গোড়দোরায় এসে এমন জ্যামে মেজাজটা হয়ে গেল তিরিক্ষি। নেমে পড়ল কল্যান, ওখান থেকে  হেঁটেই মেরে দেবে। এখন চাকাওয়ালা ট্রলি ব্যাগের কল্যাণে স্যুটকেস বইতে হয়না, কুলি মজুরদের  পেটে লাথি  পড়েছে এই ট্রলি ব্যাগের জন্য।  অনেকেই নেমে হেঁটে চলে যাচ্ছে। কল্যান নামতেই হঠাৎই একটা লোহার মতন শক্ত হাত তার কাঁধে পড়ল, বলে উঠল আরে কলু না? কল্যানকে তার ছোটবেলার  বন্ধুরা সবাই কলু বলে ডাকত। কিন্তু এতদিন পর সে আসছে নিজের  শহরে, এখানে তাকে ডাকনামে কে ডাকে?  ঘাড়  ঘুরিয়ে  দেখতেই সে দেখে একটা গাঁট্টাগোট্টা কালো কুচকুচে লোক প্রায় তারই বয়সী কিন্তু মাথায় বেশ জমিয়ে টাক পড়েছে তাকে গায়ে হাত দিয়ে  ডাকছে। কলু পড়াশোনায়  বেশ ভাল ই ছিল এবং  পাশ করার পর মোটামুটি  ভাল চাকরি করায়  চেহারায় বিশেষ  কিছু পরিবর্তন  হয়নি‌ কিন্তু যে গায়ে হাত  দিয়ে  ডাকল তাকে তো সে প্রায় চিনতেই পারছে না। 
আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারছি না, একটু বলবেন আপনার পরিচয়? 
আরে আমি দীনু, দীনবন্ধু মজুমদার,  তোর সঙ্গে  একসাথে একই  সেকশনে পড়তাম কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুলে । ক্লাস  সেভেনে  পাশ করতে না পারার জন্য বাবা আমাকে আর পড়ালো না, বাবার সঙ্গে মোটর গ্যারাজেই হাত পাকালাম, আর আমার  ভাই জয়ন্ত পাশ করল বলে বাবা ওকে পড়ালো। ও পাশ করে কলেজ থেকে  গ্র্যাজুয়েট হয়ে ইরিগেশন ডিপার্টমেন্টে কাজ  করছে আর আমি বাবা চলে যাওয়ার পরে এই গ্যারাজ সামলাচ্ছি।  মনে পড়ল অনেকদিন আগের কথা। ওকে সবাই কালবাউস বলে ডাকত । খুবই  ডাকাবুকো  টাইপের। পড়াশোনায় বিশেষ দরের ছিলনা বটে  কিন্তু  বাবার সঙ্গে ছোটবেলা থেকে মোটর গ্যারাজে কাজ  করে সে একজন নামকরা মিস্ত্রি এবং  বাবার গ্যারাজটাকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে সে এক নামকরা গ্যারাজের মালিক। বহু লোক  কাজ করছে, অনেক  গাড়ি ও বাস  দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। ধীরে ধীরে  মনে পড়ছে সব পুরনো‌ দিনের কথা। সাইকেল  চালিয়ে  ও আমাদের  ঐ রাজবাড়ির মতন স্কুলের দোতলা থেকে  নীচে  নামত। স্যারেরা অনেকবার  বারণ করা সত্ত্বেও  সে শুনত না, তার সাইকেলে কন্ট্রোল এতটাই অসাধারণ  ছিল। গায়ে জোর ছিল সাধারণের তুলনায় অনেক বেশী  আর মোটর গ্যারাজে কাজ করার জন্য হাতগুলো যেন লোহা। কিন্তু এইরকম ছেলেদের  মনটা থাকে খুবই  নরম। নিজেরা পড়াশোনা করতে না পারার জন্য তারা কিন্তু  পড়াশোনায় ভাল ছেলেদের খুব  সম্মান করতো। কলু দিল্লী আই আই টিতে চান্স পাওয়ার পর যখন টাকার অভাবে  পড়তে পারেনি তখন ঐ দীনুই তাকে বলেছিল ," কলু, তুই  যা পড় গিয়ে, আমি তোর পড়ার খরচ জোগাব। তারপর তুই যখন বড়  হয়ে যাবি তখন আমার কথা ভাবিস।" মনে পড়ে গেল কলুর সেই পুরনো দিনের কথা । বড় মাটির ভাঁড়ে দুকাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে, পেঁয়াজি আর আলুর চপের সঙ্গে মুড়ি নিয়ে দুই ছোটবেলার বন্ধু স্মৃতিচারণ করছে আর গ্যারাজের সব লোকজন হাঁ করে দেখছে তাদের। তাদের মালিককে তারা কখনো এইভাবে প্রাণখুলে গল্প করতে দেখেছে বলে তাদের মনে পড়েনা। কলুর চোখে সেই কালো কুচকুচে কোঁদা চেহারায় ঝকঝকে সাদা দাঁত আর ভীষণ জ্বলজ্বলে দুটো চোখ অনেকটা নিগ্রোদের মতো সেই কালো মানিক বা কালবাউস আজ মাথার চুল অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে কিন্তু  মনটা তার আজও শিশুর মতোই রয়েছে । 
গ্যারাজ অন্ত প্রাণ  দীনু আজ বহু লোকের  অন্নসংস্থান করছে। নিজে  বিয়ে থাওয়া করেনি। জয়ন্তর ছেলেমেয়েরাই তার নিজের  ছেলেমেয়ে আর এই বিশাল গ্যারাজের লোকজনদের পরিবার ই তার নিজের পরিবার। 
এবার উঠি রে দীনু, বলে বাড়ির দিকে যাওয়ার জন্য একটা রিক্সায় উঠল কলু। ভাবছে লোকে পড়াশোনা কর পড়াশোনা কর বলে পাগল করে দেয়  কিন্তু তারা নিজেরা এত ভাল করে পড়াশোনা করে কি করেছে? একটা ভাল চাকরি, তারপর বিয়ে সংসার  কেবল নিজেদের  নিয়েই শশব্যস্ত, আর পাঁচটা লোকের  কতটা উন্নতি করতে পেরেছে?   অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সেরকম কিছু করতে পেরেছে বলে মনে করতে পারলনা কিন্তু সেখানে দীনু ঐ সামান্য  বিদ্যা নিয়েই বহুলোকের পরিবার সামলেছে, দীনু অনেক বড়মাপের মানুষ ।

Tuesday, 13 May 2025

উবের ড্রাইভার

উবের ড্রাইভারদের সম্পর্কে নানান জনের নানা অভিজ্ঞতা । বেশীরভাগ সময়ই দেখা যায় ফোনে পিন নম্বর এসে গেল এবং  ড্রাইভারের যাবতীয় ঠিকুজি কুলজি সমেত গাড়ির নম্বর এবং হাসি হাসি মুখে ড্রাইভারের ছবি সমেত কতক্ষণে আসছে তাও এসে গেল কিন্তু  নির্দিষ্ট  সময় পরেও তাঁর দেখা নাই রে তাঁর দেখা নাই। ফোনে যোগাযোগ করা হলে অপরপ্রান্ত থেকে প্রশ্ন এসে গেল  কোথায় যাবেন এবং  তার পর মূহুর্তেই নিথর নীরবতা এবং  মোবাইলে চাকা ঘুরতে থাকল এবং  লিখিত মেসেজ আসতে লাগল( অবশ্য যদি খুব দেরী হয় পরিবর্ত গাড়ি না পেলে) । আর দেরী দেখে যদি ক্যান্সেল করা হলো তাহলে আপনার  ঘাড়ে তার কোপ অবশ্যই পড়বে। আমরা যারা পুরনো দিনের লোক তাদের  ভাগ্যে অবশ্যই এই শাস্তি বহাল থাকবে । খোঁজাখুঁজি করে কোথায় কিভাবে ক্যান্সেল করতে হবে পাওয়া যাবেনা এবং  যখন পাওয়া গেল ততক্ষণে সময়  অতিক্রান্ত । অতএব,  গ্যাঁট গচ্ছা যাবেই। আজকের যুগের ছেলেমেয়েদের  কাছে কিন্তু এরা মহা জব্দ। এরা খুটখাট করে ঠিক সময়ের মধ্যেই তাকে ক্যান্সেল করে দেবে। এদের কাছ থেকে  পয়সা ভুগিয়ে ভাগিয়ে নেওয়া শিবের বাবার ও অসাধ্য।  অনেকদিন  আগে একজন বিদগ্ধ ব্যক্তি মন্তব্য করেছিলেন যে কম্পিউটার না জানলে সে অশিক্ষিত। তিনি একজন  ভারতবর্ষের  সেরা ইনস্টিটিউটের ইঞ্জিনিয়ার এবং অত্যন্ত পণ্ডিত  ব্যক্তি,  সুতরাং  তাঁর কথাকে একবাক্যে নস্যাৎ করা যায়না এবং  বাস্তবিক ক্ষেত্রে সেটাই ঠিক । এখন বাচ্চাদের  মোবাইল না খুলে দিলে খাবেনা আর নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি হওয়ার দরুণ বাবা মায়েদের এত ধৈর্য্য ধরে খাওয়ানোর সময় ও নেই। সুতরাং,  প্রেশার কুকারে সেপারেটর দিয়ে ভাত, ডাল, সব্জি সেদ্ধ করে চটপট বাচ্চাকে ডে কেয়ারে দিয়ে অফিসে দৌড়াও। মাঝে কোভিডের জন্য অবশ্য ওয়ার্ক ফ্রম হোম হচ্ছিল এবং  বাবামায়েদের একটু হ্যাপা কম ছিল । কিন্তু কর্মদাতারা দেখলেন যে এদের অভ্যেস খারাপ হয়ে যাচ্ছে এবং  অনেকেই  একই সঙ্গে একাধিক  সংস্থায় যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং,  ঘোরাও চাকা উল্টোদিকে । যাক এ তো হয়ে যাচ্ছে ধান ভানতে  শিবের গাজন গাওয়া। ফিরে যাওয়া যাক উবের ড্রাইভারের কথায় ।
উবের বুক করা হয়েছে  গড়িয়াহাটের অ্যাপোলো ক্লিনিকে ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে বলে। পাঁচ মিনিটে আসছে বলে আর পাত্তাই নেই। ড্রাইভার সাহেব  আসছেন না দেখে ক্যান্সেল করলাম যখন তখন পনের  মিনিট  পেরিয়ে গেছে, গত্যন্তর না দেখে একটা হলুদ ট্যাক্সি ধরে পৌঁছলাম  প্রায় কুড়ি মিনিট বাদে। ওঁরা আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট প্রায় ক্যান্সেল করেই দিচ্ছিলেন ( হাজার হলেও নামী ডাক্তার তো) কিন্তু অনেক অনুরোধে তাঁরা আর এতটা নির্দয় হতে পারলেন না কিন্তু  আমার দেখানোর সময় অনেকটাই  পিছিয়ে গেল। অনেক কষ্টে একটু জায়গা পেয়ে বসেছি, এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠল, আমার ড্রাইভার সাহেবের গলা, বললেন আপনি অ্যাপোলো ক্লিনিকের জন্য গাড়ি বুক করেছিলেন? আমি বললাম,  হ্যাঁ,  সে তো অনেকক্ষণ আগে আর আপনাদের  দেরী দেখে আমি ক্যান্সেল ও করে দিয়েছি এবং  মিনিট দশেক  হলো আমি পৌঁছে ও গিয়েছি। আমাকে একটু  ধমক দিয়েই বললেন যত্তো সব ভুলভাল পাব্লিক । আমার তখন উত্তর দেওয়ার মতন মানসিক অবস্থা ছিলনা । ঘন্টা পাঁচেক পর ফেরার সময়ের উবের বুক করতে গিয়ে দেখি কোম্পানি আমার উপর ৭৯.৫২ টাকার খাঁড়ার ঘা চাপিয়েছে। আমিও ঠিক করলাম  এই জরিমানা আমি কিছুতেই  দেব না। যাই হোক,  আর একজন সহৃদয় হলুদ  ট্যাক্সির ড্রাইভার  ১৮০ টাকা নিয়ে আমাকে পৌঁছে দিয়ে উদ্ধার  করলেন ।

এ তো গেল এক ধরণের  অভিজ্ঞতা । কয়েকদিন আগে সদ্য হারানো   এক বন্ধুর  শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের পরদিন নিয়মভঙ্গে যেতে হবে । পৌনে একটায় গাড়ি বুক করতেই দেখালো তিন মিনিটে আসছে। মাঝপথে আরও এক বন্ধুকে নিয়ে  যাব, ফোন করলাম তৈরী থাকার জন্য কিন্তু আবার সেই  গোল গোল চাকতি ঘোরা শুরু হলো কিন্তু  যেহেতু পিন নম্বর দিয়ে দিয়েছে আমি ভাবছি এই এল বলে কিন্তু নাহ, পাত্তা নেই আর মেসেজ আসতে শুরু করল ধন্যবাদ  জানিয়ে ধৈর্য্য ধরার জন্য। বন্ধুকে জানালাম সব কথা। দুজনেই যথেষ্ট  ধৈর্য ধরে আছি, শেষমেশ একটা গাড়ি আসছে আট মিনিট বাদে দেখাল। তখন একটা বেজে কুড়ি। দেখতে দেখতে  আট মিনিট  প্রায়‌ এসে গেল । অনেক কষ্টে গলার স্বর যথেষ্ট  মোলায়েম করে ড্রাইভার সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম,  ভাই কোথায়  আছেন,  আসছেন কি, না আপনিও সেই ক্যান্সেল করার দলে? না ,না আমি একজনকে নামিয়ে দিয়েই আসছি। বন্ধুর  দেওয়া ডেড লাইন দেড়টা পেরিয়ে গিয়ে আরও  দু মিনিট  হয়েছে,  নীচে  গাড়ির আওয়াজ পেয়ে ব্যালকনি থেকে দেখলাম একটা সাদা গাড়ি বাড়ির  সামনেই থামল এবং  একটা টেলিফোন  পেলাম  তাঁর কাছ থেকে । নেমে গাড়িতে চেপে বন্ধুকে জানালাম  অলিম্পিকে পদক পাওয়ার কথা এবং  বললাম বাড়ির কাছে এসে একটা ফোন করব । ঝাঁ ঝাঁ করছে রোদ আর পারদের মাত্রা চড়চড়  করে বাড়ছে আর উবেরের এসি পুরো মাত্রায় চড়িয়েও  গরমকে বাগ মানানো যাচ্ছেনা। এর মধ্যেই রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির জন্য  বিশাল জ্যাম, গাড়ির চাকা নড়েনা আর ড্রাইভার সাহেবের অবস্থাও তথৈবচ । ভদ্রলোক,  একবার ও বিরক্তি প্রকাশ করছেন না। পৌনে তিনটে নাগাদ  পৌঁছলাম । ততক্ষণে লোকজন ফিরে যেতে শুরু করেছে। ড্রাইভার সাহেব গাড়ি বন্ধ করে বললেন ২৫২ টাকা হয়েছে । আমি একটা পাঁচশ টাকার নোট  দিয়ে বললাম  আমাকে দুশো টাকা দিন। উনি আমাকে আড়াইশো টাকা দিতে চাইছিলেন এই ভেবে যে দুটাকা আমার কাছে নেই। একটু ইতস্তত করে  বললেন যে স্যার  আমার তো হয়েছে দুশো বাহান্ন টাকা। আমি বললাম  ভাই অনেকটা সময় চলে গেছে জ্যামের জন্য , আপনি ওটা রেখে দিন ।

আবার একটা দিন উবেরে যাওয়া। ভদ্রলোককে দেখে কেমন নিষ্পাপ বলে মনে হলো। যেতে হবে বাঙ্গুর অ্যাভিনিউ । পার্ক সার্কাসে  এসে ও কলামন্দিরের দিকে মোড় নিচ্ছে  দেখে বলে উঠলাম  ঐদিকে কেন মোড় নিচ্ছেন, ওদিক দিয়ে তো অনেক ঘুরতে হবে। আপনি ডান দিকে মোড় নিন এবং  ফ্লাই ওভারে উঠুন । ও বলল, হ্যাঁ স্যার,  আমি জিপিএস দেখেই এই দিকে ঘুরলাম কিন্তু এখন দেখছি ভুল করে ফেলেছি। আসল কথা স্যার,  আগে আমি ট্রাক চালাতাম এবং দিল্লী, বোম্বে ও মাদ্রাজ হাইওয়েতে প্রচুর গাড়ি চালিয়েছি এবং  টাকা পয়সা জমিয়ে এবং  লোন নিয়ে  এই গাড়িটা কিনেছি। স্যার,  এই উবের চালানো য় আমি একদম আনকোরা এবং কলকাতার রাস্তাঘাট ও এখনো পর্যন্ত চিনে উঠতে পারিনি । আমি বললাম,  কোন চিন্তা নেই,  আমি আপনাকে রাস্তার ডিরেকশন দিয়ে দেব । গাড়ি চলছে পার্ক সার্কাস ফ্লাইওভার দিয়ে কিন্তু ভীষণ  জ্যাম । একটা অ্যাম্বুল্যান্স হুটার বাজিয়েই চলেছে কিন্তু কারও কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই এমনকি ফ্লাইওভারের জ্যাম মিটলেও গাড়িগুলো একটুও জায়গা ছাড়ছে না। গাড়ির ভেতর থেকে  দেখলাম আইসিইউ অ্যাম্বুল্যান্স অথচ কারও কোন হেলদোল নেই। আমি মনে মনে বিরক্তি প্রকাশ করছি দেখে ড্রাইভারটি বলে উঠল যে স্যার, আমি মাঝে কিছুদিন অ্যাম্বুল্যান্স ও চালিয়েছি। একদিন  এইরকম জ্যামের মধ্যে আটকে গিয়ে একজন রোগীকে চলে যেতে দেখেছি আর সেই দিন থেকে আমি অ্যাম্বুল্যান্স চালানো  বন্ধ করে দিয়েছি। খুব আশ্চর্য লাগল ছেলেটির‌ মনের নরম দিকটা দেখে।
রাস্তা প্রায়ই শেষ হয়ে আসছে।   অনেক ধন্যবাদ জানালো ছেলেটি। বলল যে কয়েকদিন আগে এক ভদ্রলোক গাড়িতে উঠেছিলেন এবং  জিপিএস দেখতে ভুল হাওয়ায় ভদ্রলোক খুব গালমন্দ করেছিলেন। ড্রাইভারটি আরো জানালো যে স্যার, আমি এই উবের চালানো য় নতুন  এবং  আপনি যদি রাস্তা জানেন তাহলে আমাকে বলে দিন কিন্তু উল্টে ভদ্রলোক  আরও গালাগালি করে বললেন যে রাস্তাই যদি না চেনো, তাহলে গাড়ি বের করেছ কেন? এটাও তার একটা অভিজ্ঞতা । পৃথিবীতে কেউই সব কিছু জানেনা, আস্তে আস্তে সব কিছুই রপ্ত হয় কিন্তু আমরা মাঝে মাঝে  এমন ব্যবহার  করি যে আদৌ আমরা মানুষ  কিনা তাতে  সন্দেহ জাগে । পৌঁছলাম গন্তব্যস্থলে এবং  ছেলেটিকে ভাড়ার চেয়েও পঞ্চাশ টাকা বাড়তি দিলাম ছেলেটিকে ঐদিন যে গালাগালি  হজম করতে হয়েছিল  তাকে কিছুটা প্রশমন করার জন্য।
পৃথিবীতে  কেউই আমরা সর্বজ্ঞ নই  এবং আমাদের  প্রত্যেকের মধ্যেই অনেক খামতি আছে কিন্তু আমরা সহমর্মীতা দেখিয়ে নিজেদের আরও  উন্নত করতে পারি এবং  এই পৃথিবীর চেহারাটা কিছুটা হলেও  ভাল করতে পারি।

Tuesday, 6 May 2025

ঝড় উঠেছে

ঝড় দেখার অভিজ্ঞতা প্রায় সবার ই রয়েছে ।তবে এই অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন রকম এবং একই বয়সের লোকের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন লোকের অভিজ্ঞতা বিভিন্ন। মফস্বলের লোকজন যেখানে গাছপালার আধিক্য বেশী সেখানকার লোকজন যেভাবে ঝড়ের উপস্থিতি বুঝতে পারে, কংক্রিটের জঙ্গলে ভরা শহরের লোকজন  সেভাবে টের পায়না ।

ঝড়ের কথা উঠলেই শৈশবের দিনগুলো মনে পড়ে যায়। মায়ের চোখ এড়িয়ে  বন্ধুদের সঙ্গে আমবাগানে যাওয়া এবং ঝড়ের সঙ্গে সঙ্গে  ঘাড়ে মাথায় চড়বড় করে আম পড়া এবং  পকেট ভরে গেলে জামার কোঁচড়ে (তখন লম্বা হাফ হাতা শার্ট  গরমে পরা হতো এবং  তখন টি শার্টের চল ছিলনা)  আম ভরে পরে ভাগ করা হতো বন্ধুদের মধ্যে। সে এক আলাদা আনন্দ ই ছিল। বাগানের মালির চোখ এড়িয়ে আম চুরি করে খাওয়ার  যে আনন্দ তা ভাষায়  বর্ণনা করা যায়না। আস্তে আস্তে বড় হওয়া, উঁচু ক্লাসে ওঠা, মেয়েদের সামনে নিজেকে স্মার্ট দেখানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা( কারণ কোন মেয়েই ঘুরেও দেখেনি) কিন্তু সেই  সময়ের ঝড়কে  ভালবাসার টান কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি। ঝড় উঠেছে, চারিদিকে ধূলোয় ধূলোময়, ধূলোটাও উঠছে চক্রাকারে উপরের দিকে  তারপর এদিক থেকে  ওদিক,  চার বন্ধু মিলে  সাইকেল  নিয়ে  ঝড়ের পরিক্রমায় বেরোনো। চোখে মুখে ঢুকছে ধূলো, হাঁ করছিনা কেউ মুখে ধূলো ঢুকে যাবে বলে। এদিকে ওদিকে  টিনের চালার টিন উড়ে গিয়ে ঘরকে করছে বেআব্রু, আর তারই মাঝে চার বন্ধু সাইকেল  চালিয়ে যাচ্ছে  ঝড়ের পরিক্রমায় । প্রায় তিন কিলোমিটার ঝড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে ক্লান্ত হয়ে স্টেশন সংলগ্ন দেবুদার দোকানে বসা এবং গরম বোঁদের সংহার--- সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা । আজকালকার ছেলেমেয়েরা  ক্যালরি নিয়ে চিন্তিত আর ঐ সময়ে সবাই বোঁদে এবং  যে দোকানের যা ভাল মিষ্টি তা চেখে চেখে বেড়াতাম এবং এখনও  পর্যন্ত  সেই রকম অসুস্থ না হয়েও চালিয়ে যাচ্ছি। আসলে ছোটবেলার চুরি করে আম যারা না খেয়েছে তারা সেরকম ডাকাবুকো  হতে পারেনি। ধীরে ধীরে  স্কুলের  গণ্ডি ছাড়িয়ে কলেজে ঢোকা মানে পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে  ডেঁপোমি করা কিন্তু  আশ্চর্যের ব্যাপার যে এই চারজনই  কেউ না খেল সিগারেট  বা কেউ  দিল না ইতিউতি উঁকি । ঝড় এদের জীবনে সামান্যতম রেখাপাত ও করতে পারল না। কলেজ  পেরিয়ে কেউ বা চাকরি, কেউ বা ব্যবসা আবার কেউ বা চলে গেল  উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে । দীর্ঘ দিন ছাড়াছাড়ি কিন্তু মনটা যেন কেমন টনটন করে ওঠে বন্ধুদের জন্য, হাঁকপাঁক করে ওঠে  শৈশবে ফিরে  যেতে,  সেই সাইকেল নিয়ে ঝড়ের মধ্যে দিশাহীন  হয়ে ঘুরতে শুধু ঝড়কে উপভোগ  করার জন্য।

এখন সবাই জীবনের  শেষ প্রান্তে উপনীত। এখনও  ঝড় আসে তবে সেই ঝড়কে উপভোগ  করার প্রথাটাও গেছে পালটে। আকাশটা কালো হয়ে এসেছে, মুখ তার ভার, মাঝে মাঝে  দমকা হাওয়ায় জানলা দরজাগুলো দড়াম দড়াম করে পড়ছে ছিটকিনি  না লাগানোর  জন্য, পাখিগুলো হঠাৎই  ঝটপটিয়ে  উড়তে শুরু  করল নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় কিন্তু এলোমেলো হাওয়ায় গন্তব্যস্থল  বদলে যাচ্ছে  কিন্তু তাদের পৌঁছতেই  হবে নির্দিষ্ট  বাসস্থানে যেখানে তার বাচ্চারা রয়েছে । সব জীবজন্তুর ই তার বাচ্চাদের  প্রতি যে স্নেহ তা বোঝা যায় প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে, যেমন প্রকৃত বন্ধু বিপদের সময়ই বোঝা যায়। বাড়িতে শুধু বুড়োবুড়ি। জানলা দরজাগুলো  ভাল করে লাগিয়ে ব্যালকনির  শাটার টেনে দিয়ে  ঝড়কে করছে উপভোগ । এক সময় যখন ছিল বেপরোয়া মনোভাব  আজ তা অনেক স্তিমিত  কিন্তু ঝড়কে উপভোগ করার লোভটা যায়নি। সব জানলা দরজা লাগিয়ে ঝড়কে আমি করব মিতে,  ডরব না তার ভ্রূকুটিতে গান গাইতে  তো কোন আপত্তি নেই,  তাই নয়? 

Monday, 5 May 2025

কিছু কথা

অনেকদিন ধরেই মনটা একদম খাঁ খাঁ করছে। কিছু লিখব মনে হয়, নানান কথা মনে আসে, মনে পড়ায় আমাদের কথা এবার বল , অনেক স্তোকবাক্য দিয়ে তো চালালে, এরপরে নিশ্চয়ই আসবে আমাদের কথা কিন্তু নানা বাহানায় বন্ধ হয়ে যায় তোমার কলম । কখনো বাজারে যেতে হবে,  কখনো বা তোমার রিহার্সাল আবার কখনো বা  বন্ধুর  সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা।এই তো আসছে আবার ফোন, নিশ্চয়ই কোন  বন্ধুর  হবে। আচ্ছা,ঠিক আছে, কথা বলেই আমাদের একটু তুলে ধর‌দেখি। আচ্ছা ঠিক আছে,  কয়েকটা জরুরী ফোন অ্যাটেণ্ড করে বসলাম তাদের কথা তুলে ধরতে কিন্তু কাকে ছেড়ে কার কথা লিখি এই নিয়ে  একটু ধন্দে পড়ে গেলাম। যার কথা লিখব না তারই মুখ  ভার। সবাইকে একটু ঠাণ্ডা করে বসলাম ব্যালকনিতে ফুল এবং পাখিদের কথা লেখার জন্য ।

ব্যালকনির টবে এখন নানারকম ফুল। গোলাপ, জবা ও বেলফুলে ভরে আছে। এ ছাড়াও রয়েছে একটা নাম না জানা ঝাঁকরা গাছে ছোট ছোট সাদা রঙের ফুল অনেকটা চন্দ্রমল্লিকার মতো। গোলাপ ও বাহারিরঙের লাল ও হলুদ আর জবাও যায় কম কিসে?  সেও লাল, কমলা ও হলুদ রঙে নানাভাবে  নিজেদের বিকশিত করে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে। কিন্তু ভোরবেলায় স্লাইডিং শাটার খুলতেই হাল্কা মিষ্টি গন্ধে মন মাতিয়ে দেয় বেলফুলের মিষ্টি গন্ধ। মৌমাছিরা গুনগুন করে একবার এই ফুলে আরেকবার ঐ ফুলে নেচে নেচে মধু খেয়ে যাচ্ছে। আশ্চর্য হয়ে যাই যে এই নিরাভরণেও এত আকৃষ্ট করা যায়!  আশেপাশে সব সময়ই দেখি  কি করে ঝাঁ‌ চকচকে পোশাকে অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায় , কিন্তু  সাধারণ পোশাকে নিজের আচার ব্যবহারে যে অন্যকে আকর্ষিত করা যায় তা তো আর অস্বীকার করা যায়না  কিন্তু সেটা প্রথম দর্শনেই ধরা পড়ে না। অনেকদিন ধরে দেখতে দেখতে তা নজরে আসে। একটা কথা আছে না, খারাপ খবর খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে কিন্তু ভাল কোন খবর তা ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়।

কাকে বেশী পছন্দ?  বাহারে গোলাপ বা জবা না গন্ধময় নিরাভরণ সাদা বেলফুল বা ঝাঁকড়া গাছে পাতার ফাঁকে উঁকি দেওয়া সেই ছোট্ট সাদা ফুল?  জবাব নিজের  নিজের পছন্দের কাছে।

Wednesday, 12 February 2025

বাড়ির নাম "ওয়েলকাম"

বলরামপুর  স্টেশন টা তখনো পুরোপুরি স্টেশনের মর্যাদা পায়নি। আশপাশের অনেক গ্রাম থেকে লোকজন এখানকার হাটে আসত। বেশ বড় মাপের হাট, আনাজপত্র থেকে গরু ছাগল ও এই হাটে আসত বেচাকেনার জন্য।  তখন অতশত লরি, ভ্যানের চল ছিলনা,  ভরসা ছিল গরুর গাড়ি ও সাইকেল রিক্সা এবং  রিক্সা ভ্যান। তবে এঁটেল মাটি বৃষ্টিতে এত কাদা হতো যে রিক্সা ভ্যানের কম্মো ছিলনা বর্ষায়  চলা। অতএব তাগড়া বলদ বা মোষ জুতে চলতে হতো বেশী জিনিসপত্র আনার হলে। কিন্তু হাটের দিন  ছিল জমজমাট । সপ্তাহে দুদিন বসে হাট,  দূরদূরান্ত থেকেও লোকজন আসত এই হাটে, সুতরাং লোকজনের অনেকদিনের দাবি ছিল এখানে ট্রেন থামুক। তখন তো এত গ্রাম পঞ্চায়েত বা পঞ্চায়েত সমিতি বা জেলা পরিষদ ছিলনা , ছিলেন বিধানসভার সদস্য এবং  লোকসভার সদস্য যাঁদের দেখা পাওয়া প্রায় ভগবানের দেখা পাওয়ার সামিল। এঁরা নিজেরা কোন অসুবিধায় না পড়লে বা নিজেদের কোন প্রয়োজন না থাকলে ভুলেও  এই পথ মাড়াতেন না। একবার ভোটের প্রচারে এসে গাড়ি নিয়ে গাঁয়ের কাদা রাস্তায় আটকে পড়ে বাধ্য হয়েছিলেন আশ্রয় নিতে গ্রামের ই এক বর্ধিষ্ণু পরিবারে। তাঁরা কিন্তু যথেষ্ট সমাদর করেছিলেন এবং  আলাপচারিতায় গ্রামের ও আশপাশের গ্রামের  লোকের অসুবিধার কথা জানিয়েছিলেন । আর সেই জনপ্রতিনিধির উদ্যোগে হলো বলরামপুর  হল্ট।হাওড়া থেকে ধুলিয়ানগামী ট্রেনের পথে পড়ে এই বলরামপুর । প্যাসেঞ্জার ট্রেন  এখানে থামত। ধীরে ধীরে লোকজন ওঠানামা বেড়ে যাওয়ায় ইনি পেলেন স্টেশনের  মর্যাদা । পর্যায়ক্রমে গ্রামের কাঁচা রাস্তা  হলো পাকা,এখন সেখানে বাস ও মিনিবাস চলছে আর চলছে একটু উঠতি বয়সের ছেলেদের মোটরসাইকেল নিয়ে  দাপাদাপি । স্টেশন থেকে রিক্সায় তিন মাইল দূরে  সেই "ওয়েলকাম"বাড়ি। তখন এদিকে ওদিকে শয়ে শয়ে কাঁচা বাড়ির  মধ্যে ঐ বাড়িটা ছিল জমাটবাঁধা অন্ধকারে লাইট জ্বলা বাড়ি।সুন্দর পাঁচিল দেওয়া গেট ওয়ালা বাড়ি, গেট থেকে বাড়ির দূরত্ব প্রায় একশ ফুট এবং গেটের দুই পাশেও প্রায় একশ ফুট করে সুন্দর পাঁচিল। মাঠ ছেড়ে বাড়িতে ঢুকতে গেলে চড়তে হয় চারটে সিঁড়ি  যার দৈর্ঘ্য পনের ফুট এবং  সি়ঁড়ির দুই প্রান্তে দুটো রোয়াক যেখানে একজন লোক মোটামুটি ভাবে শুতে পারে। বাড়ির মালিক বুড়োবাবু ঐ রকে  আধশোয়া হয়ে  চুরুট খেতেন এবং মাঝে মাঝে শেক্সপিয়ার, মিল্টন বা কীটস বা শেলীর  কবিতা আবৃত্তি করতেন। বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়া আসা করা লোকজন তত শিক্ষিত  না হওয়ায় হাঁ করে অবাক হয়ে চলে যেত  এবং পারতপক্ষে বুড়োবাবুর মুখোমুখি  হতো না। কেমন যেন  একটা দূরত্ব বজায়  থাকলেই বেশ খানিকটা  নিশ্চিন্তে থাকতো তারা । এই বাড়ি কিন্তু কোন জমিদার বা ছোটখাটো রাজার বাড়ি নয় তবে বুড়ো বাবু ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী এবং  তাঁর বাবা ছিলেন জজসাহেব । এখন যদিও জজদের সম্মান বহুলাংশেই ক্ষয়িষ্ণু ( ওঁরা নিজেরাই অনেকখানি দায়ী) কিন্তু সেই  সময়ে জজসাহেব বা সরকারী কর্মচারীদের ছিল প্রভূত সম্মান । তাঁরা সর্বসমক্ষে আসতেন ভীষণ কম এবং তাঁদের কাজ কর্ম বেশীরভাগ সময়ে চাপরাশিরা করত এবং গেটে থাকা দারোয়ান কাউকে ভিতরে ঢুকতে দিত না কোন সদুত্তর না পেলে।বাড়ির বারান্দায় ছিল জাফরি এবং  তার মধ্যেই  লেখা শব্দ ই ইংরেজিতে" ওয়েলকাম ।" বারান্দার আলোটা জ্বললেই সেই আলো জাফরির ছিদ্র দিয়ে অতিথিদের আপ্যায়ন করত। কিন্তু সেই বাড়িতে তো সাধারণ মানুষ আসতো ই না, তাহলে কাদের জন্য এই "ওয়েলকাম?" মনে হয় যে সমস্ত হোমরা চোমরা লোকজন আসতেন তাঁদের ই অভ্যর্থনা জানানো হতো। বাঁদিকে ছিল বড় বৈঠকখানা যা পরবর্তীকালে বাইরের ঘর বলে‌ পরিচিত ছিল। এক সময় ঝাড়লণ্ঠনের আলোয় আলোকময় হয়ে উঠত সেই  বৈঠকখানা কিন্তু কালের গতিতে বিদায় নিয়েছে ঝাড়লণ্ঠন, এসেছে ইলেকট্রিক বালব কিন্তু বালবের শেডগুলো ছিল দারুণ সুন্দর যা এক সুন্দর রুচির বাহক । তবে ঐ সময়েও গ্রামের  বেশীরভাগ জায়গা যখন অন্ধকারে ডুবে থাকত সেই সময়ে ঐ বাড়িতে বিদ্যুতের আলো যেন দম্ভ প্রকাশ করত। বড় বাড়ি, একান্নবর্তী পরিবার , সবার ছেলেমেয়ে নিয়ে  যেন একটা ছোট খাটো গ্রাম । বৈঠকখানা হয়েছে বাইরের ঘর যেখানে সমস্ত ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা,  নানারকম পড়ার আওয়াজে কিরকম একটা অনুরণন হতো আর দূর থেকে  অচেনা লোকদের  একটা পাঠশালা বলেই ভ্রম হতো। একসময়  বাড়ির দুর্গাপূজো কখন যেন বন্ধ হয়ে গেল কিন্তু বাড়ির পূজো ধীরে ধীরে বারোয়ারি পূজোয় পরিণত হলো। প্রতিমার আদল ও পাল্টে গেল ।বুড়োবাবুর বংশধররা  কাজের সূত্রে এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল এবং তাঁর উত্তরাধিকারীরা অত বড় সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণে অসমর্থ হয়ে বাড়ি বিক্রি করে দিল ।

দীর্ঘ দিন পর বুড়ো বাবুর নাতি এসেছেন সুদূর আমেরিকা থেকে,  থাকবেন কিছুদিন । হঠাৎই মনে হলো পরিবারকে নিয়ে বলরামপুর যাবেন এবং দেখবেন  তাঁর  শৈশবকাল  যেখানে কেটেছে সেটা কেমন আছে এবং স্ত্রীও ছেলেমেয়েদের দেখাবেন। যেমন মনে করা, তেমনই কাজ। গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন বলরামপুরের উদ্দেশ্যে । মাঝপথে একবার নবদ্বীপে থেমে চা খেয়ে রওনা দিলেন তাঁর ছোটবেলার শহরের দিকে। কিছুই  চিনতে পারছেন না জায়গা এতটাই বদলে গেছে। একে তাকে জিজ্ঞেস করে পৌঁছলেন তাঁদের বাড়ির কাছে। প্রোমোটারের থাবা পড়েছে এখানে। বাড়ি ভাঙার কাজ চলছে । অনেকটাই ভাঙা হয়ে গেছে । সুদৃশ্য গাড়ি এবং তার আরোহীদের  দেখে প্রোমোটারের লোকজন ছুটে  এল নতুন কোন কাস্টমার ভেবে। উনি এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে দেখছেন। সুপারভাইজার মোবাইলে খবর পাঠিয়ে দিয়েছে তার মালিককে এবং  তিনিও এসে পড়েছেন নতুন বুকিং এর আশায়। খুব নম্র ও বিনীতভাবে  তাঁদের আমন্ত্রণ জানালেন  অফিসঘরে বসার জন্য।  ছেলেমেয়ে এবং স্ত্রী একটু অধৈর্য‌্য হয়ে পড়েছে ফিরে যাওয়ার জন্য। ভদ্রতার খাতিরে একবার অফিস ঘরে বসলেন যেটা আগে ছিল বৈঠকখানা বা বাইরের  ঘর, কেবল একটাই তফাত এটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এবং  অনেক  ঝকঝকে। অফিস ঘরের বাইরে একটা জায়গায় জাফরিতে লেখা "ওয়েলকাম" টা চোখে পড়ল। একটু বিস্মিত  হয়েই জিজ্ঞেস করলেন  এটা এখানে কেন? স্যার,  আমাদের এই প্রজেক্টের নাম দিয়েছি "ওয়েলকাম" আর এই বলে একটা ব্রোশিওর ধরিয়ে দিল। এই বাড়ির মাঠে আমরা বহু খেলাধূলো করেছি আর পূজো ও করেছি, এর স্মৃতি আমার মনে এখন ও জ্বলজ্বল করছে। "ওয়েলকাম" নামটা আমার বড় ই প্রিয়, তাই আমার এই প্রজেক্টের নাম ওইরকম দিয়েছি স্যার । কানে যেন কেউ গরম সীসা ঢেলে দিল, মাথাটা হেঁট হয়ে গেল এই ভেবে যে একটা অনেক উচ্চতায় উঠেও যারা পূর্বস্মৃতিকে ধরে রাখার চেষ্টা ও করেনা অথচ এই অল্পশিক্ষিত প্রোমোটার তার শৈশবের  স্মৃতিকে সম্মান দিয়ে আমার প্রপিতামহের  সেন্টিমেন্টের দাম দিচ্ছে। চোখের পাতাটা ভিজে আসছে, কোনরকমে তা সামাল দিয়ে গাড়ির দিকে রওনা দিল।

Monday, 10 February 2025

যেথা যাহা পাও কুড়াইয়া লও সুখের তরে

"যেথা যাহা পাও কুড়াইয়া লও সুখের তরে" কথাটা শুনতে বেশ লাগে কিন্তু যদি কিছু আসে অনৈতিক উপায়ে এবং সেটা যদি সুখ আনে, সেটাও কি নেওয়া উচিত ? এই বিষয়ে মতামত ভিন্ন রকমের। কিছু লোক আছেন যাঁরা সামান্যতম অনৈতিক রাস্তাকে এড়িয়ে চলেন তাঁরা এই কথার তীব্র প্রতিবাদ করবেন কিন্তু বহু লোক আছেন যাঁরা সুখের সন্ধানে যে কোনরকম কাজ করতে প্রস্তুত। প্রথম পক্ষ সংখ্যায় খুবই নগণ্য এবং  দ্বিতীয় পক্ষ দলে বেশ ভারী এবং  অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে  পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত  নেওয়া  উচিত কারণ একবার অনৈতিক  পথে গেলে  একেবারে কানাগলির মধ্যে ঢুকে পড়ার সামিল, ফেরার রাস্তা বন্ধ।

সুখ কি, কত রকমের সুখ আছে এইসব নিয়ে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে আকাশে কটা তারা আছে এই নিয়ে কেউ যেন প্রশ্ন করছে।সুখ কি এটা বলা ভীষণ কঠিন । বিরাট বড়লোক, অনেক টাকা পয়সা গাড়ি বাড়ি চাকর বাকর,  দারোয়ান ঢুকতে বেরোতে সেলাম ঠোকে কিন্তু নরম গদিতে শুয়েও তার দুটো চোখের পাতা এক করতে পারেনা অথচ ফুটপাতে থাকা অভুক্ত, অর্ধভুক্ত লোকেরা তার সম্বলের ছেঁড়া মাদুরের ওপর শুয়েই মরার মতন ঘুমায়। সুতরাং টাকা পয়সাই সুখের মানদণ্ড হতে পারেনা। কেউ জ্ঞান পিপাসু, বইয়ের মধ্যে ডুবে থেকেই ঘোর মগ্ন হয়ে থাকেন বা কেউ চিত্রকর তাঁর শিল্পকীর্তির মধ্যেই ডুবে থাকেন বা কোন সঙ্গীত  শিল্পী তাঁর সুরের সাগরে নিমজ্জিত থাকেন।কেউ ভগবানের চিন্তায় মগ্ন থাকতে ভালবাসেন আবার কেউবা পরোপকারে নিজেকে ব্যস্ত রেখে সুখ পান আবার কেউ চৌর্য্য বৃত্তিতে খুশী থাকেন । সুতরাং,  এক একজনের কাছে সুখের সংজ্ঞা এক একরকম। সুতরাং কিসে যে সুখ মিলবে একথা কেউ জোর গলায় বলতে পারবে না। একই বই সবাই পড়লেও বিভিন্ন জনের উপলব্ধি বিভিন্ন রকম ।
জন্ম ইস্তক আমরা সবাই ছুটছি কিন্তু দিশা সবার ভিন্ন। তবে সুখ পাওয়ার একটা মোটামুটি শর্টকাট রাস্তা হচ্ছে যে জ্ঞানত কারও কোন ক্ষতি করা বা ক্ষতির চিন্তা করায় বিরত থাকলে অনেকটাই আনন্দ পাওয়া যায়। পরনিন্দা বা পরশ্রীকাতরতা থেকে যদি নিজেকে দূরে রাখা যায় তাহলেও  অনেক মানসিক শান্তি বজায় থাকে। মানুষের বড় হওয়ার উপর অনেকটাই নির্ভর করে মানসিক গঠন এবং  সে কিভাবে সুখের সন্ধানে নিজেকে ব্যাপৃত করবে তা ও নির্ভর করে সেই মানসিক গঠনের উপর।

কেউ একাকীত্ব পছন্দ করে আবার কেউ লোকজনের সংসর্গ ভালবাসে। অনেকেই বলে যে ও একদম লোকের সঙ্গে মিশতে পারেনা। মনের দরজা খুলে বাইরে না বেরোলে একাকীত্ব কাটবে কি করে? গতকাল কয়েকটা সত্তরোর্ধ্ব একই স্কুলে পড়া  বুড়ো(কিন্তু মনে মনে যুবক) তাদের বুড়িদের নিয়ে যেরকম হৈচৈ করল তাতে আশপাশের  লোকজন একটু শঙ্কিত ই হয়ে উঠেছিল আর ভাবছিল এরা সবাই প্রকৃতিস্থ আছে তো? বুড়োগুলো সবাই স্বকীয়তায় মহীয়ান কিন্তু তারা ফিরে গেছিল তাদের স্কুল জীবনে পুরনো দিনের স্মৃতিচারণায়। কোন স্যার কিভাবে পড়াতেন, তাঁদের মুদ্রাদোষ নিয়ে আলোচনা, বেঞ্চের উপর দাঁড়ানো, টিফিন চুরি, অন্যের ব্যাগ দিয়ে চেয়ার মুছে নেওয়া, লিখতে লিখতে ফাউন্টেন পেনের কালি শেষ হয়ে গেলে পাশের বন্ধুর কাছ থেকে দুফোঁটা কালি নিয়ে আবার  লেখা শুরু করা, পরীক্ষার  সময়ে বাথরুম গিয়ে কারো কাছ থেকে কোন অজানা প্রশ্নের  উত্তর জেনে নেওয়া  বা ট্যারা স্যারের পরীক্ষায় গার্ড দেওয়ার পদ্ধতি নিয়ে হাসাহাসিতে ওই বন্ধুরাই শুধু নয়,তাদের বুড়িরা এবং  আশপাশের লোকজন সবাই হাঁ করে শুনছিল তাদের কথা। আরও একজন তাদের স্কুলের সহপাঠী শুনেই বলল তোরা লাঞ্চ টা শুরু কর ঘন্টা দুয়েক বাদে কারণ ও তখন তার স্ত্রীকে হাসপাতালে ভর্তি করছিল,  পরদিন তার অপারেশন হওয়ার কথা । এইরকম অনাবিল আনন্দের স্বাদ কজন নিতে পারে? স্ট্যাম্প কালেকশন এবং বদলা বদলি করা বা স্কুলের  টিফিনের সময় পাশেই থাকা মেয়েদের স্কুলের দিকে একটা চক্কর মেরে আসা বা লরি বোঝাই আখের মধ্যে থেকে একটা আখ টেনে বার করার কি টেকনিক তা নিয়ে ও যথেষ্ট আলোচনায় সবাই  মশগুল ।হয়তো আশপাশের লোকজন ভাবছিল যে খুশীতে  বুড়োগুলো পাগল হয়ে গেছে । বেঙ্গল হাটারিতে লাঞ্চ সেরে এবং  সেখানকার কর্ণধার  পার্থ ঘোষাল এবং  তাঁর পুরো টিমের সহযোগীতায় এই বুড়োবুড়িদের দল তাঁদের শৈশবে ফিরে গেছিল । সেখানে একপ্রস্থ হৈচৈ করে পরের গন্তব্যস্থল যতীন দাস রোডের উদিপীতে কফি খাওয়া। ওখানকার কফি একটা আলাদা মাত্রা আনে স্বাদে।ওখানকার একটা বিশেষ  জায়গা ছয়টি সরু দেবদারু গাছের একটা শেড যেখানে সচরাচর জায়গাই মেলেনা সেইখানে ভগবানের বিশেষ দয়ায় মিলল ঠাঁই এবং  সেখানেও  ঘন্টা দুয়েক আড্ডা বুড়োবুড়িদের একটু বাড়তি অক্সিজেন যোগাল। সবাই এই জায়গায় বসার অপেক্ষায় থাকে এবং এই বুড়ো খোকাখুকিরা গাড়িতে ওঠামাত্র জায়গাটা ভরে গেল নতুন  দলের দ্বারা ।
এই ধরণের আনন্দ বা খুশী খু়ঁজতে কোন অনৈতিক কাজের প্রয়োজন পড়েনা এবং বন্ধুদের সাহচর্য জীবনে এক আলাদা মাত্রা যোগ করে। মানুষ হয়ে যখন জন্ম হয়েছে তখন একদিন তার পরিসমাপ্তি হবেই কিন্তু এই স্বল্প দিনের মেয়াদে কে কতটা সুখের  ঝুলি ভরতে পারে সেটাই দেখার ।

Tuesday, 4 February 2025

বিদায় গোকুল বিদায়

বেশ কাক ভোরে মোবাইল বেজে ওঠায় একটু ভয় পেয়েই গেলাম। কি রে বাবা, এত সকালে কে ডাকে আমায়। একটু ভয় ভয় করেই মোবাইলটা ধরতেই একটা চাপা কান্নায় বুঝলাম কিছু একটা অঘটন ঘটেছে। ঘুম জড়ানো চোখে হ্যালো বলে জিজ্ঞেস করতেই একটা অচেনা মেয়েলি কণ্ঠে কান্নামিশ্রিত গলার আওয়াজ পেলাম এবং গিন্নিকে সঁপে দিলাম । দু মিনিট বাদেই জানলাম যে আমাদের কাজের দিদির স্বামী দেহ রেখেছেন।

মূহুর্তের মধ্যে দিদির মুখটা ভেসে উঠল। বহুদিন ধরে আমাদের বাড়িতে কাজ করছে । দেখতে দেখতে  বত্রিশ বছর কি ভাবে কেটে গেছে কেউ বুঝতেই পারিনি । তখন আমাদের ও বয়স কম, দিদিও ছিল যথেষ্ট ছোট,  চরকির মতো ঘুরে ঘুরে কাজ করতো এবং বয়স কম থাকায়  একাই সমস্ত কাজ সামলে দিত মায় দূরে পার্কের পাশে থাকা টিউব ওয়েল থেকে খাবার জল আনা পর্যন্ত। বাড়িতে সব সময়ই কোন না কোন লোক আসতো কিন্তু দিদির মুখ কখনও ভার দেখিনি। ভীষণ বিশ্বাসী যেটা আজকের দিনে অত্যন্ত বিরল। আমি তো পরিবারকে এখানে রেখে এখানে সেখানে ট্রান্সফার হতাম কিন্তু ভরসা ছিল ঐ বিশ্বাসী ও কর্মঠ দিদির উপর। অনেক সময় নিজে অসুস্থ হয়ে পড়েছি এবং মিসেস কে আমার কাছে  আসতে হয়েছে কিন্তু  দিদি সামলে দিয়েছে ঐ বিপদের দিনে। শুধু দিদিই নয়, তার স্বামী গোকুল ও পাশে এসে দাঁড়িয়েছে । মানে এক কথায়  পরিবারের একজন হয়েই পাশে থেকেছে।  কখনও সখনও ওর স্বামী বাড়ির বাইরের কাজ করে দিয়েছে। একদম জানতেই পারিনি যে কখন আমাদের পরিবারের একজন সদস্য তারা হয়ে গেছে । আজ আমার এক সহকর্মীর শ্রাদ্ধ ছিল আর এই দিনেই আমাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ একজন চলে গেল । মাঝখানে কয়েকটা মাস করোনার জন্য ও আমাদের সঙ্গে  ছিলনা কিন্তু  সেই  সময়েও আমাদের আর্থিক সাহায্য অব্যাহত ছিল একজন পরিবারের সদস্য হিসেবে যতখানি করা সম্ভব ততটাই করেছি। বত্রিশ বছরে দিদিও একটু কাহিল হয়ে গেছে এবং তাকে সাহায্য করতে আরও একজন এসে গেছে  নয় নয় করে বছর বারো। গোকুলকে আমাদের এলাকায় কিছু কিছু কাজ জুটিয়ে দিতে পেরেছিলাম কিন্তু সেই দূর প্রান্ত থেকে  এসে কাজ তার ধরে রাখতে পারেনি। 

দিদি একটু চুপচাপ ধরণের ছিল। অন্য বাড়িতে কাজ করলেও কখনও কথা চালাচালির মধ্যে তাকে থাকতে দেখিনি । ওদের মধ্যে এইধরণের চরিত্র মেলা ভার । সব সময়ই একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালবাসতো এবং চেহারায় একটা লক্ষ্মী শ্রী ছিল। একটু আগেই ওরা গোকুলের সৎকার করে ফিরল। দিদির পুত্রবধূ ফোন করে দিদিকে দিল কথা বলার জন্য আর দিদি হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল আর বলতে লাগল , " বৌদি, আমি তোমাদের বাড়ির কাজটা করব আর কোনও বাড়িতে না করলেও।" তোমাকে কাজ ছাড়তে হবেনা, যতদিন তুমি পারবে আমাদের পরিবারের একজন হয়ে থেকো  আর মনটাকে শান্ত কর এই ভেবে যে তোমার স্বামী অনেকদিন ধরে কষ্ট পাচ্ছিল , সেটা দেখেই ভগবান তাকে তাঁর কাছে টেনে নিয়েছেন। কিছু দরকার হলে আমাদের  জানিও। 
কিছু মানুষ আছে যারা হাজার  কষ্ট হলেও সততার পথ ছাড়েনা এবং তাদের মর্যাদা বোধ এতটাই বেশি  যে তারা বিনা শ্রমে কারও কাছে  বিন্দুমাত্র সাহায্য নেবেনা। এঁদের অবশ্যই সম্মান করা উচিত এবং  অনেক পয়সাওয়ালা লোকদের চেয়ে হাজার গুণ ভাল। আমাদের রাজনীতিবিদদের দেখলে ঘৃণা বোধ হয় কিন্তু হাজার  অসৎ হলেও তাদেরই দ্বারস্থ হতে হয়। সততার সম্মান  আমরা খুব  কম ই দিই। আমরা ঐ অসৎ ব্যক্তিদের মাথায় তুলে রাখি , খানিকটা ভয়ে ভক্তির মতন। গোকুল চলে গেল আর দিদিকে বেশ খানিকটা ধাক্কা দিয়ে গেল। এদের অল্প বয়সে বিয়ে হয় এবং এই দীর্ঘ দিনের সম্পর্কের আজ শেষ হলো। 

Thursday, 30 January 2025

অথ বিবাহ কথা

বহুদিন পর এক ধমাকাদার বিয়ের সাক্ষী হতে পারলাম । বড় শিল্পপতিদের ছেলেমেয়ের বিয়েতে আমাদের মতন উলুখাগড়াদের ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে থাকা ছাড়া আর খবরের কাগজ বা দূরদর্শনের বিভিন্ন চ্যানেলের প্রতিযোগিতামূলক প্রদর্শনের কল্যাণে খুঁটিনাটি খবরের বিশদ বিবরণ জানা ছাড়া আর কিছুই করার  থাকেনা। যে যেমন ওজনদার, তার তেমন সমারোহ। রাজারাজড়ার ঘরের বিয়ে আমাদের মতন আমজনতার মধ্যেও একটা আনন্দের রেশ জাগিয়ে তোলে যদিও  তা সাময়িক। একজন শিল্পপতির ছেলের সঙ্গে আর এক শিল্পপতির মেয়ের  বিয়ে হলো, সারা পৃথিবীর তাবড় তাবড় নেতা মন্ত্রীর সমাগম হলো, কোটি কোটি টাকা কেমন ভুস করে উড়ে‌গেল-- অবশ্যই এক পকেট থেকে আর এক পকেটে আর আমজনতা বলতে লাগল, " কেয়া বাত হ্যায়,  শাদী হো তো অ্যায়সা''। আমরা আদার ব্যাপারী, জাহাজের খবরে কি দরকার?  না, তা ঠিক নয়, ছোটখাটো ব্যাবসাদার যদি নিষ্ঠার সঙ্গে ব্যাবসা করতে পারে তাহলে তার ভাগ্যেও শিকে ছিঁড়তে পারে। যেমন  যে পান বানায় খুব  সুন্দর,  সে পানের‌ বরাত পেতে পারে বা কেউ ভাল ঢোল বাজালে সেও ডাক পেতে পারে।

বিয়ে মানে তো একটা ছেলের  সঙ্গে  একটা মেয়ের  বিয়ে নয়, একটা পরিবারের সঙ্গে আর একটা পরিবারের মেলবন্ধন। বিয়ের ব্যাপারটা আজকাল বেশ আধুনিক  হয়ে গেছে। আগে ঘটকদের মাধ্যমে বিয়ের যোগাযোগ হতো। অমুক ঘটকের খুব নাম ডাক, ওর কাছে গেলেই বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাওয়া ছেলেমেয়েদের বিয়ে হবেই হবে। তখন কম্পিউটার না থাকলেও জাবদা খাতায়  ঠিকুজি কুলজি সব থাকত এবং  ঐ ঘটক মশাইরা যেন এক একজন জীবন্ত কম্পিউটার । তাঁর দক্ষিণা তো নাম রেজিস্ট্রেশনের সময় দিতেই হতো , এছাড়া বিয়ে হলে তাঁর  সাম্মানিক দক্ষিনাও বেশ ভাল রকম হতো যার নাম ছিল  ঘটকবিদায়। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে  ঘটকমশাইএর জায়গা নিয়েছে বিভিন্ন ম্যাট্রিমোনিয়াল । সেখানেও নাম রেজিস্ট্রি করতে হয় একটা বাঁধা সময়ের জন্য এবং এই ব্যবসাও বেশ রমরমিয়ে চলছে। আত্মীয় স্বজনের সূত্রে সম্বন্ধ এলে পাত্র পাত্রীদের সম্বন্ধে অনেক  খবর জানা যেত। চলতি কথা ছিল  উঠতি ঘরের ছেলে এবং পড়তি ঘরের মেয়ের সম্বন্ধে খোঁজ পড়ত বেশী, বড় জোর সমানে সমানে । পুরুষ শাসিত সমাজে ছেলের বাড়ির  কথাই বেশী  প্রাধান্য পাবে কিন্তু সেটা বিয়ে হওয়া ইস্তক, তার পরেই ছেলের বাবা মা বা কাকা, পিসিরা সব ব্রাত্য, তার জায়গা নেয় মেয়ের বাড়ির লোকজন  মানে মেয়ের বাবা, মা এবং মাসি বা মামারা। সুতরাং,  ঘটের বুদ্ধি একটু খরচ করলেই  সম্পর্কটা বেশ টিকিয়ে রাখা যায়।  বেশী বেগড়বাঁই করলে সম্পর্ক ফুটুস। ম্যাট্রিমোনিয়ালের মাধ্যমে যে সম্পর্কগুলো আসে সেগুলো যথেষ্ট  সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা করতে হয় নাহলে পরে ম্যাট্রিমনি সংস্থাকে দোষ. দিয়েও বিশেষ লাভ হবেনা আর তা ছাড়া তারা দায়িত্ব নেবেই বা কেন? ওরা সমস্ত‌ দেওয়া তথ্য পরীক্ষা করে কিনা জানা নেই । তথ্য পরীক্ষা করার জন্য আলাদা সংস্থা আছে এবং তাদের সার্ভিস পেতে গেলে গাঁটের কড়ি খরচ করতে হবে । বাবা মায়ের অনেক কষ্ট লাঘব হয়ে যায় যদি ছেলে মেয়েরা নিজেদের জীবন সঙ্গী বা সঙ্গিনী বেছে নেয়। তারা অনেক দিন ধরে মেলামেশা করার ফলে বুঝতে পারে যে নিজের পছন্দের সঙ্গে কতটা মিলছে এবং  সেই হিসাবে নিজেদের জীবন সঙ্গী  বা সঙ্গিনী বেছে  নেয় । কিন্তু এ সত্ত্বেও কি সব কিছু ঠিকঠাক চলছে? না, এতেও মাঝে মধ্যে চলার পথে কিছু বাধা আসে যার অনিবার্য পরিণতি বিচ্ছেদ । খুবই দুঃখের কথা, কিন্তু বাস্তবে ঘটছে ও তাই। ছেলে, মেয়ে দুজনেই যথেষ্ট  শিক্ষিত এবং  তাদের  দুজনের  ক্যারিয়ারের গ্রাফ ই ঊর্ধমুখী কিন্তু কোন  কারণে তাদের  একই শহরে পোস্টিং না হলে দীর্ঘদিন আলাদা থাকতে হয় যার ফলে মানসিক অবসাদে ভুগতে হয় এবং  একটা স্টেজ পরে সেটা বিচ্ছিন্নতার পথে ঠেলে দেয়। এই সময় কাউকে না কাউকে একটু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। আজকাল সবার ই নিউক্লিয়ার  ফ্যামিলি । সুতরাং  ছেলে বা মেয়েরা তাদের  বাবা মায়ের  সাধ্যানুযায়ী যত্নে বেড়ে ওঠে এবং  বিয়ের  পর সেই মানে একটু ঘাটতি হলেই অসন্তোষ  ধীরে ধীরে পুঞ্জীভূত হতে থাকে এবং বিস্ফোরক অবস্থার দিকে এগোতে থাকে। এইসময় বাবামায়ের ভূমিকা  অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ করে মায়েদের। এইসময়  কাউন্সেলিং ভয়ানক ভাবে দরকার। কাউন্সেলিং এর পরেও যদি মানিয়ে নেওয়ার অবস্থায় না যাওয়া সম্ভব হয় তাহলে তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি  বিচ্ছেদ । এমন ও ঘটনা চোখে পড়ে যেখানে সন্তান হওয়ার  পরেও  বিচ্ছেদ  ঘটে যায় । অত্যন্ত মর্মান্তিক ঘটনা কিন্তু এর সাক্ষীও হতে হয়। আজকাল  যে কোন বিয়েই ভীষণ ব্যয়সাপেক্ষ । এত খরচ করেও যদি তার স্থায়িত্বে সন্দেহ থাকে তাহলে তাও রীতিমতো  বেদনাদায়ক ।
বিয়ে স্বভাবতঃই এক গাম্ভীর্যপূর্ণ অনুষ্ঠান । এই অনুষ্ঠানে  একটু হালকা মেজাজ আনার জন্য  ঠাকুমা দিদিমাদের এক বিরাট দায়িত্ব ছিল। নানারকম ছড়া বা কবিতা তাঁরা লিখতেন এবং পুস্তিকার আকারে তা প্রকাশ করা হতো।আইবুড়ো ভাত(অনূঢ় বা অনূঢ়া অবস্থায় ভাত খাওয়া) একটা খুব বড়সড় অনুষ্ঠান ছিল ।বিয়ের দিন সকাল বেলায় পাত্রর গায়ে হলুদ  হতো এবং  সেই  হলুদ বীর মুটের কড়ি সমেত পাত্রীর বাড়ি নিয়ে যাওয়া হতো এবং  তারপর পাত্রীর গায়ে হলুদ  হতো। এরপর আর পাত্র বা পাত্রীর কোন খাবার জুটত না একটু আধটু সরবত ছাড়া ।এখন আর এত কষ্ট ছেলে মেয়েদের  দেওয়া হয়না। বিয়ের দিন দিদিমা ঠাকুমারা কিন্তু রীতিমতো নাচতেন,  এখন যেটা সঙ্গীতে হয়। এছাড়া নানারকম ছোটখাটো খেলাধূলোর মাধ্যমে এই গম্ভীর অনুষ্ঠান কে আরও কত প্রাণবন্ত করা যায় তার দিকে  খেয়াল রাখতেন। হোম এবং সপ্তপদী হিন্দুশাস্ত্রমতে বিয়ের  এক অঙ্গাঙ্গী অনুষ্ঠান  এবং  আজও তা পালন করা হয়।

সাম্প্রতিক কালে কয়েকটা বিয়েতে যোগ দিয়ে ভীষণ ভাল লাগল। দিল্লীতে তাজ হোটেলে দুই পরিবারের  একসঙ্গে থেকে বিয়ে বা জয়পুরের রাজবাড়িতে  বন্ধুর  ছেলের বিয়েতে চুটিয়ে আনন্দ করার প্রায় একবছর বাদে একটা ধমাকাদার বিয়ে হলো যেখানে আশপাশের লোকজন  সবাই মিলিতভাবে এত আনন্দ করলো যে কার বাড়ির বিয়ে প্রায় ভুলে যাবার ই দশা। ছেলের বাবা মায়ের তরফ থেকে  সমস্ত আত্মীয়স্বজনদের আগমন এবং পাড়া প্রতিবেশীদের সবার আন্তরিক  যোগদান একটা দারুণ আনন্দময় পরিস্থিতির  সৃষ্টি করেছিল ।  দিল্লী বা জয়পুরের  ডেস্টিনেশন ম্যারেজের মতন এবার ও চুটিয়ে আনন্দ করা হলো। আত্মীয় পরিজনদের সঙ্গে পাড়া প্রতিবেশীদের এই যোগদান একটা বিরল আনন্দের সৃষ্টি করেছে। সবার আশীর্বাদ ও শুভেচ্ছা  নিয়ে দাম্পত্য  জীবন শুরু হোক এই আমাদের  সবার প্রার্থনা। 

Monday, 13 January 2025

পৌষল্যা------তখন ও এখন

শীতের আমেজ শুরু হতেই পৌষল্যা বা বনভোজনের কথা মনে পড়ে এখন যার পোষাকি নাম বা ইংরেজিতে নাম পিকনিক। তখন ক্লাসের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়ে যেত ডিসেম্বর মাসে। নতুন বছরে নতুন ক্লাস শুরু হতো, পড়াশোনার চাপ নেই বললেই চলে, সুতরাং পৌষল্যা নিয়ে গজল্লা  বেশ রসিয়ে রসিয়ে চলত। কোথায় পৌষল্যা হবে সেটা নিয়েও তর্ক বিতর্ক বেশ জোরদার হতো এমন কি মতান্তর মনান্তরের পর্যায়েও চলে যেত। কিন্তু একটা কথা মানতেই হবে যে পৌষল্যা বা বনভোজন নিয়ে একটা ভালরকমের উন্মাদনা থাকত।
স্থান  নির্বাচনের ভার তিন চারজন ডাকাবুকোদের উপর থাকত যারা নিভৃত জায়গার সঙ্গে সঙ্গে খাওয়ার জলের ব্যবস্থা আছে এই কথাটা মাথায় রাখত। বন্ধু সার্কেল পাড়ার মধ্যে হলে সেরকম কিছু জাঁকজমক থাকত না কিন্তু ক্লাব স্তরে হলে বিভিন্ন পাড়ার ছেলেদের সমন্বয়ে বেশ বড়সড় বনভোজন বা পিকনিক হতো। সুতরাং  পৌষল্যা হচ্ছে ছোট স্তরে ( খেলার মধ্যে দুধভাত যেমন) এবং  বনভোজন বা পিকনিক হচ্ছে একটু বড় লেভেলে । যে কোন  খেলায় কাউকে দুধ ভাতে বলা হতো  যে একেবারেই ধর্তব্যের মধ্যে নয় অথচ তাকে বাদ ও দেওয়া যাবেনা।এটা একটা প্রেস্টিজ ইস্যু হয়ে যেত কারণ যাকে দুধভাতে রাখা হতো সে সবসময়ই মনে করত যে সে অন্যদের সমকক্ষ কিন্তু তার বন্ধুদের  চোখে বাচ্চা বা আনাড়ি। যাই হোক,  পৌষল্যা বা বনভোজন হতো সাধারণতঃ লোকালয়ের বাইরে কোন বড়সড় পুকুর বা বিলের পাড়ে কিংবা কোন বনের মাঝে কালিবাড়ির কাছে একটা বড়সড় গাছের নীচে যেখানে একটা চাদর বা বেডকভার  টাঙিয়ে  নেওয়া হতো এবং তার  নীচে রান্নার ব্যবস্থা করা হতো। খাবার জল কালীবাড়ির টিউব ওয়েল থেকে নেওয়া হতো এবং অন্য সব কিছু বিলের জলে করা হতো। রান্না সেরকম বিশেষ কিছু হতো না-- ভাত, ডাল, আলুভাজা বা বেগুন ভাজা, ফুলকপির তরকারি  ও ডিমের ঝোল এবং  শেষ পাতে একটু বোঁদে ও রসগোল্লা । মাংস করলে খরচাও বেশী যা বাচ্চাদের পক্ষে বাবা মায়ের কাছে  চাওয়া যেতনা এবং কেউ একটু বেশী পেল বা কম পেল তাই নিয়ে মন কষাকষির সম্ভাবনা থাকতো ।  সুতরাং মাংস বাদ আর কম খরচের মাংস বা চিকেন ছিল ই না তখন।  নিজেরাই জায়গা পরিষ্কার  করা,মশলা বাঁটা (তখন গুঁড়ো মশলার চল ছিলনা), গর্ত করে উনুন বানানো,চারদিকে গাছগাছড়া থাকায় কাঠের অভাব হতো না এবং  রান্নায় নুন কম বা ঝাল বেশী নিয়ে কেউ মাথাই ঘামাতো না। রান্নার বাসনকোসন কোন গরীব লোককে দিয়ে  মাজিয়ে নেওয়া হতো কিছু খাবার ও সামান্য পয়সার বিনিময়ে । দুর্দান্ত আনন্দ হতো এই পৌষল্যায়।  সাধারণত বাড়িতে আধখানা ডিম খাওয়া হতো কিন্তু এই পৌষল্যায় গোটা ডিম খাওয়া একটা বিরাট ব্যাপার। মোদ্দা কথা, অল্পতেই সন্তুষ্টি কারণ সেই সময় প্রত্যেক বাড়িতেই  পাঁচ সাতটা ছেলেমেয়ে নিয়ে কোন পিসি বা কাকা থাকায় প্রায়  দশজনের মুখে  খাবার জোগানো বড় সহজ ব্যাপার ছিলনা। নিজেরা সমস্ত কাজ করায়  আনন্দের মাত্রা ছিল আকাশ ছোঁয়া। 
ক্লাব স্তরে যখন পিকনিক হতো তখন আমরা নিতান্ত  ছোট হওয়ায় ক্লাবের দাদারাই সব মাথা এবং  ব্যবস্থাপনা তাদের ই। সকাল বেলায় স্নান করে ক্লাবে হাজির  হওয়া এবং লাইন দিয়ে মাড়োয়ারি বাগানে যাওয়া। ঐ বিশাল বাগানবাড়ির নাম কেন মাড়োয়ারি বাগান হয়েছিল তা জানিনা তবে পঞ্চানন তলা থেকে জঙ্গলের পথে আরও মাইলখানেক গেলে পড়ত সেই ফাটক ওয়ালা বিশাল বাগানবাড়ি। অনেকগুলো বাঁধানো পুকুর , নানা ফুল ফলের গাছে ভরা বিশাল বাগানের মধ্যে এক পোড়ো রাজবাড়ি যার আশে পাশে গেলেই গা ছমছম করতো। ভুটানদার ওপর ভার ছিল  আমাদের  সামলানো। আমার দেখা একজন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ভদ্রলোক  যাঁর হাতের ছড়ি কখন যে কার মাথায় পড়বে একটু বেচাল হলেই , কেউ বলতে পারতনা। আর এইরকম দুর্ধর্ষ বোম্বেটেদের সামলানো ঐ ছড়ি ছাড়া সম্ভব হতো‌ না বলেই মনে হয়। কিন্তু কাজ যে একেবারেই কিছু করতে হতো না তা হয়, নতুন  আলুর খোসা বস্তায় ঘসে ওঠাতে হতো। রান্নার ভার রঘুদার ওপর। দুলু দা, বুড়োদা, শক্তি দা, মনা দা, চঞ্চলদা, দোদা দা,মোহন দা, মদন দা, রবি দা, প্রণব দা, কাজল দা, ভুটান দা, পল্টু দা, মিলি দা, ছোকুদা, বীরেনদা ছাড়াও আরও অনেকেই থাকতেন  এই পিকনিকে । খাওয়াদাওয়া সারতে সারতে ছোট দিনের বেলা গড়িয়ে যে কখন সন্ধে হয়ে যেত বুঝতেই  পারতাম না।  সকাল বেলায় পিকনিক স্পটে পৌঁছানোর পর  ডিমসেদ্ধ, পাঁউরুটি ও কলা দিয়ে টিফিন খাওয়া হতো। আলুর খোসা ছাড়ানোর পরেই দড়ি ছাড়া গরুর মতো এদিক সেদিক করে কুল  বা পেয়ারা পেড়ে খাওয়া  হতো। লম্বা লম্বা নারকেল গাছ থেকে  নারকেল  পাড়া আমাদের  কম্মো ছিলনা কিন্তু  ব্রজেন দা পুকুর পাড়ে নারকেল গাছে তরতরিয়ে উঠত এবং  নারকেল পাড়তো। কোন কোন সময় দুচারটে নারকেল পুকুরের জলেও পড়ে যেত। পুকুরগুলো সব বাঁধানো ছিল মানে যাঁদের বাড়ি ছিল তাঁরা  বেশ বড়মাপের জমিদার বা রাজা ছিলেন। অত লোকের রান্না হতে যথেষ্ট  সময়  লাগত আর এর মধ্যেই মনাদার গল্প ও চুটকি সবার মন ভরিয়ে দিত। এইরকম জমজমাট পিকনিক জীবনেও ভোলার নয় কারণ এখানে ছোট বড়সড় সবাইকেই কিছু দায়িত্ব  দেওয়া হতো এবং প্রত্যেকেই সেটা আনন্দের সঙ্গে করতো যেটা এখনকার পিকনিকের থেকে অনেক আলাদা। এখন কাছাকাছি  পিকনিক  স্পট নেই বললেই চলে। লোকসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য আশপাশের ফাঁকা জায়গাগুলোয় বাড়ি ঘর হয়ে গেছে এবং বড়সড় জায়গা খুঁজতে গেলে যেতে হবে গাড়িতে বা বাসে বা ট্রেনে । লোকসংখ্যা বেশী হলে একটা বাসেও হবেনা, অনেক গাড়ি বা বাসের সংখ্যা বাড়াতে হবে। এ ছাড়া লোকজন বেশী হলে গ্রুপের মধ্যে যে বাঁধন সেটা বহুলাংশেই শিথিল হয়ে যায় । তখন নামেই একটা বড়দলের পিকনিক  কিন্তু তা ছোট ছোট  অনেক গ্রুপের  সমন্বয় । এই গ্রুপের লোকের  সঙ্গে ঐ গ্রুপের  লোকের  বিশেষ  সদ্ভাব নেই। সুতরাং জমাটে পিকনিক  হবার  সম্ভাবনা খুব কম । এ ছাড়া নিজেদের  যোগদান, না থাকার ই সামিল। চাঁদা দিয়েই খালাস। কতটা পেলাম প্রতিদানে এই নিয়ে হিসেব কষতে কষতেই আনন্দের  দফারফা। এছাড়া রয়েছে ক্যাটারার, তারাই খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারটা দেখে বলে পিকনিকে অংশগ্রহণকারীদের ভূমিকা অত্যন্ত নগণ্য। তবুও  এরই মধ্যে দুএকজন বিশেষ  ভূমিকা পালন করেন বলে এখনও এর মধ্যেই কিছু  আনন্দ পাওয়া যায় । এঁরা যদি কোন কারণে  দায়িত্ব  না নেন তাহলে পিকনিকটাই হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে। এখন সবকিছুই যেমন নিউক্লিয়ার,  গ্রুপটাও সেরকম নিউক্লিয়ার বাঊ আঁটোসাঁটো হওয়া দরকার । এঁরা আছেন বলে আজ ও কিছু আনন্দ পিকনিকে  পাওয়া যায়। 
আজকের দিনে পিকনিক অবশ্য সারাবছর ধরেই হয় বলে এখানে সেখানে বহু রিসর্ট হয়েছে এবং ঠা ঠা রোদেও এয়ার কণ্ডিশনড ঘরে বসে দিব্যি রমরম করে পিকনিক ও চলছে আর রিসর্টগুলোও চলছে। এখন পৌষল্যা পৌষমাসেই আবদ্ধ নেই, নাম বদলে পিকনিক  হয়েছে এবং বার মাস ধরে চলছে।

Friday, 10 January 2025

প্রত্যাবর্তন

হঠাৎই একটা মেসেজ এল পাশের বাড়ির মেসোমশাই  গতকাল রাতে  অমৃতলোকে যাত্রা করেছেন। একাই থাকতেন তিনি স্ত্রী বিয়োগের পর। এক ছেলে ও এক মেয়ে বিদেশে থাকে, তারা তাদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। মাঝে মধ্যে আসে তারা বাবা মায়ের সঙ্গে সময় কাটাতে তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে । রবি বাবু ও তাঁর স্ত্রী সুকন্যা দেবী খুশীতে ডগমগ হয়ে উঠতেন, বিশাল বাড়িটা  ঝলমলিয়ে উঠত বাচ্চাদের কলরবে। কয়েকটা দিন হৈচৈ,  তারপরেই ঝিমিয়ে পড়ত গেট ওয়ালা বাড়িটা। কেউ এলে গেলে মাসিমা বলতেন, "বাবা, গেট টা লাগিয়ে দিয়ে যেও। "সেই মাসিমা ও চলে গেছেন গতবছর। তারপরেই রবি বাবুর একাকীত্ব শুরু। লোকজনের আসা যাওয়া কমে গেছে। একটু আধটু লেখাজোখা করে খানিকটা সময় কাটে কিন্তু  দীর্ঘ সময় তো আর কাটতেই চায়না। বেশীক্ষণ লিখতেও আর ভাল লাগেনা। আগে যখন স্ত্রী বেঁচে ছিল তখন লেখার সময় অবধারিতভাবে বলত যে বাজারে যাও সকাল সকাল নাহলে ঐ ঝটতি পটতি জিনিসগুলো তোমার থলিতে ঢুকবে আর আমার প্রাণান্ত। খুবই বিরক্ত হয়ে কলমটা টেবিলের ওপর আছড়ে ফেলে থলিটা নিয়ে বেরিয়ে যেতেন। রাগের মাথায় জিনিস পত্র আনাতেও গণ্ডগোল হয়েযেত যার অবশ্যম্ভাবী ফল গিন্নীর গনগনানি। তখন বিরক্তির মাত্রা আরও বেড়ে যেত কিন্তু আজ কেউ পিছনে  টিকটিক করার নেই, চোখা চোখা বাণে কেউ বিদ্ধ করার নেই,  আছে শুধু নিস্তব্ধতা, তবু লিখতে মন আর চায়না।  পিছন থেকে  খানিকটা বিদ্রূপাত্মক শব্দ উড়ে না এলে কলম যেন আগে বাড়তেই চায়না। সেও যেন বুঝে গেছে ঝাঁকানি শেষ অতএব দাও ক্ষান্তি। রবিবাবু ও বুঝতে পারেন সুকন্যার অনুপস্থিতি তাঁকে নিরুৎসাহী করে তুলেছে। প্রকাশকের তাগাদাও তাঁকে আর উজ্জ্বীবিত করতে পারছে না। অথচ, না লিখলেও পয়সা আসবে না,সঞ্চিত পুঁজিতে পড়বে টান। জীবনের উপান্তে এসে ছেলেমেয়েদের কাছে নিজের  কোন চাহিদার কথা বলতে খুব কুণ্ঠা বোধ হয় । সেই জন্য এক রকম বাধ্য হয়েই কলম খুলে বসতে হয়। কি যেন লিখছিলাম ভুলে গেছি, প্রথম থেকে একবার পড়ে নিয়ে খেই ধরতে হয়। তবু সেই তখনকার মনের অবস্থায়  ফিরে যেতে যথেষ্ট অসুবিধা হচ্ছে। লেখক এক, বিষয় এক, কলম ও এক কিন্তু ভিন্ন মন । গল্পের গতি ভিন্নমুখী।রবি বাবু ভাবেন এটা নিশ্চয়ই সব লেখকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য কারণ শয়ে শয়ে পাতার উপন্যাস তো আর একটা সিটিং এ লেখা সম্ভব নয়। সুতরাং ভিন্ন মানসিকতায় শেষ হয় এই দীর্ঘ উপন্যাস। যাঁরা সেই গতি প্রকৃতি এক ধারায় রাখতে পারেন তাঁরা সত্যিই নমস্য।
কদিন ধরেই  শরীরটা বিশেষ  ভাল যাচ্ছেনা। অল্প অল্প জ্বর, প্যারাসিটামল খেয়ে জ্বর নেমে যাচ্ছে আবার খানিকক্ষণ বাদেই যে কে সেই। বন্ধুবান্ধব আসছে দেখা করতে,  নিয়েও যেতে চাইছে ডাক্তারের কাছে কিন্তু রবি বাবুর মন আর সরছে না। কেবল ই মনে পড়ছে শৈশবের কথা,  ধোপঘাটির মাঠে ফুটবল খেলার কথা এবং খেলা শেষে বৈঁচি পাড়ার কথা,  মণ্ডল বাড়ির বাতাপি লেবু বা ভাদুড়িদের বাড়ির নারকেল চুরির কথা । এক কথায় শৈশবের হাতছানি আর উপেক্ষা করতে পারছেন না রবি বাবু । কাজের মেয়ে রান্না করে যাবার সময় বলে গেল গরম গরম খাবার খেয়ে নিও, ঠাণ্ডা খাবার খেওনা, শরীরটা তোমার ভাল নেই । রবি বাবু কোন উত্তর দিলেননা। ল্যাচটা টেনে দিয়ে চলে গেল দীপা। রবি বাবু কিন্তু সেই শৈশবের দিনগুলোয়  মত্ত, কোনরকম ভ্রূক্ষেপ করলেন না।
দীপা পরদিন সকালে এসে চাবি খুলে ঢুকে দেখে খাবার টেবিলে রাতের খাবার  যেমনকার তেমন সাজানোই আছে। ঘরে ঢুকে দেখে রবিবাবু যেমনভাবে শুয়েছিলেন তেমন ভবেই শুয়ে আছেন, ঠোঁটের ফাঁকে একটু মুচকি হাসি কিন্তু শরীরটা যেন স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশী রকম ই ঠাণ্ডা। কাকু,কাকু বলে অনেক ডাকার পরেও কোন  উত্তর না পেয়ে চিৎকার করে উঠে সবাইকে ডেকে আনল। পাড়ার ডাক্তার বীরেন ভট্টাচার্য এসে পরীক্ষা করে দেখে বললেন, " নাহ্, সব শেষ । কিন্তু ছেলে মেয়ে  কেউই নেই এখানে, খবর দিতে হবে দেহ সৎকারের জন্য। অতএব খবর দিতে হলো পীস হ্যাভেনে। গাড়ি এসে গেছে রবি বাবুর নিথর দেহটা নিয়ে যাওয়ার জন্য। দীপা সারাক্ষণ ই কাঁদছিল ।মুখে মৃদুহাসি  নিয়ে রবি বাবু চললেন শৈশবের বন্ধুদের উদ্দেশ্যে  যেখানে রয়েছে  নিমাই, দেবু, বাবু, মোহন, বিজয়রা ডাণ্ডা গুলি নিয়ে, রয়েছে ছোট বল পিট্টু খেলার জন্য, যেটা রবি বলবে সেটাই খেলবে কারণ আজ ওই হচ্ছে প্রধান অতিথি ।