Saturday, 2 December 2023

গল্প হলেও সত্যি ----"ঘেউ"

সকাল বেলায় মোবাইলে বার্তালাপে আমার বন্ধুপ্রতিম ও সহকর্মী তপন বিশ্বাস তার নিজের জীবনের এক দারুণ অভিজ্ঞতা জানালো। কুশল বিনিময়ের প্রাথমিক পর্যায়ের শেষে জানতে পারলাম তার এই বিশেষ অভিজ্ঞতার কথা। ও তখন  তিরুপতিতে কর্মরত। তিরুপতির কথা উঠলেই চোখ দুটো কেমন নিজের থেকেই বন্ধ  হয়ে যায় আর বিড়বিড় করে বাবা ভেঙ্কটেশের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন হয়, আবার  কেউ বা হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে নেয়। আমি এই ব্যাপারে আজকের  রাজনীতিবিদদের মতন দলবদলু।  বিপদে পড়লে ভগবানের উদ্দেশ্যে প্রণাম আর আনন্দে ভাসা অবস্থায় একদম ভুলে যাবার মাস্টার। তা এইরকম এক দিনে ও ব্রাঞ্চের  দিকে চলেছে। ও বরাবরই ব্যাঙ্কের কাজকর্ম  শুরু হওয়ার অনেক  আগেই পৌঁছে যেত যাতে গ্রাহকদের  কোনরকম অসুবিধার মধ্যে না পড়তে হয়। অফিস  থেকে  কখনোই  ও বেশি দূরে থাকতো  না যাতে পায়ে হেঁটেই অফিস পৌঁছানো যায়। যারা মানুষকে ভালবাসে তারা প্রকৃতির  রূপ ও তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ  করে। ঐ পথচলাতেই  নানাধরণের ঘটনা তার স্মৃতির মণিকোঠায় জমা হয় এবং একান্ত আলাপচারীতায় বেরিয়ে আসে মাঝে মাঝে।

তিরুপতিতে সবসময়ই ভিড় । ভারতের বিভিন্ন  অংশ থেকে দলে দলে লোক  আসে বাবা ভেঙ্কটেশের দর্শনে পুণ্যলাভের আশায়। আর আসবে নাই বা কেন। কত লোক কতরকম অনৈতিক কাজ করে পাপস্খালনের উদ্দেশ্যে মন্দিরে বহুমূল্য কিছু জিনিস বাবার চরণে  সমর্পণ করে (একরকম  ঘুষ দিয়ে) আত্মপ্রসাদ লাভ করে কিন্তু এটা বুঝতে পারেনা যে ঘুষ তুমি যতই দাও চিত্রগুপ্তের  খাতায় তা উঠে গেছে এবং ঠিক সময়ে তা প্রকাশিত হবে। অনেকেই  এতে বিশ্বাস  করে বলে পাপের সংখ্যা কিছুটা  হলেও  কমে। কিন্তু বর্তমান যুগে সবাই  বিনধাস চলে এবং ফলস্বরূপ  ছোট বড় কুচোকাচা লোক প্রায় সবাই খুব  বেশিমাত্রায় পাপ করে। এরই মধ্যে ও দেখে একটা জায়গায় খুব জটলা আর একটা মেয়ে তারস্বরে চিৎকার করে মানুষের সাহায্য চাইছে আর যথারীতি সাধারণ মানুষ সাহায্য  করার  বদলে আনন্দ উপভোগ করছে যেমনটি হয়েছিল কুরুপাণ্ডবের দ্যুতসভায় দ্রৌপদীর সঙ্গে। সেইদিন ভীষ্ম,  দ্রোণ, কৃপাচার্য, ধৃতরাষ্ট্র ও বিদুর যেমন মৌন ছিলেন তেমনই আজকের জনতাও  ছিল  মৌন। কিন্তু পাঞ্চালির আর্তনাদে যেমন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, আজও  তেমন  তিনি একদল কুকুরের  রূপ ধরে মেয়েটির সাহায্যে এগিয়ে এলেন। ঘেউ, ঘেউ করে সারমেয় দলের  সমবেত স্বর এগিয়ে আসতে লাগল  ঐ মেয়েটির  দিকে এবং তাতে হেনস্থাকারীরা এদিকে ওদিকে পালাতে লাগল। ক্রমশ ভিড় একটু পাতলা হয়ে এলে  একটি কুকুর  মেয়েটির খুব  কাছে এসে শুঁকে তার অসুস্থতার  গুরুত্ব বোঝার  চেষ্টা করল এবং তার দলের  অন্যদের  সেখানে রেখে দৌড় দিল এবং একটি ছোট্ট  হাসপাতালের সামনে ঘেউ ঘেউ  করে ডাকতে শুরু করল এবং নাচতে থাকল। ডাক্তার বা নার্সের  মধ্যেও  তো অনেক সহৃদয় লোক থাকেন তাঁদেরই  মধ্যে একজন  নার্স কুকুরটি  কি বলতে চাইছে বোঝার জন্য বাইরে এলেন  এবং কুকুরটিও  তাঁকে দেখে  আরও জোরে ঘেউ ঘেউ করে নাচতে থাকল এবং কিছু বলার চেষ্টা করতে থাকল নিজের ভাষায়। ভদ্রমহিলা কুকুরটির কাছে আসতেই সে লেজ নাড়িয়ে দ্বিগুণ  উৎসাহে ডাকতে থাকল এবং  তাঁকে অনুসরণ করার  অনুরোধ  করতে থাকল এবং সেই ভদ্রমহিলাও তাকে অনুসরণ করতে থাকলেন।  মেয়েটির  ঐ অবস্থা দেখে তিনি তাকে  হাসপাতালে নিয়ে আসেন এবং সুস্থ  করে তোলেন।  সুস্থ  হবার  পরেই মেয়েটি বাবা ভেঙ্কটেশের  দর্শনে জেদ করায় কুকুরটিও তাঁর পিছু পিছু চলতে থাকে এবং খানিকটা যাওয়ার  পরেই অন্য একদল কুকুর  তাদের  এলাকায় ঢোকার  জন্য  শাসাতে থাকে। আর কি করা যাবে, অতএব  ফিরে চল নিজের  এলাকায় কিন্তু ততক্ষণে সেই মেয়েটি সম্পূর্ণ  সুস্থ এবং তাকে হেনস্থাকারীদের  হাত  থেকে উদ্ধার করার  জন্য তাকে অসংখ্য  ধন্যবাদ জানাল। বন্ধুর গল্পশেষে মনে হলো যে আজও তিনি আছেন  এবং আর্তের ডাকে  সাড়া দেন।

Wednesday, 29 November 2023

বেলুন

দোকান থেকে তিতাস কিনে আনল এক বাক্স বেলুন। বাক্স খুলে দেখে কেমন যেন জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে তারা সবাই।  কেউ সাদা, কেউ নীল, কেউ লাল,  কেউ গোলাপী আবার  কেউ বা হলুদ যেন কুকুরের অনেকগুলো বাচ্চা সবাই  ভিন্ন ভিন্ন ধরণের। বড় হলে তাদের আকৃতি ও প্রকৃতিও ভিন্ন  ধরণের  হয়। আগামীকাল গোলুর জন্মদিন উপলক্ষ্যে কিনেছে। ছোট্ট  দুই কামরার ফ্ল্যাটে তিতাস ও বাসুর সাম্রাজ্য গোলুকে নিয়ে। গোলু এখন স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে, সুতরাং তার বায়না তার বন্ধুদের তার জন্মদিনে নিমন্ত্রণ  করতে হবে। খুবই সাধারণ  মধ্যবিত্ত পরিবারে তারা বড় হয়েছে যদিও ছাত্র এবং ছাত্রী হিসাবে দুজনেই  ছিল  যথেষ্ট  মেধাবী এবং সেই সুবাদেই দুজনেই  ভাল চাকরি করছে। কিন্তু যাদের জীবন প্রথম থেকেই সংগ্রামের  মধ্য দিয়ে আসে তাদের থিতু হতে একটু সময় তো লাগবেই। একসঙ্গে ক্লাসে  পড়তে পড়তেই একটু একটু ভাল লাগা, তার থেকে প্রেম  এবং অবশেষে বিয়ে। বিয়ের পর পরই হাউসিং বোর্ডের ফ্ল্যাট  লটারিতে পাওয়া এবং ইনস্টলমেন্টে কেনা যদিও ডাউন পেমেন্ট এর পনের শতাংশ  জোগাড় করতেই হিমশিম খেতে হয়েছিল  তাদের। 

গোলু ভাল  স্কুলে চান্স পাওয়ায় মাইনেটাও যথেষ্ট  বেশী। সেখানে অনেক বড় বড় লোকের মানে ধনী লোকের ছেলেরা পড়ে, যারা আসা যাওয়া করে গাড়িতে যেখানে তিতাস বা বাসু বাসে করে বা নিদেন পক্ষে অটো করে যাতায়াত করে। গোলুর বন্ধুবান্ধবদের জন্মদিন  খুব  হৈ হৈ করে উদযাপন হয় এবং বড় কোন ক্লাবে বা হোটেলে। গোলুর ও বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করতে ইচ্ছ করে কিন্তু তিতাস  বা বাসুর সেই সামর্থ্য নেই। ছোট্ট  দুকামরার ফ্ল্যাটে জন্মদিন  পালন  অসম্ভব,  সুতরাং অগতির  গতি ঐ অ্যাসোসিয়েশন হল। সেখানেও ভাড়া আজকাল  বেড়েছে, হয়েছে তিন থেকে পাঁচ হাজার। এছাড়াও হল সাজানো , খাওয়াদাওয়া এবং রিটার্ন  গিফট  সব মিলিয়ে আরও  বেশ অনেক টাকা যা তাদের  চিন্তার  মাঝে ফেলে দেয়। সে আর কি করা যাবে, পরের মাসগুলোয় একটু টেনেটুনে চালাতে হবে। ওদের সময় তো এত হ্যাপা ছিলনা, মা হয়তো একটু পায়েস করে দিল আর তার থেকে আরেকটু বেশী হলে একটু মাংস আনা হলো এবং অবশ্যই  রবিবার দিন মাংস বাদ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুই  বদলায়।  এখন বাচ্চারা পায়েস  খাক বা না ই খাক,  কেক কাটতেই  হবে, বেলুন দিয়ে ঘর সাজাতেই  হবে। উপরি আছে রিটার্ন গিফট। বাচ্চারা কেউ একা আসেনা, আসে তাদের  মা বা বাবা  কিংবা দুজনেই। সুতরাং সব কিছু মিলিয়ে একটা বড় ধাক্কা।

অ্যাসোসিয়েশনের হলটা  বেলুন দিয়ে সাজানো হয়েছে। দাস ক্যাটারার এর লোকজন এসে নিচে পলিথিনের  শিট  দিয়ে রান্নার  জায়গাটা ঘিরেছে এবং মাঝে মাঝেই বেশ সুন্দর গন্ধ ভেসে আসছে। সন্ধ্যার সময় ঝিমিয়ে থাকা হল বেশ ঝলমলে হয়ে উঠেছে, প্রাণ ফিরে পেয়েছে বাচ্চাদের  কলরবে। আজকাল  তো বাচ্চা চোখেই পড়েনা। আগে কত ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কলতানে পার্কটা গমগম করতো আর এখন বাচ্চা একটু  বড়  হতেই নানাধরণের  ক্লাসে তাদের  ভর্তি করে দিয়ে শৈশবের দফারফা করে দেওয়া হয়। হয় আঁকা, নাহলে নাচ বা গানের ক্লাসে  তাদের খেলাধূলার পরিসমাপ্তি।  সেই কারণেই এত আনন্দ বাচ্চাদের  আর আমরা যারা বুড়ো তারা ওদের  চেঁচামেচিতে নিজেদের  শৈশবের কথা ভাবছি। বেশ রাত অবধি বাচ্চাদের  গুঞ্জনে মনটা বেশ হাল্কা হয়ে গেল। নিজের  নাতি নাতনিদের কথা মনে পড়ে চোখটা একটু ছলছল করে উঠল আর অনেক অনেক ভালবাসা ও আশীর্বাদ  তাদের উদ্দেশ্যে পাঠানো হলো।

পরদিন সকাল।  হলটা  আবার  কেমন  ম্রিয়মান। সাফসুতরো চলছে। গতকাল সন্ধ্যার ফুলে ওঠা বেলুনগুলোর জেল্লা যেন ফিকে  হয়ে এসেছে, গুচ্ছে  বাঁধা বেলুনগুলো বাইরে এদিকে ওদিকে হেসে খেলে বেড়াচ্ছে। রিক্সাভ্যানে তরকারি নিয়ে আসা বিক্রেতা দুটো গোছা নিজের  ছেলেমেয়েদের জন্য নিল আর বাকি গোছাগুলো ম্লান দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল।  কিন্তু সব্জিতে ভর্তি ভ্যান,  বিক্রেতা অস্ফূট  স্বরে বলে উঠল," ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই ছোট সে তরী, অতএব ক্ষমা করো মোরে নিজগুণে।" হাওয়ায় ভাসা উপেক্ষিত বেলুন গুলো মাঝেমধ্যেই  ফুট ফাট আওয়াজ করে চুপসে যেতে লাগল আর তখনও ফুলে থাকা বেলুনের গায়ে লেজের মতন ঝুলতে থাকল। আহ্, কি হচ্ছেটা  কি,ছাড়না মোর হাত কিন্তু ক্ষীণ স্বরে  বলে উঠল চুপসে যাওয়া বেলুন, " আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ,  সুরের বাঁধনে , অতএব  ভেসে চল ধরে মোর হাত।"

Friday, 24 November 2023

হলুদ বসন্ত

জীবন সায়াহ্নে পৌঁছানো মধুকর বাবু ও তাঁর  স্ত্রীর বেশিরভাগ সময়ই কাটে গাড়ি বারান্দার ওপরের ছাদে। দুই বুড়োবুড়ির কথোপকথন সেই একই ব্যাপারে সীমিত। কেউ না কেউ তো একজন হয়ে যাবে, তখন কি করে সময় কাটাবে অন্যজন। সবাই  তো আর  বিপিন রাওয়াতের মতো ভাগ্যবান নন যে একইসঙ্গে দুজনে বিদায় নিলেন  এই সুন্দর পৃথিবী থেকে। আরও অনেক ভাগ্যবান  আছেন যাঁরা কোন না কোন ভাবে একইসঙ্গে বিদায় নিয়েছেন যাঁদের কথা আমরা জানিনা। 
মধুকরের স্ত্রী রীনা খুবই  চিন্তিত  যে উনি যদি আগে চলে যান তাহলে মধুকরের কি হবে। মধুকর খুবই জেদি ধরণের মানুষ, কোনভাবে কারো সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারেন না। ভীষণ একবগ্গা টাইপের মানুষ প্রথম থেকেই। কেবলই নিজের মতামত অন্যের উপর চাপিয়েই ছিল  তাঁর আনন্দ।  সুতরাং বুঝতে কোন অসুবিধা হবার কথাই নয়। মেয়েরা তো সর্বংসহা, জলের  মতো, যে পাত্রেই রাখা যাক না কেন  সেই জায়গাতেই মানিয়ে নেয় কিন্তু যাঁরা একটুও  নমনীয় নন তাঁদের  তো মহা বিপদ। সেইজন্য রীনা রোজ পূজোর  সময় ঠাকুরের কাছে তাঁর মনের কথা ভক্তিভরে বলেন। কিন্তু নিয়তির লিখন অন্যরকম। হঠাৎই একদিন সবাইকে ভাসিয়ে রীনা চলে গেলেন। মধুকরের চোখের জল কেমন যেন শুকিয়ে গেছে। নিথর হয়ে বসে আছেন  তাঁর নিজের  জায়গায়, একদৃষ্টে চেয়ে আছেন  রীনার চেয়ারের দিকে। শববাহী গাড়ি এসে গেছে রীনার নিথর দেহটাকে নিয়ে যেতে। ছেলে মেয়ে বৌমা ও জামাই সবাই  বলছে মধুকরকে একবার  আসার জন্য  কিন্তু ভ্রূক্ষেপ নেই মধুকরের।  কারো দিকে ফিরেও তাকাচ্ছেন না তিনি। সবাই খুব  অস্বস্তিতে পড়ে গেছে, অন্তত একবারের জন্য  তো তাঁর  আসা দরকার। নাতি, নাতনিরা কেউ আসতে পারেনি রীনার  হঠাত প্রয়াণে। সুতরাং তাদের  আবদারেও  অন্তত  সাড়া দেবার অবকাশ  নেই।

মধুকর ছিলেন  অত্যন্ত  ছাপোষা মানুষ,  বিরাট চাহিদা তাঁর কোনদিনই  ছিলনা। শৈশবের কঠিন  সংগ্রাম এবং দায়িত্ব বোধ তাঁকে কোনদিনই বিরাট স্বাচ্ছল্যের হাতছানি দেয়নি আর পাঁচজনের মতন। জীবনে  চাহিদা যাদের  কম তাদের কষ্ট ও কম। কারও  কাছে হাত পাতার দরকার হয়না, নিজের কষ্ট নিজেই   হজম করতে শেখে তারা। সুতরাং একরোখা হবার এটা একটা কারণ হতে পারে। কি ছেলে, কি মেয়ে বা বন্ধুবান্ধব কারও  কাছেই  মাথা নোয়াতে  রাজি নয় তারা। মাঝেমধ্যেই  মনে হয়  যেন  একটু বেশিই অসামাজিক।  কিন্তু কে কি ভাবে তাতে তাদের  বিন্দুমাত্র  আগ্রহ  নেই। অনেকটা সেই আপনারে দিয়ে রচিলি রে কি এ , আপনারই আবরণ এর মতো। রিটায়ার করার পর পাওয়া টাকা দিয়ে একটা বড় ফ্রিজ ও ওয়াশিং মেশিন কিনেছেন যাতে  রোজ বাজার যাওয়ার ঝামেলা না থাকে বা কাপড়চোপড় কাচার  ঝামেলাও  বেশি না থাকে। আজকাল  কাজের  লোকের কথায় কথায় কামাই যাতে খুব  অসুবিধার সৃষ্টি না করে। কিন্তু ওয়াশিং মেশিন খুব  কম সময়ই ব্যবহার  হয়। ফ্রিজ কিন্তু বেশ ভালোই চলছে মধুকরের অবস্থার  কথা ভেবে অবশ্য মাঝে মধ্যে তেল সাবানের দরকার তো হয়ই।  এইভাবেই  বেশ চলছিল কিন্তু বাদ সাধল  মেয়ের আবদার। ঐ বুড়ো ফ্রিজটাকে এবার বাতিল  না করলেই  নয়। বুড়ো হলেই তো তার কদর কমে যায় সে মানুষ ই হোক  আর অন্য  যে কোন  জিনিস  হোক  না কেন। একদিন  ছিলে তুমি ঝকঝকে , ছিল তোমার কদর, কত প্রশংসাই না হতো তোমার কিন্তু আজ তুমি তোমার গ্ল্যামার হারিয়েছ,  জায়গা ছেড়ে দাও নতুনকে।  এটাই  তো জগতের  নিয়ম। অতএব প্রকৃতির নিয়মে তোমার জায়গায় এসে যাবে নতুন।  পুরোন চেহারাটাকে নিয়ে বদলে দেবে নতুন চেহারা। কিন্তু এই পৃথিবীতে অনেক লোক আছে যারা পুরোন কে ফেলতে ইতস্তত  করে, তাদেরই আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায় কারণ তাদের বদ্ধমূল  ধারণা এদের  এখনও  অনেক কিছুই  দেবার  আছে। কিন্তু না, তারা অত্যন্ত  সংখ্যালঘু, অতএব ফেলে দাও সেই পুরাতনে। 
অনেক  সময় চলে গেছে।  শববাহী যানের  লোকজন  একটু বেশিই  অধৈর্য হয়ে পড়েছে। তাদের  আবার  অন্য জায়গায় যেতে হবে। ছেলে এসে মধুকরের পাশে এসে বলল, " বাবা, একবার  এস, মাকে শেষবারের  মতন বিদায় দাও।" কিন্তু কোন  সাড়া নেই । গায়ে হাত দিয়ে একটু ধাক্কা দিতেই চেয়ার থেকে পড়ে গেলেন  মধুকর,  নিথর নিস্তব্ধ  দেহ। রীনার  প্রার্থনা শেষমেশ ভগবান মঞ্জুর করলেন। 

Monday, 23 October 2023

শারদোৎসবে ইতিহাসের খোঁজে

শারদীয় আর্ট গ্যালারি পরিক্রমা তো বিভিন্ন সংস্থা বা বিভিন্ন  লোকের ব্যক্ত করেছেন কিন্তু কোন কোন পূজোর  পিছনে হয়তো বা কিছু ইতিহাস  লুকিয়ে থাকে যেটা সবসময় বিরাট  কিছু না হলে লোকের  অজ্ঞানতায়ই  থেকে যায়। সেইরকম ই একটা ছোট্ট ইতিহাস মিশ্রিত কাহিনীর অবতারণার  প্রচেষ্টা মাত্র।
ভীম বেশ কিছুদিন যাবত ই অন্য পাণ্ডবদের থেকে আলাদা থাকতে বাধ্য  হয়েছে নানান কারণে। এর আগে জানাই এর রাজবাড়ির পূজোতেও  ভীম ও ভালান্দ্রা অন্যত্র  ব্যস্ত থাকায় আসতে পারেনি। অর্জুনের  পরিকল্পিত জয়নগরের কাছে বহড়ু গ্রামে এক পারিবারিক পূজোয় যাওয়ার  কথা হলো। অর্জুনের ই এক প্রাক্তন  সহকর্মী মাণিক ব্যানার্জি তার সমস্ত  বন্দোবস্ত করলেন মানে অষ্টমী পূজোয় অঞ্জলি দেওয়া থেকে ভোগ খাওয়া এবং সেই বিখ্যাত  বহড়ু গ্রাম পরিদর্শন করানো।

বহড়ু গ্রাম সম্বন্ধে একটু ছোট্ট  পরিচয় করানো দরকার। এটি জয়নগরের একটু আগে অবস্থিত এবং খুবই  বর্ধিষ্ণু গ্রাম। এইখানেই  প্রখ্যাত গায়ক হেমন্ত মুখার্জির পূর্বপুরুষেরা থাকতেন।  যাওয়া আসা ছিল তাঁরও। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে নিজের  গ্রামে এসেছিলেন  এবং শুধু হারমোনিয়ম  নিয়ে একটিই  গান করেছিলেন, " দিনের  শেষে, ঘুমের দেশে ঘোমটা পড়া ঐ ছায়া" আর তার পরেই ফিরে এসে চিরতরে ঘুমের  দেশে পাড়ি দেওয়া। বিরাট  বাড়ির  আর কিছুই  অবশিষ্ট  নেই সবই হয়ে গেছে বেদখল  কিন্তু দখলকারীদের একটা বিষয়ে অবশ্যই  ধন্যবাদ দিতে হবে। তাঁরা প্রয়াত  শিল্পীর একটা স্ট্যাচু বানিয়ে দিয়েছে এবং গলায় আছে অবশ্যই একটা টাটকা গাঁদা ফুলের  মালা। এটুকু না করলে তো মান সম্মান  কিছুই  থাকেনা। যাই হোক, অনতিদূরে প্রয়াত শিল্পী সমিত  ভঞ্জদের  পৈতৃক বাড়ি। তাঁদের  একটা নাটমন্দির ছিল যেখানে এক অষ্টধাতুর  মূর্তি ছিল। মানুষের  লোভের  তো শেষ  নেই, সেই অষ্টধাতুর মূর্তি তিন তিনবার  চুরি হয় এবং ভগবানের  আশীর্বাদে তিনবার ই তা উদ্ধার  হয় কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত তাঁকে খণ্ডিত বিখণ্ডিত অবস্থায় পাওয়া যায়। এখন ভগবান তো ভাল মানুষের বাবা/ মা ,আবার  দুর্বৃত্তের ও বাবা/ মা। সুতরাং  সবই তাঁর  কৃপা। তাঁরই  ইচ্ছেতে লোকে তাঁকে চুরি করেছে  এবং খণ্ড বিখণ্ড করেছে আবার  তাঁরই  ইচ্ছেতে তিনি ফিরে এসেছেন। এই মন্দিরের  প্রতিষ্ঠা করেন শমিত ভঞ্জের পূর্বপুরুষ  দ্বারকানাথ ভঞ্জ প্রায় দেড়শো বছর  আগে। আরও  একটি বিখ্যাত  জায়গা শ্যামসুন্দরের মন্দির।  তদানীন্তন  জমিদার ( যাঁকে সাতমহলার  জমিদার  বলা হতো) বৃন্দাবনে  গিয়ে এতটাই  মোহিত হয়ে পড়লেন  যে ঐ মূর্তিটিকে তিনি এই গ্রামে নিয়ে এসে প্রতিষ্ঠা করবেন কিন্তু তিনি স্বপ্নাদিষ্ট  হয়ে জানতে পারলেন  যে ঐরকম ই একটি মূর্তি তাঁর গ্রামের  নাটমন্দিরে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কি অপূর্ব  সেই মূর্তি। সেই জমিদারের  উত্তর পুরুষ  পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে তিন একর জমি দান করেন  এই আশ্বাসে যে তাঁদের  পরিবারের  কয়েকজনকে সরকারি চাকরি দেওয়া হবে কিন্তু এই আশ্বাস মৌখিক  হবার কারণে তাঁরা কেউই চাকরি পাননি কিন্তু তাঁরা কাগজপত্রের মাধ্যমে সরকারকে তিন একর জমি দান করেন। এই কথা তাঁদের উত্তর পুরুষের  মুখ থেকে শোনা, সত্যতা যাচাই করার  কোন  অবকাশ  হয়নি। সেই জমিতেই  অবস্থিত আজকের  বিডিও অফিস।  সেই শ্যামসুন্দরের নামানুসারেই শ্যামসুন্দর মিষ্টান্ন ভাণ্ডার  যিনি মাণিক বাবুর  সৌজন্যে আমাদের  ছোলার  ডালের  বরফি  খাওয়ালেন কিন্তু  কোনরকম  পয়সাকড়ি নিলেন না। এই দোকানটি  প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শ্রী গোপাল চন্দ্র ঘোষ  এবং এখন পরিচালনার  দায়িত্বে দুই ভাই  শ্রী রঞ্জিত কুমার ঘোষ  এবং বাবলু কুমার ঘোষ।  রঞ্জিত বাবু তখন  দোকানে ছিলেন না, বাবলু বাবু  সন্দেশ তৈরীতে ব্যস্ত  ছিলেন  কিন্তু অত ব্যস্ততার মধ্যেও  আমাদের  সবাইকে উনি ছোলার ডালের বরফি  খাওয়ালেন এবং বললেন  নভেম্বর মাসের শেষ  দিক থেকে ফেব্রুয়ারির শেষ পর্যন্ত  তাঁর দোকানের  মোয়া  যেন  আমরা অবশ্যই  খাই। শীতের  আমেজে খেজুরের রস হয় মিষ্টি এবং এক বিশেষ ধানের খই তাঁদের  হাতের  যাদুস্পর্শে হয়ে ওঠে জয়নগরের মোয়া।  এই মোয়া  নিয়ে বহড়ু ও জয়নগরের মধ্যে যথেষ্ট  রেষারেষি আছে। একজন বলে আমিই সেরা তো আরেকজন বুক বাজিয়ে বলে , " না আমি।" আপাতত  মুলতুবি থাক তাদের  প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা। আমরা নিজেরা আসব, পরখ করব এবং তারপর সিদ্ধান্ত  নেব কে সেরা। এরপর আরও  এক বিস্ময়ের  পালা যা হচ্ছে বহড়ু হাই স্কুল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ও আগে এই স্কুলের  প্রতিষ্ঠা এই গ্রামের  বিদ্যানুরাগের কথা বহন করে। এই স্কুলের  প্রাক্তন  ছাত্র প্রখ্যাত  ডাক্তার  শ্রী নীলরতন  সরকারের  নামে একটি ব্লক আছে এবং শ্রী জ্ঞান ঘোষের ও যথেষ্ট  অবদান  রয়েছে।  এরপরেই  আসতে হবে  সেই পণ্ডিতালয়ের  দুর্গা পূজো। এই পূজার  প্রতিষ্ঠা হয় শ্রী কৃষ্ণগোপাল পণ্ডিতের  হাত ধরে। স্বপ্নাদিষ্ট  কৃষ্ণগোপাল আদেশ  পান মায়ের পূজো শুরু করার। কিন্তু নবমীর  রাতে তিনি আদেশ  পান তাঁকে যেন বিসর্জন  না দেওয়া হয়। সেই থেকে মানে নিরানব্বই  বছর  আগে শুরু হওয়া সেই মায়ের প্রতিমা আজও সেই এক, কেবল প্রতিবছর মায়ের  রঙ ও শাড়ি পাল্টানো হয়। তাঁর ই নাতি শ্রী উমাপদ চক্রবর্তীর এখনও  পালাক্রমে চালিয়ে আসছেন  এই মায়ের  পূজো। যেহেতু প্রতিমার  বিসর্জন  হয়না, সেইকারণে  প্রতিদিন  দুবেলা মায়ের  পূজো হয়। এটা যে কত কঠিন  কাজ তা যাঁরা এটা চালান তাঁরাই জানেন। অঞ্জলি দিয়ে , প্রসাদ  খেয়ে আবার  মাণিক বাবুর  পৈতৃক  বাড়িতে যাওয়া হলো এবং তাঁদের  বাড়িতেও প্রতিষ্ঠিত  মা শীতলার  মন্দির  দর্শন  করলাম।  মানিকবাবুর বাবা তিরানব্বই  বছরের  বৃদ্ধ কিন্তু তাঁর  অসাধারণ  স্মৃতি এবং আমাদের  দেখে অত্যন্ত  খুশি হলেন।  মাণিক বাবুর  নানান দিকে আগ্রহ। তাঁর  বাড়ির  সামনে বিশাল  পুকুরে ছিপ ফেললাম  কিন্তু আমার  তিনবারের প্রচেষ্টা বিফল করে দিয়ে মাছ চারা খেয়ে চলে গেল  কিন্তু অর্জুনের  একবারের প্রচেষ্টাতেই একটা বেশ বড় মাছ ধরা পড়ল এবং মাণিক বাবুর কয়েকবারের প্রচেষ্টায় একটা মাছ ধরা পড়ল।  মাছধরার একটা আলাদাই  আনন্দ। কারেনুমতি বৌদির প্রচেষ্টাও  সফল হলনা।  ভোগ খাওয়ার  এক আলাদা আনন্দ।  ঐ সীমিত  ক্ষমতার  মধ্যেও  চক্রবর্তীবাবুদের যা আতিথেয়তা তা হৃদয়স্পর্শ করে গেল।  আবার  আসতে হবে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঐতিহাসিক  বহড়ু গ্রাম  থেকে বিদায় নিলাম। 

Wednesday, 18 October 2023

শারদীয় আর্ট গ্যালারি পরিক্রমা

কলকাতায় প্যাণ্ডেলে প্যাণ্ডেলে ঘুরে দেখার বয়সটা পেরিয়ে গেছে, তবু মাঝে মাঝেই মনটা কেমন অশান্ত হয়ে ওঠে, ফিরে যেতে চায় শৈশবের দিনগুলোতে। অর্জুন  আমাদের  দুর্দান্ত প্ল্যানার,  যা কিছু করে সমস্ত কিছু ভেবে চিন্তে। ঠিক  করে ফেলল কিভাবে যাওয়া হবে এবং কোথায় কোথায় যাওয়া হবে। বড়দা যুধিষ্ঠির এবং নিজের রথে    আমাদের     নয়জনের   ( দুঃশলা বোন সমেত) যাত্রা শুরু হলো দ্বিতীয়ার দিন।অনেকদিন  ধরেই  ভীম ও ভালান্দ্রা অসুস্থ  থাকায় পঞ্চপাণ্ডবের একসঙ্গে যাত্রা আর হয়ে ওঠেনা কিন্তু উপরি পাওনা ভগ্নী দুঃশলার  উপস্থিতি যিনি কৌরব ও পাণ্ডবদের একমাত্র  বোন এবং সবার  প্রিয়পাত্রী। যাই হোক অর্জুনের রথে যুধিষ্ঠির, নকুল ও সহদেব  মিলে চারজন  এবং যুধিষ্ঠিরের রথে দেবিকা, সুভদ্রা,কারেনুমতি ,বিজয়া এবং দুঃশলাসহ মোট পাঁচজন বেরিয়ে পড়লাম।  সারথি দুজনেই  খুব কুশলী  এবং কলকাতার  রাস্তার  অলিগলি সবই চেনে নিজের  হাতের তালুর মতো।
বাইপাস ধরে উল্টোডাঙা হয়ে সোজা পাইকপাড়ায়  টালাপার্কে প্রত্যয়ের প্যাণ্ডেলে হাজির  হলাম।  বিরাট  এলাকা জুড়ে এই প্যাণ্ডেল। একপ্রান্তে ঢোকা এবং অন্য প্রান্তে বেরোনোর রাস্তা। মহিলাদের  প্রায় সকলের ই পায়ের  সমস্যা, দুলকি চালে চলতে নেয় অনেক সময়।বাকি  চার পাণ্ডবদের ও বয়স যথেষ্ট  হয়েছে এবং যুধিষ্ঠির ও সহদেবের দুই  হাঁটুই প্রতিস্থাপন হয়েছে কিন্তু অর্জুন ও নকুল এরই মধ্যে একটু বেশিই সক্ষম। চলছি তো চলছিই,  এক রাজবাড়ির আদলে তৈরী হয়েছে প্যাণ্ডেল। কি অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল   এই  অসাধারণ শৈল্পিক প্যাণ্ডেল।  ভাবছিলাম  এই শিল্পকর্মের পিছনে কার মাথা রয়েছে? এই শিল্পীদের  বেশিরভাগ ই বেশ গরীব  কিন্তু দারিদ্র্য  তাদের  শিল্পীসত্ত্বাকে ধ্বংস  করতে পারেনি। নামটা জানার ঔৎসুক্য  ছিলই কিন্তু ঠাউরে উঠতে পারছিলাম না কার কাছে জানা যায়। কিন্তু উদ্যোক্তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ  পেয়েছে শিল্পীদের প্রতি  এবং  বাইরে বেরোনোর মুখে বড় বড় করে শিল্পীদের নাম লেখা আছে, " সুশান্ত শিবানী পাল।" খুব ভাল লাগল এই ধরণের ব্যবহারে। সাধারণত  কাজের বেলায় কাজী আর কাজ ফুরালেই পাজী এটাকেই মান্যতা দেওয়া  হয়, কিন্তু এখানে সেটা ব্যতিক্রম। শিল্পীদের  মর্যাদা শুধু টাকাতেই নয়, সম্মান দেখানো খুবই  প্রয়োজন।  কতদিন  ধরে তাঁরা কাজ  করেছেন এবং অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন এই রাজবাড়ির ছবিটিকে। 
এক একসময় মনে হয় যে কি বিপুল পরিমাণ  অর্থ  ব্যয় হয়েছে এই ক্ষণিকের অতিথির জন্য।  সমস্ত কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের এই বিশাল  অর্থব্যয়  কি কোন স্থায়ী শিল্পের  পিছনে খরচ করা যেতনা যেখানে বহুলোকের সংবৎসর অন্নসংস্থান  হয়। অবশ্য  এই ক্ষণিকের  শিল্পকে  কেন্দ্র করেও বহু দরিদ্র  মানুষের  কিছুদিনের অন্নসংস্থান হয়। সবচেয়ে বড় অভিশাপ আজকের  যুগের জমিদারেরা।  সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করে তাদের  টাকায় নিজেদের  আখের গোছান এই বর্তমানের জমিদাররা। শোষণ চিরকাল  চলে আসছে এবং ভবিষ্যতেও  চলবে। যে যখন  সুযোগ  পায় সেই তখন শোষণ করে। সবচেয়ে মজার  কথা এই মহাচোররা  খবরের  কাগজে তাদের  ছবি বা খবর বেরোনোয়  তাদের মানসম্মান হানি হচ্ছে বলে আদালতে দরখাস্ত করেন  এবং মহামান্য  আদালত সংবাদ  মাধ্যমকে  এই খবর প্রকাশে নিরস্ত করেন। আমরা কোন সমাজে বাস করছি? যারা নিগ্রহ করবে তাদের  সুরক্ষা দেব না যারা নিগৃহীত  হচ্ছেন তাঁদের  সহায়তা করব?  মহামান্য  আদালত,  আপনারাও  যদি চোখ বন্ধ করে থাকেন এবং  সংবাদ মাধ্যমের  মুখে কুলুপ এঁটে দেন তাহলে এই নিগৃহীত  মানুষগুলো যাবে কোথায়?  এদের কথা কে বলবে? শিক্ষিত  পাশ করা ছেলেমেয়েদের  জায়গায় টাকার বিনিময়ে চোরগুলো চাকরি পেয়েছে, আপনারা তাদের  সপক্ষে রায় দিচ্ছেন? ধিক আপনাদের,  নিজের বিবেককে  জিজ্ঞেস করুন মহামান্য  আদালত।  আপনারা শুধু নিজেদের ই ছোট করছেন না আপনাদের ভবিষ্যত  প্রজন্মকেও  ধিক্কারের শিকার করে তুলছেন।  একবার শান্তভাবে ভাবুন , মহামান্য আদালত। কথায় আছে আইন সকলের  ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য।  কিন্তু বাস্তবিক ক্ষেত্রে কি সত্যিই  তাই? অর্থবলে বলীয়ান জমিদার রা যখন  ইচ্ছা তাঁদের  বক্তব্য  শোনানোর  জন্য  আপনাদের  দরজা খটখট করতে পারেন  কিন্তু সাধারণ লোকেরা বছরের পর বছর তাদের  বক্তব্য আপনাদের  কাছে  তুলে ধরার চেষ্টা করেও ব্যর্থ  হন। কি বলবেন  আপনারা?
যাই হোক , ফিরে আসা যাক সেদিনের  কথায়। টালা পার্কের প্রত্যয় ছেড়ে যাওয়া হল বাগবাজার সার্বজনীন পূজো মণ্ডপে। সামনের প্রবেশদ্বার বন্ধ। পাশের  দরজা দিয়ে ঢুকে দেখলাম টুকটাক  অনেক কাজ বাকি। কিন্তু মায়ের  সেই সাবেকি মূর্তি মনের অন্তস্থলে ছাপ ফেলে দিল। বিস্ফারিত চোখে মায়ের সেই রূপ মনটাকে দূরে কোথাও  নিয়ে গেল। মাঝখানে সেই বিশাল ঝাড়বাতি এই মণ্ডপের  এক বিশেষ  আকর্ষণ। মণ্ডপের বাইরে মাঠে তখন  দোকান পাট ইতস্তত ভাবে খুলতে শুরু করেছে যেখানে টালাপার্কে দোকান গুলো  বেশ গুছিয়ে  বসেছে। আলু কাবলি, ঝালমুড়ি বা ঘুগনির সুন্দর গন্ধ নাকে ঢুকে মন মাতিয়ে দিয়েছিল কিন্তু অতটা হেলতে দুলতে হেঁটে এসে রথ কখন নিয়ে চলে আসবে সারথিরা  এই ভেবে জিভে জল টেনেই চলে আসতে হল। ভাবলাম  বাগবাজারের মাঠে  হবে ঐসব আলুকাবলির উপর আক্রমণ।  কিন্তু মনের  আশা মনেই থেকে গেল। হলনা কিছুই খাওয়া কেবল লেবু চা ছাড়া। যাওয়া যাক, কুমারটুলির পূজো দেখতে। অনেক মেহনত করে এদিক সেদিক করে সারথিরা যখন  পৌঁছলেন  তখন  গিয়ে শুনলাম যে সাধারণের  প্রবেশ  নিষেধ। মহিলারা অটো রিক্সা চড়ে বড় রাস্তায় এলেন যেখানে সারথিরা  আমাদের  ছেড়েছিলেন কিন্তু তারা  সেখানে নেই এবং বহু লোক এসেছেন  তাঁদের  প্রতিমা নিতে। বিভিন্ন  সাজের মাকে বৃদ্ধ ন্যুব্জ কুব্জ  বাড়িগুলো  লক্ষ্য করছে,  হয়তো  বা আমাদেরকেও।  একদিন এই বাড়িগুলোই ছিল অসাধারণ  সুন্দর।  পাশাপাশি , বিপরীত দিকে সুবিশাল  হর্ম্য প্রাসাদগুলো পরস্পর  পরস্পরের প্রতি স্পর্ধা প্রকাশ করছে যেমন কর্ণ বা অর্জুন  কিংবা দুর্যোধন বা ভীমের  প্রতি। একমনে দেখছিলাম  তাদের  দিকে আর ভাবছিলাম  যে বয়সকালে এঁরা কতই না সুন্দর  ছিলেন। কিন্তু কালের গতিতে  সবকিছুই  হারিয়ে যায় যেমন গেছে এই সুন্দর  প্রাসাদোপম  বাড়িগুলো। চোখে কেমন যেন জল চলে এল।
আহিরীটোলা মণ্ডপে  যাবার ইচ্ছা ছিল  কিন্তু লোকজন জানালো যে  তাদের  মণ্ডপ ও কুমারটুলির মতন। সুতরাং, এবার চাই পেট পূজো।  শতাব্দী প্রাচীন  মিত্র কাফেতে অভিযান  চালাতে  হবে। এটাও অর্জুনের ই পরিকল্পনা।  অতএব চল মিত্র কাফে। অপরিসর জায়গা  কিন্তু শতাব্দীপ্রাচীন  রেস্তোরাঁয় ঢুঁ না মারলে কেমন একটা অপরিপূর্ণতা  থেকে যায়। যেমন বলা তেমন কাজ। কিন্তু ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে তরী। অতএব কর অপেক্ষা।  বেশ দাঁড়িয়েছিলাম  কিন্তু সিগারেটের  গন্ধে গা টা  কেমন ঘুলিয়ে উঠল। এই জীবনে ঐ স্বাদে আমি বঞ্চিত,  সুতরাং এক অস্বস্তিকর অবস্থা।  দেখি,  আমার ই অনতিদূরে এক প্রতীক্ষারত যুগল কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার  যে ভদ্রলোক  পাঁশুটে মুখে দাঁড়িয়ে আর তাঁরই  সঙ্গিনী একটা বেশ বড় মাপের  সিগারেটে টান দিচ্ছে  আর মনের  সুখে ধোঁয়া ছেড়ে অন্য লোকের কাশি উঠিয়ে দিচ্ছেন।  একটু বিরক্ত  হয়েই হাত দিয়ে ধোঁয়াটাকে নাকের  কাছ থেকে  দূরে সরিয়ে বোঝানোর  চেষ্টা করলাম যে নিজের  ফুসফুসটার  বারোটা তো বাজাচ্ছ ই, সঙ্গে সঙ্গে তোমার  সঙ্গী এবং  আমাদের ও। উনি বুঝতে পারলেন ব্যাপার টা এবং সঙ্গে সঙ্গে সরে গেলেন।  সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের  বিষয় যে ঐ   চল্লিশোর্ধ মহিলা আমারই  সামনে বসলেন। আমাদের  নয়জনের অর্ডার দিতে ওদের  একটু দেরী  হচ্ছিল আর ওঁরা দুইজন  থাকায় ওঁদের  তাড়াতাড়ি দিয়ে দিল। আর তাঁরাও ফিস কবিরাজি যত তাড়াতাড়ি পারেন  খেয়ে বিদায় নিতে পারলে বাঁচেন। ভদ্রমহিলার  তিন আঙুলে একটাই আংটি মানে আংটি একটাই অথচ এমনভাবে তৈরী  যে মাঝে একটা পাথর মধ্যমায় এবং দুইদিকে সোনা কিন্তু একটা ভয়ানক  ছবি  ঐ দুই পাশের  আঙুলে মানে  তর্জনী ও অনামিকায় যা রীতিমত ভয়ের  বাতাবরণ তৈরী করে। কে জানে কোন জ্যোতিষীর  পরামর্শে তিনি এটা ধারণ করেছেন।  সে যারই  পরামর্শে উনি ধারণ করে থাকুন না কেন উনি যে পড়াশোনায় সেরকম  কিছু দরের  নন সেটা তাঁর চোখেমুখেই  প্রতিফলিত। যাই হোক,  উনি চলে যাওয়াতে আমি কেমন একটা স্বস্তি পেলাম।  এবার  আসা যাক, একটু মিত্র কাফের কথায়। উনিশশো দশ সালে শ্রী গণেশ  মিত্র এই কাফে খোলেন।  কিন্তু উনি ঠিকঠাক চালাতে না পারায় বছর দুই বাদেই বাল্যবন্ধু  শ্রী সুশীল রায়কে দিয়ে দেন। সুশীলবাবু  ছিলেন  একজন অত্যন্ত  বাস্তব বোধ সম্পন্ন ব্যক্তি এবং একজন দক্ষ ব্যবসায়ী। সেই কারণেই  মিত্র কাফেতে এই কয়টা পূর্তি লেখা আছে।
                   "  মিত্র কাফে "
                 -------------------------
পেট ভরে খাবার  আর প্রাণভরে আড্ডা
উনিশশো দশ সালে শোভাবাজারে শুরু যাত্রা
বন্ধুত্বের মর্যাদা দিতেন সুশীল  রায়
ভালভাবে বুঝতেন  মানুষ  কি চায়।
মিত্র কাফে নাম সেই বন্ধুত্বের  স্বীকৃতি
আজ এই নাম মানেই খাবার আর খ্যাতি
এই রেস্তোরাঁর  কথা আজ কে না জানে
কলকাতা ছাড়াও আছে আরও অনেক স্থানে।

এই মিত্র কাফেতেই আমরা ফিস কবিরাজি , চিংড়ির  কবিরাজি, চিকেন কবিরাজি , ফিস কাটলেট এবং ডায়মন্ড কবিরাজি ধ্বংস করে ফিরে এলাম  বাড়ি আর এইবার  দুঃশলা ভগ্নী এই সমস্ত বিল মেটালেন। প্রথমে নকুল ও কারেনুমতি  এবং পরে সহদেব ও বিজয়াকে রথ থেকে নামিয়ে যুধিষ্ঠির  ও অর্জুন  রথে বাড়ি ফিরে গেলেন। 
একটা কথা বারবার  মনে আসছে।কলকাতা তথা সমস্ত পশ্চিমবঙ্গে এত মহান শিল্পী রয়েছেন  যাঁদের শিল্পীসত্ত্বা এই বিশেষ  সময়ে বিকশিত  হবার  সুযোগ পায়। আগে আঙুলে গোণা কতিপয় শিল্পীর ছবি আর্ট গ্যালারিতে প্রদর্শিত হতো কিন্তু এই শারদোৎসবে এই বৃহৎ আর্ট গ্যালারিতে সমস্ত ছোটবড়  শিল্পীরা তাঁদের  স্থান করে নেন।

Monday, 18 September 2023

শ্রদ্ধার্ঘ্য

আমরা সাধারণত মনীষীদের জন্মদিন  বা মৃত্যু দিন শ্রদ্ধার  সঙ্গে পালন করি এবং কোন  সাধারণ মানুষ  মারা গেলে আমাদের  প্রতিক্রিয়া হয় তাৎক্ষণিক। ভাল  মানুষ  হলে সবাই বলতে থাকে, " আহা, মানুষটা খুব  ভাল  ছিল আর খারাপ  হলে বলে, গেছে, আপদ গেছে চুকে।" কিন্তু ঐ কয়েকদিন  লোকে একটু আধটু হা হুতাশ করে তারপর পৃথিবীর চলার  সঙ্গে তাল  মিলিয়ে লোকে ভুলে যায়। অবশ্য  লোকজন তো পরে, নিজের আপনজন ই শুরু করে দেয় এটা আমার,  ওইটা তোমার ( যদি একাধিক  সন্তান  থাকে)। কিন্তু কিছু কিছু লোক সাধারণ  হয়েও এমন কিছু কাজ করে যায় যেটা কিছু লোক জীবনের  শেষ দিন পর্যন্ত মনে রাখে( অবশ্যই  কৃতার্থবোধ  যদি একান্তই থাকে)। 

এইরকমই  একজন গণপতরাও কদম। কদমজী ছিলেন  আমাদের অফিসার্স কোয়ার্টারের  সিকিউরিটি গার্ড। অফিস  বেরোনোর সময় এবং অফিস  থেকে ফেরার  সময় দেখা হতো যদি তার ডিউটি থাকত। একটু  নাদুস নুদুস গোলগাল চেহারা, মাঝারি উচ্চতা কিন্তু সদা হাস্যময়। আমি যেহেতু একা থাকতাম সেইকারণে টুকটাক  কিছু কথাবার্তা আমার  সঙ্গে সবসময়ই  হতো। রিটায়ার করার  কিছুদিন আগে আমার ছেলে ট্রান্সফার  হয়ে এল এবং আমার সঙ্গেই  থাকল। রিটায়ার করার  পরেও  কিছুদিন ছিলাম অফিসের  কোয়ার্টারে এবং সেই সুবাদে সমস্ত  স্টাফদের  সঙ্গে সখ্যতা আরও  নিবিড় হয়েছিল। টুকটাক কাজ এই কদমজী বা শেলকে জী বা পাটিলজীরাই করে দিত। অফিস  থেকে ফেরার পথে প্রায়ই জিলাপি বা সিঙারা বা কোন খাবার কিনে আনতাম শুধু নিজের জন্যই নয় এই সিকিউরিটি গার্ড  বা সুইপারের জন্য ও আনতাম। প্রথম প্রথম একটু কুণ্ঠিত হয়ে নিত কিন্তু পরে তারাও খুব স্বাভাবিক হয়ে গেছিল।  এরই মধ্যে কিছু কাজের  জন্য কলকাতায় আসতে হয়েছিল  ছেলের  বিয়ের ব্যাপারে। রান্নার জন্য  শোভা দিদি আসত, সুতরাং খাওয়া দাওয়ার অসুবিধে হচ্ছিল না। একদিন সন্ধে বেলায় হঠাৎই  মোবাইলটা বেজে উঠল। দেখি কদমজীর ফোন।  কি ব্যাপার,  কদমজী? ওর উত্তর  শুনে মাথা ঘুরে গেল। ছেলের ভীষণ জ্বর, চোখ খুলতেই পারছে না তো কথা বলা তো দূরস্থান। সেদিন  ছিল রবিবার,  কোন ডাক্তার পাওয়া যাচ্ছে না। আমি কতকগুলো জ্বরের  ওষুধ বলে দিলাম এবং খাওয়াতে বললাম।  কিন্তু কদমজী তাঁর পরিচিত  এক ডাক্তারের  বাড়ি নিয়ে গেল ছেলেকে এবং অনেক অনুরোধ  করে তাঁকে দেখতে রাজি করালেন। উনি তাঁর পরিচিত  এক ডায়গনস্টিক ক্লিনিকে ফোন করে রক্ত পরীক্ষার  ব্যবস্থাও  করলেন এবং কদমজী সমস্ত  পরীক্ষা করিয়ে ছেলেকে বাড়ি ফিরিয়ে আনলেন এবং ডিউটির রোস্টার বদল করে সারারাত ছেলের  পাশেই থাকলেন । পরে আমার  অনুরোধ মতন প্যারেল থেকে বম্বে এয়ারপোর্টে  ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে এবং বিমান কর্মীদের  সমস্ত  কিছু অবগত করালেন।  আমরা কলকাতা এয়ারপোর্ট ওকে নিয়ে সোজা হাসপাতালে  ভর্তি করে দিলাম।  আবার  রক্ত পরীক্ষার পরে ডেঙ্গি ধরা পড়ল এবং প্ল্যাটিলেট কাউন্ট বিপদসীমার  অনেক নীচে। সবাই  খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম।  তিনদিন  বাদে ছেলের  বিয়ের রেজিস্ট্রেশন হবে অথচ প্ল্যাটিলেট সংখ্যার  সেরকম  কোন  উল্লেখযোগ্য  বৃদ্ধি হচ্ছে না । মেয়েদের বাড়িও ভীষণ  উদ্বিগ্ন,  আমরা তো বটেই। রেজিস্ট্রেশনের  আগের  দিন  আমরা বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলাম কিন্তু ডাক্তার ছাড়তে রাজি নন। শেষ পর্যন্ত বণ্ড সই করে ওকে বাড়ি নিয়ে এলাম  কিন্তু একটা ভয় শেষ পর্যন্ত থেকেই  গেল। ভগবানের আশীর্বাদে সবকিছুই  নির্বিঘ্নে মিটে গেল কিন্তু আমার  ঙ কদমজীর কথা মনেই থেকে গেল।

কদমজীর  অ্যাকাউন্ট নম্বর  নিয়ে ছেলের জন্য  যা খরচ করেছিল তা পাঠিয়ে দিলাম  এবং ছেলের  জীবন  ফিরে পাবার জন্য মনে মনে ভগবানকে এবং তাঁর ই প্রতিনিধি কদমজীকে অনেক ধন্যবাদ  জানালাম।  এরপর অনেকবার  বম্বে এসেছি এবং কদমজীর  সঙ্গে দেখাও করতে গিয়েছি কিন্তু দেখা হয়নি কোন না কোন কারণে। কোন  সময় ওঁর ডিউটি রাত্রিবেলায় নয়তো ডিউটি করে চলে গেছে বা নিজের  গ্রামে গেছে। বছর চারেক আগে  ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনাস থেকে আসার  সময় প্যারেল  হয়ে এসেছি কিন্তু কদমজী ছাড়া বাকি সকলের  সঙ্গেই  দেখা হয়েছে। ওদের  চীফ সিকিউরিটি অফিসার শেলকেজীর হাতে মিষ্টির  বাক্সটা দিয়ে কদমজীর কথা জিজ্ঞেস করায় উনি জানালেন যে কদমজী চাকরিতে ইস্তফা  দিয়ে পাকাপাকি ভাবে নিজের গ্রামের বাড়িতে চলে  গেছে। সুতরাং সেবারও  দেখা হলো না। গতকাল  একটু হাতে সময় নিয়ে পুরোন  বন্ধুদের  সঙ্গে যোগাযোগ  করতে লাগলাম। ধূমলজী,  ব্যাভারেজী,  কদমজী, শেলকেজী সবাইকেই  ফোন  করলাম  এবং শেলকেজী ছাড়া আর কারও  কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে একটু বেশ ঘাবড়ে গেলাম। শেলকেজীর  মুখে জানলাম যে কদমজী করোনার  করাল গ্রাসে নিমজ্জিত  হয়েছেন  এবং  পরে ব্যাআরেজীর ফোনে জানলাম যে আমার অত্যন্ত  ঘনিষ্ঠ সহযোগী  ধূমল ও করোনার শিকার  হয়েছে। মনটা ভীষণ ভারাক্রান্ত  হয়ে গেল। রক্তের  সম্পর্ক  না থাকলেও এদের  কাছ থেকে যা পেয়েছি তা অমূল্য  এবং ভগবানের  কাছে প্রার্থনা করি যেন তিনি এই মহাত্মাদের তাঁর চরণে স্থান দেন।

Thursday, 10 August 2023

তিলু নাপিতের বাড্ডি

তেলুগু ভাষায় বাড্ডি শব্দর অর্থ ছোট দোকান।  তিলু পরামাণিক যে কি করে অন্ধ্রপ্রদেশের ভাইজাগ শহরে এসে জুটেছিল সেটা কেউ জানেনা। হয়তো তার বাপ ঠাকুর্দা বন্দর শহর ওয়ালটেয়ারে ( ভাইজাগের  পুরোন নাম) কাজের সূত্রে এসেছিল এবং তারপর সেখানেই থেকে গেছে বংশানুক্রমে। তিলু পরামাণিক নামেই বাঙালি, কিন্তু ওখানে থাকতে থাকতে তাদের  ভাষা, চলন বলে সবই রপ্ত করে ফেলেছে তাদের মতন। তিলুর ছেলেমেয়েরা সবাই  তেলুগু মাধ্যমেই  পড়াশোনা করে এবং তার বৌ ও তেলুগু।  এসব  সত্ত্বেও তিলু  নিজেকে  বাঙালি  বলেই পরিচয় দেয় এবং বাঙালিদের অনুষ্ঠানে নিজেদের  সামিল  করে।

তিলুর বাড়ি পুরোন শহর বন্দরের  কাছাকাছি।  পূর্ণ মার্কেটে বাজার  করতে গিয়ে মাছ কেনার  সময় হলো আলাপ। মাছ বিক্রেতা  মহিলা( যাকে আমি দিদি বলে ডাকতাম) কোন  এক সময়  কলকাতায় থাকার দরুন  বাঙলা বলতে পারত এবং কলকাতা থেকে দক্ষিণ দেশে গিয়ে ভাষার  সমস্যার জন্য কেউ যদি বাঙলা বলতে পারে বা বুঝতে পারে এমন লোকের সঙ্গে পরিচিত  হতে পারে তবে তার মনে হয় যেন সে হাতে চাঁদ পেয়ে গেছে।  সুতরাং মেছুনি দিদি ও তিলুর সঙ্গে আলাপ  হওয়ার মানে  যেন আকাশে ডানা মেলে ওড়া। মেছুনি দিদির এক বোন আবার  আম বিক্রি করত। সুতরাং আম কিনতে হলে ঐ ছোড়দিদির কাছেই  কেনা হতো। বাজারের  কাছেই  ছিল তিলুর এক ছোট্ট  সেলুন( কাঠের তৈরী) যেখানে মাত্র  দুজনই একসঙ্গে চুল কাটতে পারে।  তিলু মোটামুটি ভাবে সারা সপ্তাহ  একাই সামাল দেয় কিন্তু রবিবার বা ছুটির  দিন ছেলে এসে বাবাকে সাহায্য  করে। যাই হোক, বাজার  করতে এসে চুল কেটে বাড়ি ফেরা একদম রথ দেখা কলা বেচার মতন। তিন বন্ধু আমরা একসঙ্গে বাজার  যেতাম তিনটে  স্কুটারে এবং  মাসে একবার  হতো তিলুর দোকানে লেবু দিয়ে সোডা খাওয়ার ধূম। ওখানে কলকাতার  মতন যত্রতত্র চায়ের দোকান  মেলেনা কিন্তু পাওয়া যায় লেবু সোডা বা ঘোল( বাটার মিল্ক)। যা রোদের  তেজ নিম্বু সোডা  বা বাটার মিল্ক ছাড়া চলাও  যায় না।

সব সেলুনেই একই ছবি বিশেষ করে মফস্বল বা ছোট  শহরে। বম্বেতে কারও দম ফেলার সময়ই  নেই,  সবাই যেন  ছুটছে তো ছুটছেই।  চার্চগেট  স্টেশনে  ট্রেন  ঢুকছে আর শয়ে শয়ে  লোক সব রেডি হয়ে আছে ঐ ট্রেন  থামার আগেই উঠে পড়বে একটু  বসার জায়গা পাওয়ার জন্য। ঐ সময় কে ধাক্কা  খেয়ে পড়ল বা পড়ে যাওয়া লোকটাকে পদপিষ্ট করে চলে গেল কিনা কারও  ভ্রূক্ষেপ নেই। কলকাতায় ও বনগাঁ লোকালেও প্রচণ্ড  ভিড়  হয়  কিন্তু বম্বের  ভিড়ের  কাছে  কিছুই  নয়। সুতরাং আমাদের মতন লোকের পক্ষে ঐরকম  কিছু করা সম্ভব  নয়। পড়ে  যাওয়া লোকটাকে উঠিয়ে একটা বেঞ্চে বসিয়ে তার  ছিটিয়ে পড়া কাগজ পত্রগুলো উঠিয়ে দিয়ে একটু ফার্স্ট এড দেওয়ার  চেষ্টা থাকে। যাই হোক, পুরোন  প্রসঙ্গেই  ফিরে আসা যাক। 
সমস্ত  নরসুন্দরের মতন তিলুর ও স্টকে  থাকা নানাধরণের গল্পের  স্টক থেকে  একটার পর একটা  গল্প বেরোত চুল কাটার  ফাঁকে ফাঁকে।  নরসুন্দরদের এটা একটা বিরাট গুণ। অবাধ গতি ওদের নানান বিষয়ে সে শিল্পকলাই  হোক বা রাজনীতিই  হোক। অন্ধ্রপ্রদেশে অবশ্য  রাজনীতি নিয়ে বিশেষ  কেউ মাথা ঘামায় না যতটা আমাদের কলকাতায় বা পশ্চিমবঙ্গে হয়। ভোটের  সময়  স্কুটার বা মোটরসাইকেলের সামনে লাগানো পতাকা  দেখেই বোঝা যায় সে কোন দলের।  কিন্তু না, সেখানে না আছে কোন  মারদাঙ্গা বা বুথ দখল বা রিগিং।  ভোটের  সময় শেষ তো সব দ্বিচক্রযান পতাকামুক্ত আর একঠেকেই আড্ডা বা পানভোজন। তিলুর কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের  ভোট নিয়ে বিশেষ আগ্রহ।  কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম  ওর কটা ছেলেমেয়ে? উত্তরে জানায় ওর পাঁচ ছেলে ও একটা মেয়ে।  
অ্যাঁ, পাঁচটা ছেলে ও একটা মেয়ে মানে তোমাদের  সংসারে আটজন সদস্য! একটু আশ্চর্য  হয়েই জিজ্ঞেস  করলাম তোমার  বয়স কত এবং  আজকের  দিনে এত বড় সংসার!  ও কিন্তু ভীষণ  সপ্রতিভ ভাবেই উত্তর  দিল যা শুনে তো আমরা তিনজনেই  হাঁ। 
ঐ যে ছেলেটাকে দেখছেন ও আমার  সেজ ছেলে। 
অ্যাঁ, সেজছেলে? আর বাকি রা কোথায়?
বড় দুই ছেলে ছোট  দুজনকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে আছে।
গ্রামের  বাড়ি! কোথায় তোমাদের  গ্রাম?
আর বলবেন না। বসিরহাটের কাছে আমাদের  পূর্বপুরুষের  বাড়ি। বড় ছেলে শাসকদলের পঞ্চায়েত সদস্য।  মেজ ছেলেকে কিন্তু বলেছি বিরোধীদলে থাকতে কারণ যতই  পালাবদল  হোক না কেন আমাদের  বাড়িতে যেন কোন আঁচ না আসে।  ছোট  দুজন এখনও  পড়াশোনা করছে। ওদেরকেও  বলে দিয়েছি বাড়িকে  সুরক্ষিত রাখতে গেলে যত পার্টি আছে সবজায়গায় যেন  আমাদের  বাড়ির  কোন  না কোন সদস্য  থাকে। 
কথায় আছে, জীবজন্তুর  মধ্যে শিয়াল,  পাখির মধ্যে কাক আর মানুষের  মধ্যেএই নরসুন্দর  অসম্ভব  চতুর। বাজারের  থলিগুলো  স্কুটারেই  আটকানো রোদেই  শুকাচ্ছে।  চুলকাটা শেষ করে তিনবন্ধুর বাড়ি ফিরে আসা এবং  প্রত্যেক  মাসেই  নিজের  নিজের  বাড়িতে গঞ্জনা শোনা আর ভগবানের  আশীর্বাদে এক কানে শোনা এবং অপর কান দিয়ে নির্গমনের ব্যবস্থা করা।

Thursday, 3 August 2023

ছোট্ট পৃথিবী

সোমবাবুর রোজ একবার  বাজারে যাওয়া চাই। কিছু লাগুক বা না লাগুক প্রত্যেক দিন  অভ্যেস বশত একবার  চক্কর না দিলে সোমবাবুর দিনটা যেন কেমন  পানসে হয়ে যায়। আর যাওয়া মানেই প্রয়োজন  না থাকলেও কিছু না কিছু উনি আনবেনই আর গিন্নীর কাছে অবধারিত ভাবে বকুনিও খাবেন। মাঝে মাঝেই বকুনির  মাত্রাটা একটু বেশি হয়ে গেলে সোমবাবুর বাইরে বেরিয়ে যাওয়া এবং সেটাও  ঐ বাজারমুখী কিন্তু এবার  আর কোন জিনিস  আনা নয়, ওঁর মনটাকে একটু শান্ত করা। বন্ধুরা বলেন  আপনার  ঐ বাজারে কি আছে বলুন তো? রোজ ঐদিকে না গিয়ে একটু আধটু অন্য দিকে কি যেতে পারেন  না? গিন্নীর বকুনি আর বন্ধুদের শ্লেষ প্রায় একই রকম মনে হয় তাঁর কাছে। আসলে উনি যান এক বিশেষ টানে। কত রকমের লোক জন আসে বাজারে, তাদের  মানসিকতা তাদের  কেনাকাটার মাধ্যমে বোঝা যায়। কেউ এমন দরদস্তুর করে যে বিক্রেতা তাদের  আসতে দেখলেই ভাল জিনিস টা প্লাস্টিকের থলিতে ভরে রেখে দিয়ে বলে ওটা বিক্রি হয়ে গেছে। আবার  কিছু লোক এসে দাঁড়াতেই তারা বুঝে যায় যে কি জিনিস নেবেন  এবং কতটা নেবেন এবং সেই মতো বেছে বেছে ভাল জিনিসটা তাঁদের  জন্য  রেডি করে রাখে। এঁরা কোন দর দাম করেন না এবং টাকার  হিসেবটাও  করেন না। ওঁরা ভাল করেই জানেন  যে এইলোকটা তাঁর কাছে বেশি দাম নেবেনা এবং অবশ্যই ভাল জিনিসটাই  দেবে। কিন্তু সব মানুষ  তো সমান হয়না এবং বিক্রেতাদের ও সেই অনুযায়ী স্ট্র্যাটেজি নিতে হয়।

পচা মাছওয়ালা কিন্তু একেবারেই  পচা মাছ বিক্রি করেনা বরঞ্চ তার মাছটাই বাজারের  সেরা মাছ। কিন্তু সেই ছোট বয়সেই তার বাবা মায়েরা তার নামটা পচা দেওয়ায় এবং ভাগ্যের দোষে বা গুণে তাকে মাছ বিক্রি করতে হওয়ায় তাকে সবাই  পচা মাছওয়ালা বলেই ডাকে। মাঝেমধ্যে যে একটু মন খারাপ  হয়না তা নয় তবে তার যা বিক্রি তাতে বেশিক্ষণ  মন খারাপ করার  মতো সময় তার থাকেনা। পচার পাশে পানুবাবু অন্য রকম মাছ রাখেন এবং তাঁর খরিদ্দার ও সব বাঁধা। আর মাছ কিনতে গেলে চেনা লোকের কাছেই কেনা উচিত  নাহলে ঠকে যাওয়ার  সম্ভাবনা প্রবল। সোমবাবু আবার  মাছের  ভীষণ  ভক্ত নন কিন্তু কিনলে হয় পচা নাহলে পানুবাবুর কাছেই কেনেন। সমস্ত মাছবিক্রেতাই  কর্পোরেশনের তৈরী উঁচু দাওয়াতে  বসে এবং প্রত্যেকের বিক্রি করার জায়গার  নীচে একটা ছোট্ট  গোডাউন মতো আছে যেখানে অবিক্রিত মাছগুলো নুন আর বরফ মেশানো ক্রেটের মধ্যে থাকে এবং বাইরে থেকে তালা দেবার  ব্যবস্থাও  রয়েছে। সেইরকম  মাংস বিক্রেতাদের ছোট্ট গোডাউনে ছাগল  ভরা থাকে। তবে দাওয়ার  ওপর বসে বিক্রি করতে হলে কর্পোরেশনকে টাকা দিতে হয় এবং স্থানীয় নেতাদের  চাহিদাও  মাঝেমধ্যেই পূরণ  করতে হয়। বাজারের  ভেতর  যারা মাটিতে বসে তাদের  দক্ষিণার মাত্রা কম হয় এবং বাজারের  বাইরে রাস্তার  দুধারে বসা বিক্রেতারা  কেউই এই কুচো নেতাদের হাত থেকে রেহাই  পায়না। আগে যারা সাইকেল  চালিয়ে আসত, এখন তারা আসে মোটর সাইকেলে।  চোখদুটো লাল ভাঁটার মতো, মনে হয় ক্লিপ দিয়ে চোখের  পাতাটা আটকে রেখে চোখটা খোলা রেখেছে। কাশীনাথের কাছে মোটরসাইকেল থামিয়ে জলদগম্ভীর স্বরে বলে ওঠে দাদা," শোন্ এইসবগুলো বাড়িতে দিয়ে আয় তাড়াতাড়ি।" কাশীনাথ তার খরিদ্দারদের দাঁড় করিয়ে রেখে ভয়ে আগে তার ফরমায়েশ মতো জিনিসগুলো দিয়ে আসে। ওর দেরী হলে পরদিন  থেকে ওর বাজারে  আসা বন্ধ এবং রোজগার পাতিও বন্ধ। সোমবাবুর ইচ্ছে করে টেনে দুই চড় লাগাতে কিন্তু সেই দাদার  ভয়ে সবাই  তটস্থ কারণ ও সেখানকার  কাউন্সিলরের ডানহাত, প্রোমোটারি করে, দালালি করে এবং নানাউপায়ে নিজের ও কাউন্সিলরের পকেট ভরে। সুতরাং তাকে ঘাঁটানো  মানে সাপের  লেজে পা দেওয়া। অত সাহস কার আছে? সবচেয়ে মজার  ব্যাপার  যে যদি কোন  পটপরিবর্তন হয় তাহলেও  এরা কিন্তু সেই একই জায়গায় থাকবে কারণ এরা হচ্ছে বাহুবলী কেবল মনিবটা  রামের  জায়গায় শ্যাম হবে।

পচা মাছওয়ালার উল্টোদিকে মহাদেব  বসে সামান্য  কাঁচা লঙ্কা, কাঁচা হলুদ, ধনেপাতা আর কারিপাতা  নিয়ে। সামান্য পুঁজি, সামান্য ই মালপত্র,  কিই বা বিক্রি করবে আর কিই বা লাভ হবে আর পেটটাই  বা কিভাবে চলবে? সোমবাবুর কোন  দরকার  না থাকলেও  ঐ মহাদেবের  দর্শন চাইই চাই। রোজ বাজারে গিয়ে দশ কুড়ি টাকা ওকে দেওয়া চাই। নামটাই মহাদেব,  শীর্ণকায় হাড় জিরজিরে চেহারাটার  দিকে চোখ পড়লে চোখে জল এসে যায়। সোমবাবুর ঐ সামান্য সাহায্য ওকে খুব অল্প  হলেও  সাহায্য করে। ঐ মায়াময় চেহারাটার দিকে নজর পড়লেই সোমবাবুর আর মাথার  ঠিক থাকেনা। মহাদেব  লজ্জ্বার খাতিরে সামান্য  হলেও  কিছু জিনিস  দিতে চায় যেটার দরকার নেই আদৌ এবং আনলেও বাড়িতে অশান্তি। এই টানাপোড়েনের মধ্যেই  চলে সোমবাবুর  আনাগোনা।
এরই মাঝে এসে গেল করোনার  মহামারী। বাজারের সব ঝাঁপ বন্ধ। লোকজন  ঠেলায় করে তরকারিপাতি বাড়ির সামনে নিয়ে আসছে। আবাসনের  বাসিন্দারা থলি ঝুলিয়ে মালপত্র  তুলে নিচ্ছে এবং টাকাপয়সা দিয়ে দিচ্ছে এবং বাকি টাকাও ঐ থলির মাধ্যমেই  ওঠানামা করছে। ঐ সবজিগুলো স্যানিটাইজার দিয়ে একপ্রস্থ মাখামাখি হবার পরে আবার  যতটা সাবধানে সম্ভব  ধোওয়া হচ্ছে এবং তার ব্যবহার হচ্ছে। ধীরে ধীরে করোনার প্রকোপ কমে এসেছে। লোকজন বাজারে প্রায় নিয়মিত  হয়ে এসেছে। পচা মাছওয়ালা, পানুবাবু, কাশীনাথরা সবাই আছে কিন্তু মহাদেবের জায়গাটা খালি। সোমবাবু কয়েকদিন গিয়েছেন এবং মহাদেবের  খোঁজ করেছেন  কিন্তু কেউ কোন  খবর দিতে পারেনি। হঠাৎই  যেন  মহাদেব  উধাও  হয়ে গেল  বাজার থেকে, জানিনা করোনার  প্রকোপে  না খিদের জ্বালায়? বাজারে আসার  তাগিদটাই যেন  হারিয়ে গেছে সোমবাবুর কাছ থেকে।

Saturday, 22 July 2023

নদীবক্ষে নিশিযাপন

নৌকায় চড়া বা লঞ্চে যাওয়া বা স্টিমারে পাড়ি দেওয়ার অভিজ্ঞতা বেশ ভালোই হয়েছে কিন্তু নদীবক্ষে নিশিযাপন করার  সুযোগ কোনদিন  হয়নি।সেই সুযোগ ও এসে গেল যখন আমাদের অর্জুন বলল যে ফ্লোটেলে একটা রাত্রি কাটালে কেমন হয়? সবাই  একযোগে মাথা নাড়ালো, বলল ভালোই প্রস্তাব। কথায় আছে যে খায় চিনি তাকে যোগান চিন্তামণি । কিন্তু মনের মধ্যে একটা সংশয় থেকেই যায়, কতটা ব্যয়সাপেক্ষ হবে সেই থাকাটা। অর্জুন কিন্তু ব্যাপারটা আঁচ করে ফেলেছে ততক্ষণে, বলল,"না ,সেরকম কিছুই  নয়, আসলে ও একটা অনুষ্ঠান করার জন্য কয়েকটা ঘর বুকিং বাবদ কিছু টাকা অ্যাডভান্স দিয়েছিল কিন্তু অনুষ্ঠান সূচি বদলে যাওয়ায় ওকে অন্য ব্যবস্থা করতে হয়েছে এবং ফ্লোটেল কর্তৃপক্ষ ও টাকা ফেরত দিতে রাজী  নয়। অতএব,  ঐ টাকা অ্যাডজাস্ট  করতে  হলে ওখানে গিয়েই থাকতে হবে।"  একটু কেমন কেমন লাগছে অথচ অর্জুন টাকাও নেবেনা আমাদের  কাছ থেকে। প্রথমে একটু নিমরাজি  থাকলেও ক্যাপ্টেনের  কথা ফেলা যায় না। অতএব  ঠিক হলো যে  একুশে মে শনিবার যাওয়া হবে এবং ওখানে রাত কাটিয়ে রবিবার  ফিরে আসা।

ফ্লোটেল হচ্ছে একটা সুন্দর ছোট্ট জাহাজ যেটা স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার পূর্বাঞ্চল লোকাল হেড অফিসের  উল্টোদিকে।  কয়েক বছর আগে আমাদের  স্কুলের     বন্ধুদের প্রায় একান্ন বছর বাদে গেট টুগেদার  হয়েছিল  এবং ওখানে আমরা ডিনার করেছিলাম  কিন্তু থাকার সুযোগ ঘটেনি। ওখানে দুটোর  সময় চেক ইন, কিন্তু খাওয়া দাওয়া সেরে পৌঁছাতে প্রায় বেলা চারটে। অর্জুন  বিরাট বড় প্ল্যানার, খুঁটিনাটি  সবকিছুই  একদম ঠিকঠাক ।নয়জনের  চারটে কেবিন এবং সবটাই গঙ্গার  দিকে কিন্তু একটা কেবিন  হয়ে গেল  অন্য ডেকে। কিন্তু অর্জুন  চাইছে সবার একটা ডেকে ই  হোক। রিসেপশনে একটা ছোট খাটো চেহারার মেয়ে কিন্তু অসম্ভব  ঝকঝকে চেহারা এবং ভীষণ  স্মার্ট। নাবিকের  ড্রেস, মাথায় তাদের  মতন টুপি-- এককথায় বলা যেতে পারে নাবিকোচিত। সুন্দর আঙুলগুলো  যথোচিত ম্যানিকিওর করা এবং বিভিন্ন  আঙুলে বিভিন্ন রকম চিত্র। ল্যাপটপে তার আঙ্গুলগুলো নটরাজের  নৃত্য করছে এবং অসম্ভব দক্ষতার সঙ্গে অর্জুনের সঙ্গে মোকাবিলা করছে। যদিও  সে বলল যে একটা ডেকে ই করে দেবে কিন্তু  শেষমেশ  তা হলো না । তখন  নিজেরাই বলাবলি করলাম যে একটাই তো রাত্রি, কেটে যাবে কোনভাবে।

বিকেল বেলায় ঠিক  আছে গঙ্গারতি দেখার।  অর্জুন  তার ও ব্যবস্থা করে রেখেছে। গাড়িগুলো আমাদের  ছেড়ে দিল যেখান  থেকে লঞ্চটা ছাড়বে কিন্তু একটু ভুল বোঝাবুঝির জন্য  অনেকখানি পিছনে হেঁটে আসতে হলো এবং দেখা  গেল যে ফ্লোটেল থেকে হেঁটেই  আসা যেত। যাই হোক, তিনটে লঞ্চ পেরিয়ে আমাদের  লঞ্চে পৌঁছলাম।  লঞ্চের  ওপরের  ডেকে উঠতে সব নড়বড়ে বুড়োবুড়িদের একদম দফারফা। যাই হোক, ওপরে উঠে বসার পর ইঞ্জিন  স্টার্ট করল আর ধীরে ধীরে যেখানে আরতি হচ্ছিল  তার একটু দূরেই নোঙর করল। বারাণসীর আদলে এখানে গঙ্গা আরতি শুরু হলো। একদিকে সূর্যাস্ত, অন্যদিকে আরতি এবং পিছনে মাঝে মাঝে চক্ররেলের হর্ন মিলেমিশে এক অন্য আবহাওয়ার সৃষ্টি হলো। গঙ্গার  জলের  যে ভিন্ন ভিন্ন রঙ হয় তা না দেখলে বিশ্বাস ই করা যায়না। ছবিগুলো মনের  মধ্যে গেঁথে আছে যেটা এখানে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আরতি শেষে  লঞ্চ  আবার  স্টার্ট করে যেখান থেকে উঠেছিলাম  সেখানেই নামিয়ে দিল এবং বাবুঘাটে স্পেশাল চা খেয়ে এলাম ফিরে ফ্লোটেলে। বাতাসে আদ্রতা থাকায় ঘামে জবজব শরীরটা এসে ঠাণ্ডা করে  রাতের  খাবারের জন্য সর্বোচ্চ ডেকে এসে পৌঁছলাম।  হরেক রকমের খাবার,  কোনটা ছেড়ে কোনটা খাব ভেবে  পাচ্ছি না,  তবে তার মধ্যেই  যেগুলো সচরাচর  বাড়িতে খাওয়া হয়না সেগুলোর দিকেই  নজর দিলাম। আগের বার যখন  এসেছিলাম  তখন খাবারের মান ততটা ভাল  ছিলনা কিন্তু এখন বেসরকারি  হাতে যাওয়ায় খাবারের মান এবং সার্ভিসের প্রভূত  উন্নতি হয়েছে। যাই হোক খাওয়া সেরে কেবিনে ফিরে আসা এবং মহিলাদের হাউসি খেলা শুরু।

অবাক হয়ে জানলা দিয়ে গঙ্গার  নানান রূপ  চোখে  পড়ছে এবং মোবাইল ক্যামেরায় একের পর এক ছবি তুলে চলেছি। দুটো পরিবারের  চারজন  দুটো কেবিনে চলে গেল, তৃতীয় কেবিনে তিনজন  মহিলা এবং চতুর্থ কেবিনে আমরা দুই বন্ধু। রাতটা বেশ গভীর  হয়েছে, বন্ধুও  বেশ  গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন আর আমারও  চোখটা একটু লেগে এসেছে। হঠাৎই  যেন মনে হল জাহাজটাকে যেন কেউ ধাক্কা দিয়ে ডাকছে আর বলছে  চল্, এবার  তো ভাসার পালা। এদিকে জাহাজের ও  এলানো   শরীরে ঘুমটা  বেশ জাঁকিয়ে  এসেছে কিন্তু আমি যেন সেই জলের  বার্তা পেলাম " অ্যাই  ওঠ,  ছবি তুলবি না?" আমার  শরীরটা ও যথেষ্ট ক্লান্ত কিন্তু আমি সেই ডাকের হাতছানি  উপেক্ষা  করতে পারলাম না। আস্তে আস্তে বন্ধুর ঘুম না ভাঙিয়ে  একাই নদীর  সঙ্গে প্রেমে মত্ত হলাম।  সোঁ সোঁ করে আওয়াজ  করে জলের  ঢেউ একের পর এক ধাক্কা দিচ্ছে জাহাজটাকে আর দুলে দুলে উঠছে  সেই জাহাজ  মানে আমাদের ফ্লোটেল। একের পর এক ফটো তুলে চলেছি আর তন্ময় হয়ে দেখছি গঙ্গার  রূপ গভীর  নিশীথ রাতে। ডান দিকে দেখছি হাওড়া ব্রিজ আর জেটির  আলো আর বাঁদিকে দেখছি দ্বিতীয় হুগলি ব্রিজের আলো আর মাঝখানে আমি রয়েছি জেগে এই অসাধারণ রূপ দেখার  আশায়।  কখনও কখনও একটা নৌকো লন্ঠন জ্বেলে চলছে মাছ ধরার  আশায়। নিকষ কালো অন্ধকারে সেই চলমান নৌকো এক ভৌতিক  আবেশ সৃষ্টি করেছে। দেখতে দেখতে অন্ধকার আস্তে আস্তে ফিকে হতে লাগল এবং ভোরের আলো ফুটে উঠল। কিন্তু সমস্ত  রাত্রির  জাগরণ শরীরে কোন ক্লান্তির  ছাপ ই ফেলতে পারেনি কারণ আনন্দটা যে পরিমাণ  উপভোগ করেছি তা ক্লান্তিকে  আসতে দেয়নি। কেবিনে থাকা চায়ের ব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে চাঙ্গা হয়ে সাতসকালেই হাঁটতে বেরিয়ে পড়লাম হাইকোর্ট পাড়ার গলিতে। ফিরে এসে স্নান করে দুর্দান্ত  ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ির  দিকে। ফেরার  পথে এলগিন রোডে আমূলের এক দোকানে নানাধরণের আইসক্রিমের স্বাদ চেটেপুটে  নিয়ে সোজা বাড়ি।
অসাধারণ এই ফ্লোটেলে থাকার  অভিজ্ঞতা বিশেষ করে রাতের বেলায় গঙ্গার এই আকর্ষণীয় রূপ  চিরদিন  মনে রাখার মতো।

Thursday, 20 July 2023

পথ চলাতেই আনন্দ ( চার)

পরিকল্পনা করার পর কোন  জায়গায় যাওয়া হলে আনন্দ  অবশ্যই হয় কিন্তু হঠাৎই ঠিক করে বেরিয়ে পড়লে এবং তা যদি সব ঠিকঠাক মতো হয় তাহলে সেটার  একটা বিশেষ আনন্দ  আছে। একজন বাঁশির  পোঁ ধরল এবং বাকি সবাই তার  সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলল এবং সৃষ্টি হলো এক অপূর্ব সুরের মূর্ছনার ।

জুলাই মাসের  কেমন যেন  একটা আলাদাই  আকর্ষণ আছে। যতগুলো ছোট ট্রিপ হয়েছে সবই  এই জুলাই মাসে। একটা ঘরোয়া আসরে একটা ধুয়ো  উঠল যে ঝাড়গ্রামে গেলে কেমন হয়? হাত পা ঝাড়া চারটে পরিবারের নয়জন  সদস্য একযোগে হ্যাঁ হ্যাঁ করে সমস্বরে বলে উঠল। অতএব যাওয়া এবং অবশ্যই তার ভার আমাদের অর্জুনের উপর চাপলো এবং নিখুঁত  পরিকল্পনার জোরে যাওয়া ঠিক  হলো। সকাল  সাতটায়  একটা তের সিটারের গাড়িতে যাত্রা শুরু হলো। দুই পরিবারের পাঁচজন পাশাপাশি থাকায় সময়ের  খানিকটা সাশ্রয় হলো এবং বাকি দুই পরিবারের চারজনকে তাদের  বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাত্রা শুরু।  এই অল্প সময়ের মধ্যেই কে কি সঙ্গে নেবে তা ঠিক  হয়ে গেছে এবং ড্রাইভার সমেত দশজনের জন্য বিভিন্ন উপকরণ নেওয়া হয়েছে। কেউ নিয়েছে পরোটা তো কেউ করেছে ঘুগনি ও মালপোয়া এবং কেউ  নিয়েছে কেক। এছাড়াও  রয়েছে নানাধরণের বিস্কুট,  চকোলেট।  কি করে বাদ যায় মুড়ি,চানাচুর এবং তার সঙ্গতকারী পেঁয়াজ,  কাঁচালঙ্কা এবং ধনেপাতা ও আচাড়ের তেল?
ঘ বুড়োবুড়িগুলো যেন ফিরে গেছে তাদের  কৈশোরে। একমাত্র  কচিকাঁচা  হচ্ছে ড্রাইভার যে গাড়ি চালানোর  ফাঁকে ফাঁকে কাটছে ফোড়ন। দার্জিলিঙের চা নেওয়া হয়েছে ফ্লাস্কে,  সুতরাং পুরোপুরি আসর জমজমাট। কোন  বুড়ো আবার  বায়না ধরেছে সিঙারার  এবং মিষ্টির দোকানের জন্য বিখ্যাত কলকাতার বিভিন্ন নামী দোকানের  সামনে দিয়ে গাড়ি যাওয়া মাত্রই  সেই বুড়ো হাঁ হাঁ করে উঠছে গাড়ি থামানোর জন্য  কিন্তু বাকি বুড়োবুড়িদের কড়া নির্দেশ অমান্য  করার  সাহস ছোকরা ড্রাইভার আর দেখাচ্ছে না।

সাড়ে বারোট নাগাদ  পৌঁছলাম  ঝাড়গ্রামের রাজবাড়ি। রাজবাড়ির লাগোয়া সরকার পরিচালিত  ট্যুরিস্ট লজ। কিন্তু সেখানে না থেকে দুটো দিন রাজবাড়ির অতিথি হয়ে একটু রাজারা কেমন থাকে তার একটু গন্ধ পাওয়ার চেষ্টা। এক বন্ধুকে জানানো মাত্র ও বলে উঠল কিরে ফিরে এসে আমাদের মতন প্রজাদের সঙ্গে যোগাযোগ  রাখবি তো? মনে মনে একটু গর্ব হচ্ছিল  যে আমরাও  দিন এনে দিন খেয়ে রাজা হতে পারি। প্রশস্ত  বারান্দায় সোফাতে বসতেই চোখটা একটু লেগে এল। ওরে বাবা, আমার মাথায় কে যেন একটা  পাগড়ি বেঁধে দিচ্ছে। গায়ের পাঞ্জাবিটাও কেমন যেন মখমলের  মতো। পায়ে হীরে,  মণিমুক্তো খচিত নাগরাই জুতো। একি,  কোমরের  বাঁদিকে বাঁকা মতন  কি যেন একটা জিনিস।  ওরে বাবা এ যে খাপে ভরা তলোয়ার।  হাতে তালি দিতেই আশপাশ থেকে ছুটে এল দাসী বান্দাদের দল। চোখ কচলাচ্ছি,  গায়ে চিমটি কাটছি কিন্তু তারা আমার  হুকুম  তামিল  করার  জন্য  আছে দাঁড়িয়ে। কি বলব তাদের  ঠিক করতে পারছিনা। হঠাৎই  গায়ে ধাক্কা পড়ল , দিবাস্বপ্ন গেল ভেঙে। মনে মনে বললাম,  চাই না মা গো রাজা হতে। কিন্তু ঘোর তখনও কাটেনি। মাথায় হাত দিয়ে দেখছি শুধুই চুল। গায়ে অবশ্যই পাঞ্জাবি কিন্তু বাঁদিকে তলোয়ারের জায়গায় রয়েছে বড় মুঠোফোন।  আমি আমিতেই আছি। যাক বাবা বাঁচা গেল। সবসময়ই নিজের কাজ নিজে করতে যে অভ্যস্ত তাকে হঠাৎ যদি দাসী বাঁদী পরিবৃত  হয়ে থাকতে হয়  তাহলে যে কি জ্বালা হয়  সেটা  হাড়ে হাড়ে টের পেলাম  ছোট্ট স্বপ্নের মাধ্যমে।

ম্যানেজারের  পদবী বোধ হয় "জানা" আর ভীষণই রাজভক্ত। রাজাদের  অবস্থা তথৈবচ  হলেও এই বান্দাদের কথায় কথায় রাজাসাহেব আর রাণীমার  উল্লেখ তার প্রভুভক্তির পরিচয় দিচ্ছিল। এই যে মাছটা  খাচ্ছেন , ওটা ঐ দুধপুকুরের মাছ। আপনাদের জন্য ই ধরিয়েছি স্যার।  বিরাট  কাতলা স্যার,  মাছটা  কেমন  লাগছে স্যার? সত্যিই টাটকা মাছ যদি চালানি  না হয় , বরফ না পড়ে, তার স্বাদ তো ভাল হবেই-- সে রাজবাড়ির পুকুরের হোক বা পাঁচু জেলের পুকুরেরই হোক। এই যে  পনীরটা খাচ্ছেন  না স্যার,  এটা রাজবাড়ির গরুর দুধের।  কি নরম, বলুন  না স্যার ।হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক  বলেছেন। বম্বেতে পাঞ্জাব ডেয়ারির পনীরের  কথা মনে পড়ছিল। কিন্তু লোকটার  এত রাজভক্তি দেখে বুঝতে পারিনি যে ব্যাটা আমাদের জবাই করার  ধান্দা করছে। শুক্তো , মুসুরির ডাল , পোস্তর বড়া, পনীরের ডালনা আর রাজবাড়ির কাতলাতে  সম্পন্ন  হলো  দিনের ভূরিভোজ। এরপর দিবানিদ্রায় চেষ্টা করলাম সেই সুখের স্বপ্ন দেখার কিন্তু ততক্ষণে নিজের ওজন টা বুঝে গেছি এবং হাজার চেষ্টাতেও  সেই স্বপ্ন আর দেখা হলোনা। সুন্দর রাজবাড়ি, সামনে বিশাল  দুটো  গেট, সেইখানে গেঞ্জি পরে দারোয়ান আছে। বেমক্কা  ঢোকা নিষেধ। অযাচিত ভাবে প্রবেশ করলে আছে জরিমানার  বিধান,  মানে রাজাদের  যা যা থাকা প্রয়োজন  তা সবই আছে কিন্তু পেয়াদা বা বরকন্দাজের সেই পেল্লাই  গোঁফ নেই বা নেই তাদের হাতে বর্শা  বা  মাথাটা পিতলে মোড়া তেল চুকচুকে  লাঠি। রাজবাড়ির  দোতলায় থাকেন  বর্তমানের রাজা রানী,  একতলায় করেছেন গেস্ট হাউস। দক্ষিণ দিকে রয়েছে রিসেপশন । রয়েছে নানাধরণের  গাছ , রয়েছে নার্সারি। রাজবাড়ির প্রাঙ্গনে রয়েছে ফোয়ারা আর একদিকে রয়েছে বিশেষ  অতিথিশালা যেখানে কোন নেতামন্ত্রীরা এলে অবস্থান  করেন। নেতা মন্ত্রীরা তো আর যে সে লোক নন। ভোটের  আগে করজোড়ে  তাঁরা ভোট ভিক্ষা করেন আর একবার  নির্বাচিত  হয়ে  গেলেই ভো কাট্টা পাঁচবছরের জন্য।  আজকাল  আবার  করজোড়ে ভোট ভিক্ষাও  উঠে গেছে। কিছু দাপুটে দামাল  ছেলেদের জোগাড় করো , সংবৎসর  তাদের  মদমাংসের বন্দোবস্ত করো আর ভোটের সময় তাদের  লেলিয়ে  দাও যাতে অন্যমতের কোন লোক ভোট না দিতে পারে । সরকারী চাকুরেরা কথা শুনতে বাধ্য নাহলে বদলি করে দাও। আই অ্যাম ইয়োর  সার্ভেন্ট এবং ইন্ডিয়ান পেট সার্ভিস বলে দুটো  শ্রেণী আছে যারা  ভীষণ  কঠিন  পরীক্ষার মাধ্যমে নির্বাচিত  হয় এবং আনুগত্য  সংবিধানের প্রতি না রেখে শাসকদলের চাটুকারে  পরিণত হয়। সবার  সহযোগীতায়  এই দাম্ভিক নেতাগুলো  আবার  ফিরে আসেন  এবং যত সাদা জামাকাপড় এঁরা পড়েন ততই মলিন  এঁদের  ভিতরটা। 
রাজবাড়ির প্রশস্ত  বারান্দায় রয়েছে রাজা, রানীর ছবি এবং রয়েছে চুয়াল্লিশ সালে ভাইসরয় প্রদত্ত জমিদার থেকে রাজা হবার  সনদপত্র। প্রত্যেক ঘরেই রয়েছে রাজা রানীর ছবি এবং নানাধরণের  পেন্টিং। সাবেকি আমলের  দরজা, জানলা যেমন আর পাঁচটা জমিদার বা রাজবাড়িতে হয়। আসবাবপত্র ও আগের দিনের মতো। বাথরুমগুলো যথেষ্ট বড়, ঘরের  সঙ্গে মানানসই। মহিলারা বিরাট খাটে বসে হাউসি  খেলছেন এবং এক বৌদি অসম্ভব  ভাগ্যশালী, বারবার  তিনিই  জেতেন। অন্য বৌদিদের  নিদান দেওয়া হলো যখন  উনি ঘুমাবেন তখন তাঁর কপালে নিজেদের কপাল ঘষে নিতে। তাতে কিছুটা হলেও  ভাগ্যের  পরিবর্তন হতে পারে। বিকেল গড়িয়ে আসছে,  সবাইকে  তাড়া দিয়ে বের করা হলো শহরের  আশেপাশের জায়গাগুলো দেখার জন্য। রাজবাড়িটা শহরের  একটু বাইরে। বাজার,  দোকান সবই আছে যেমন একটা মফস্বলের শহরে  থাকে। চোখে পড়ল গোটা দুয়েক শপিং মল।জেলার  সদর দফতর হওয়াতে ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে শহরটা। শহরের  একটা মোড়ে আছে  সাবিত্রী মন্দির।  মন্দির চত্বরের বাইরে গাড়ি  রেখে দেখি মন্দির বন্ধ।  অনেক  পুণ্যার্থী বসে আছে দর্শনের জন্য,  আমরাও সামিল হলাম তাদের সঙ্গে। কথিত আছে যে রাজস্থানের সামন্তরাজা  সর্বেশ্বর সিং পুরীতে জগন্নাথ দর্শন করে ফেরার পথে এই জঙ্গল মহলে অবস্থান করেন এবং স্থানীয় মালরাজাকে পরাস্ত করে মল্লদেব উপাধি গ্রহণ করেন। পরে স্বপ্নাদেশ পেয়ে এখানে এই পাথরের  মন্দির স্থাপন করেন  এবং প্রায় তিনশ পঞ্চাশ বছর ধরে অত্যন্ত  নিষ্ঠার সঙ্গে সাবিত্রী দেবী রূপে পূজিত হয়ে আসছেন। রাজা সর্বেশ্বর সিং এই মন্দিরের পাশে একটা বিরাট পুকুর খনন করা কালীন বহু পুরাতাত্ত্বিক জিনিস পাওয়া যায় এবং ইতিহাসে এক নতুন  অধ্যায়ের সংযোজন করে। কিছুক্ষণ পরেই পুরোহিতের আগমন হলো এবং আমরাও  দেবীমাতা সাবিত্রী দর্শন করে রাজবাড়িতে ফিরে এলাম। রাতে খাওয়া সেরে মেয়েদের  আর একপ্রস্থ হাউসি খেলা এবং যথারীতি হাসিঠাট্টায় বুড়োবুড়িদের দিন শেষ। পরেরদিন  ব্রেকফাস্ট করে গাড়ি নিয়ে বেলপাহাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। দুপাশে বিস্তীর্ণ শালবনের অপূর্ব  নয়নাভিরাম দৃশ্য। এখানে ওখানে সি আর পি এফের ক্যাম্প চোখে পড়ল অনেকটাই কাবাব মে হাড্ডির মতো। কিন্তু  না থাকলেও উপায় নেই। জঙ্গল মহলে রাজত্ব করে সন্ত্রাসবাদীরা বিভিন্ন  রাজনৈতিক দলের  মদতে। কোন সময় রেলের লাইন উপড়ে দিয়ে বিধ্বংসী দুর্ঘটনা ঘটানো এবং  কাজ শেষ   হলেই তাকে এনকাউন্টার করে মেরে ফেলে প্রমাণ লোপাট করে দেওয়া। আবার  নতুন একজন সন্ত্রাসবাদী তৈরী করা। সুতরাং সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার জন্যই  এই আধাসামরিক সুরক্ষাবলের উপস্থিতি। কিন্তু রাজনীতির পাশা পালটালে আবার  কি চেহারা হবে সেটা ভাবার  বিষয়। যাই হোক, বেলপাহাড়ি ছাড়িয়ে যাত্রা শুরু হলো তারাফেণী ব্যারেজ এবং ঘাগরা ঝর্ণার  দিকে। খুব কিছু বড় নয় তারাফেণী ব্যারেজ কিন্তু মন্দের ভাল।  কিন্তু ঘাগরায় ঝর্ণার  সেরকম  মেজাজ  কিছুই  দেখা  গেলনা ঐখানে পিকনিক  স্পট ছাড়া। অবশেষে বেলা গড়ার আগেই ফিরে আসা। পরদিন  চলে আসতে হবে। ব্রেকফাস্ট সেরে সমস্ত  মালপত্র  একটা ঘরে রেখে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম চিল্কিগড়ের রাজবাড়ি ও কনকদূর্গা মন্দির দর্শনের উদ্দেশ্যে এবং ফেরার  পথে মিউজিয়াম দেখা। কিন্তু ইতিমধ্যেই  আমাদের  একজনের  বাড়ির  চাবিসমেত মানিব্যাগ না পাওয়ায়  তড়িঘড়ি ফিরে আসতে হলো মিউজিয়াম  বা রাজবাড়ি না দেখেই।  ফিরে এসে ব্যাগ পাওয়া গেলেও আবার  নতুন করে বেড়ানোর মানসিকতা হারিয়ে গেল। অতএব,  কিছুক্ষণ  অপেক্ষা করে রাজবাড়ির  বিশেষ  কচিপাঁঠার ঝোলে মধ্যাহ্নভোজন সেরে ফিরে আসা। এই প্রসঙ্গে গেস্ট হাউসের  ম্যানেজার" জানা" সম্বন্ধে আরও  একবার  না বললেই  নয়। রাজভক্তির এক বিশেষ  নমুনা এই জানাবাবু। কথায় কথায় রাজাসাহেব বা রাণীমা না বললে বোধহয় ভদ্রলোকের ভাত হজমই হবেনা। যাই হোক,  আজকের  দিনেও  এইরকম  প্রভুভক্তি এক বিরল নিদর্শন।  অবশেষে এই বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের পরস্পরের  প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আনন্দ  উপভোগ করা  এক অতীব আনন্দের  কথা। আমাদের  ছেলেমেয়েদের  কর্মসূত্রে বাইরে থাকতেই হবে। সুতরাং সমমনস্ক কয়েকটি পরিবারের এই যৌথ ভ্রমণ আমাদের  একাকীত্ব অনেকটাই দূর করতে পারে।

Thursday, 13 July 2023

রামকেষ্টর উইল

খুবই সাদাসিধে মানুষ  রামকেষ্ট।  একটা পুরোন সাইকেল  করে সে এদিক সেদিক  চষে নানাধরণের কাজকর্ম করে এবং তা দিয়েই মোটামুটিভাবে সংসারটা চালিয়ে নেয়। মাঝেমধ্যেই  যে একটু আধটু ধার বাকি হয়না তা নয়, কিন্তু টাকা পাওয়ামাত্র আগে দেনা মিটিয়ে বাড়ি আসবে। অভাব অনটনই তো সংসারে ঝগড়াঝাঁটির মূল কারণ  কিন্তু তার বৌ যখন  রাগে গনর গনর করে তখন  চুপ করে থাকে বেচারার মতো। খানিকটা রাগ পড়লে বলবে এক কাপ চায়ের কথা আর তাতেই একপ্রস্থ ঝাঁঝালো আওয়াজ । মুখ পাঁশুটে করে ঘরে চলে যায় রামকেষ্ট।  এবার নিভার একটু মনঃকষ্টের পালা। দুধ নেই, চিনি নেই একটু জল গরম করে চা পাতা দিয়ে কোনরকম  একটু চায়ের রঙধরা  জল এগিয়ে দিয়ে আসে। আর তাতেই কি খুশি রামকেষ্ট।  চা খেয়ে একটু ধাতস্থ  হয়ে  স্নান করে ভাত খেয়েই একটু ঘুম আর তারপরেই সেই ঠা ঠা রোদে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়া লোকের  কাছে টাকা আদায়ের জন্য। এই হচ্ছে রামকেষ্টর রোজকার কাজ, কি শীত,কি গ্রীষ্ম বা কি বর্ষা। গরমকালে লু  বইছে, ঘাড়ের  কাছে একটা তোয়ালে রুমাল  দিয়ে কলারটা যাতে নোংরা না হয় তার দিকে খেয়াল রাখা কিন্তু ঘামে সর্বাঙ্গ ভিজে গেলেও উপায় নেই, সেই ঘাম শরীরেই  শুকায় আবার  নতুন  করে ভিজে ওঠে। একটা চিরাচরিত প্রথা আছে, কেউ ধারের টাকা  একবারে মেটায় না, তিন চারবার ঘুরিয়ে তবেই  দেবে তাও হয়তো পুরোটা নয়। কিন্তু উপায় নেই, সকালে স্কুলে পড়ানোর পরেও তাকে এই কাজটা করতেই হয় বাড়তি রোজগার করার জন্য নাহলে এতগুলো লোকের  মুখে দুমুঠো  কি করে জোগাবে? স্কুলে পড়ানোর সুবাদে একটা সুবিধা অবশ্যই ছিল,  লোকে মাস্টার জী বলে সম্বোধন করত সে টাকা মেটাক বা না ই মেটাক।  সামনাসামনি গালাগালি দিয়ে কেউ অন্তত কোনদিন  কথা বলেনি । কিন্তু পিছনে কেউ  অন্য রকম কিছু বলবেনা তার গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না।

এইরকম অবস্থা কিন্তু বরাবর ছিলনা তার। মহা ঠাটবাটে তার দিন চলছিল। পড়াশোনা চলছিল  শ্রীরামপুর কলেজে। একদিন কলেজে বাইবেল  ক্লাস চলাকালীন  অন্য একজন ছাত্র কিছু একটা কথা বলায়  শিক্ষক সাহেব সেই ছাত্রকে নিদারুণ ভাবে প্রহার করেন।  প্রহারের মাত্রাটা একটু  বেশিই হয়ে যাওয়ায় রামকেষ্ট এবং তার  তিনবন্ধু মিলিত ভাবে প্রতিবাদ  করে । তখন  বৃটিশ জমানা,  কয়েকজন নেটিভ ছাত্র সাহেব অধ্যাপকের কাজের  প্রতিবাদ  করবে এটা একদমই  আশা করা যায়না। সুতরাং করা হলো তাদের  বহিষ্কার। আবার  প্রতিবাদ শুরু হলো। বাইবেল  ক্লাসে  কথা বলা অপরাধ কিন্তু ঐ ছাত্রটিকে যেভাবে মারা হয়েছে সেটা একটু বাড়াবাড়ি পর্যায়ের।  কলেজের অধ্যক্ষ ডেকে পাঠালেন ছাত্র এবং শিক্ষককে আলাদা আলাদাভাবে। শিক্ষক  অধ্যক্ষকে জানান  যে ঐ ছাত্ররা তাঁকে মেরেছে।  অধ্যক্ষ ও ছিলেন বৃটিশ,  সুতরাং কোন কথা নয়, তাদের সবাইকেই  রাস্টিকেট করা হলো। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তখন  শ্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তাঁর কাছে আর্জি জানালেন ঐ চার ছাত্র এবং তাদের অভিভাবকেরা এবং  সাহেবের মিথ্যে কথা তাঁর  কানে তুললেন।  উনি বিচক্ষণ মানুষ ছিলেন এবং সব শুনে বুঝতে পারলেন  যে সাহেব অধ্যাপক মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন।  যাই হোক, একটা সমাধান সূত্র তিনি বের করলেন।  উনি বললেন  যে তোমাদের  রাস্টিকেট করা হচ্ছে না কিন্তু তোমরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য কোন কলেজ থেকে  প্রথম বর্ষ থেকে পড়তে পারবে। রাস্টিকেট হলে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন কলেজেই  পড়তে পারতো না। তখন তারা ছিল  তৃতীয় বর্ষের ছাত্র,  সুতরাং তাদের  তিনটে বছর  নষ্ট  হলো। রামকেষ্টর বাবা, ঠাকুর্দারা সব বড় বড় সরকারী চাকরি করতেন,  সুতরাং তাঁরা আর জিনিসটাকে  বেশী গুরুত্ব দিলেন না। তখনকার দিনে শ্রীরামপুরে থেকে ভবানীপুরে চুল কাটতে আসাটা একটু বাড়াবাড়িই ছিল। পাশ করেই রেলে একটা চাকরি, তারপরেই বিয়ে রামকেষ্টকে আর পায় কে? কিন্তু বলেনা, মাথা  যাদের গরম তাদের  হঠকারিতার ফল অবশ্যই  আসে। একদিন  দুম করে তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে চাকরিতেই  দিল ইস্তফা।  ছিল বাবার পয়সা, নেমে গেল ব্যবসায়। কিন্তু  সহজ  সরল লোকের দ্বারা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া  সহজ কথা নয়। সুতরাং, যা হবার  তাই হলো। প্রচুর টাকা লোকসান হল সেখানে। বড় বড় ব্যবসাদাররা ধারে জিনিস নিয়ে আর টাকা দেয়না, আজ দেবো কাল দেবো করে ব্যবসাটাকেই  লাটে  ওঠালো। গোদের উপর বিষফোড়া হল ব্যাঙের  ছাতার মত গজিয়ে ওঠা ব্যাঙ্কের  লালবাতি জ্বলা।  সুতরাং ইমারতের  ইট খসা  শুরু হলো। এরপর  একের পর এক ব্যবসা শুরু করল এবং যথারীতি মুখ  থুবড়ে পড়া। এককথায় রামকেষ্টর  সুদিন এবং দুর্দিন দুইই খুব কাছ থেকে দেখা। বহু অভিজ্ঞতা  সমৃদ্ধ রামকেষ্ট কিন্তু নিজে আদ্যোপান্ত সৎ এবং কঠোর পরিশ্রমী  আর সেই কারণেই ঐ অত্যন্ত  দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা থেকেও মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা একটা আদর্শ  উদাহরণ। 

কোন কোন মানুষ  ভাগ্যের সহায়তায় এবং পরিশ্রমের দ্বারা অনেক  উঁচু জায়গায় তার স্থান  করে নেয়। আবার  কিছু কিছু লোক অত্যন্ত সৎ এবং পরিশ্রমী হওয়া সত্ত্বেও দুর্ভাগা হবার জন্য একটু এগিয়েই থেমে যায়। যদি কোন  লোককে পাথর ভেঙে, জঙ্গল সাফ করে রাস্তা তৈরী করে এগোতে হয় তাতে তার পরিশ্রমের বেশিরভাগটাই ঐ কাজে চলে যায় এবং তার পক্ষে আর বেশী দূর এগোনো সম্ভব হয়না। রামকেষ্টর  ক্ষেত্রেও  তা ব্যতিক্রম নয়। রিটায়ার করার  একমাস পরেই পরিশ্রমী রামকেষ্ট একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ল এবং সেটাই তার অন্তিম যাত্রা। জীবনের  বেশিরভাগ সময়টাই তার সংগ্রাম  করে কেটেছে , সুতরাং বুড়িয়ে  যাওয়াটাই স্বাভাবিক। একটা মেয়ের বিয়ে বাড়ির কাছেই হয়েছিল এবং তাকে খুব  ভালবাসতো রামকেষ্ট।  শরীরটা  বিশেষ ভাল  যাচ্ছেনা কিছুদিন ধরে। একদিন রামকেষ্ট বাড়ি ফেরার  পথে তার মেয়ের বাড়ি এসে একটা বন্ধ করা খাম তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, " এই খামটা তোমার কাছে রাখো এবং এটা আমার মারা যাবার পরেই খুলবে।" মেয়েও  তার  বিশ্বাসের অমর্যাদা করেনি। হঠাৎই  একদিন  অসুস্থ  হয়ে পড়ল সে যখন  তার পাশে স্ত্রী, ছেলে বা বৌমা কেউ ই নেই। একা বাড়িতে, কি করে খবর দেবে মেয়েকে বুঝে পাচ্ছেনা।  হঠাৎই  বাড়ির  সামনে দিয়ে যাওয়া পাড়ার ই একজন লক্ষ্য  করল রামকেষ্টর অবস্থা এবং সঙ্গে সঙ্গেই মেয়ের বাড়িতে খবর দিল এবং হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করল। বাড়ির কাছেই  গঙ্গার ধারে হাসপাতালে ভর্তি হল রামকেষ্ট।  এরপর  খবর দিল  তার  ছোটছেলেকে কিন্তু মানুষ যখন অন্তিম যাত্রা শুরু করে তখন  পৃথিবীর  কোন  শক্তির  ক্ষমতা নেই তাকে প্রতিহত করে। রামকেষ্ট ও চলে গেলেন কয়েকদিন হাসপাতালে থেকে। ছোটছেলেও খুবই  প্রিয় ছিল  রামকেষ্টর এবং প্রায় বন্ধুর মতো আচরণ ছিল তাদের মধ্যে। কিন্তু কোমায় চলে যাওয়া রামকেষ্ট  আর বিশেষ কিছুই  বলতে পারল না তার প্রিয় সন্তান  এবং বন্ধুকে। চলে গেলেন  রামকেষ্ট এবং তাঁর মেয়ে  যথারীতি খামটা এনে ভাইয়ের  হাতে দিল।খাম খুলে এক অপার  বিস্ময়। একটা ছোট্ট  চিঠি আর সঙ্গে আরও  একটা ছোট্ট  খাম। দিদিই  চিঠিটা পড়ল। ছোট্ট  কয়েক লাইনের।  আমি আমার  স্ত্রী, ছেলেমেয়েদের জন্য  কোনও  সুখ দিতে পারিনি যার জন্য  আমি অত্যন্ত দুঃখিত।  সেই কারণেই  আমার  মৃত্যুর পর আমার  ছেলেমেয়েদের  কাঁধে কোনরকম  বোঝা  চাপাতে চাইনা। ছোট্ট  খামে রাখা আছে মাত্র  একশ বারো টাকা। ঐ টাকা দিয়ে আমার জন্য  তিলকাঞ্চন শ্রাদ্ধ এবং সম্ভব হলে বারোজন ব্রাহ্মণকে অন্তত ডাল ভাত খাওয়াবে।  কারও জন্য  কিছু না করতে পারার জন্য  আমাকে ক্ষমা কোর। জানিনা আশীর্বাদ  করার যোগ্যতা আমার  আছে কি না তবুও  জানাই তোমাদের প্রতি আশীর্বাদ।  এবার  আমি আসি।
সবার চোখে জল কিন্তু কারও মুখে নেই কোন কথা।  সবার মুখেই এক কথা, রামকেষ্ট  একজন অত্যন্ত সৎ এবং ভদ্রলোক  ছিলেন। তাঁর আত্মার  শান্তি হোক।

Wednesday, 5 July 2023

জীবন ও মৃত্যু

জীবনের  সংজ্ঞা কি? হঠাৎই  আচমকা এই প্রশ্নে হতচকিত  হয়ে যেতে হয়। কেন জীবন মানে যার স্পন্দন আছে। শুধু এইটুকু? তাহলে তো কোমায় চলে যাওয়া মানুষটাকেও বলতে হয় যে হ্যাঁ বেঁচে আছে। সংজ্ঞা অনুযায়ী একদম ঠিক।  কিন্তু ওই বাঁচাটা সেই  অর্থে বাঁচা নয়। যখন  সেই মানুষটি জাগতিক মহাজীবনের তালের   সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে, যখন তার সুখ দুঃখের বহিঃপ্রকাশ হবে তখন বোঝা যাবে সে জীবিত। সন্ন্যাসীরা কি করে শোক দুঃখের ঊর্ধ্বে উঠে বা আনন্দেও ভাবলেশহীন হয়ে থাকতে পারেন  তা আমাদের  মতন সাধারণ  লোকের চিন্তার অগম্য কিন্তু তাঁরাও তো জীবিত। হঠাৎই  মাথায় এই দুর্বোধ্য বিষয় কেন এল তা জানিনা কিন্তু যখন একবার  এসেই পড়েছে তখন তার  একটা সন্তোষজনক  ব্যাখ্যার প্রয়োজন। 

প্রত্যেক মানুষ ই জন্মগ্রহণ করে ধীরে ধীরে বড় হয় এবং শৈশব থেকে যৌবন এবং পরে বার্ধক্যের দ্বারে এসে না ফেরার দেশে চলে যায় এবং এই বৃত্ত আবহমান কাল থেকে চলে আসছে এবং এই চলার ও  কোন শেষ নেই। ছোটবেলায় পড়েছিলাম, 
" জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা রবে
 চিরস্থির কবে নীড় হায়রে জীবন নদে" তখন  কিন্তু এত গভীরভাবে চিন্তা করিনি। মাঝের এই কয়েকটা বছর মানে জন্ম থেকে মৃত্যু  পর্যন্ত  যে যেরকম ভাবে নিজেকে তৈরী করে বা তার আর্থসামাজিক পারিপার্শ্বিক অবস্থা তাকে গড়ে উঠতে সাহায্য করে সে সেইরকম অবস্থায় পৌঁছায় এবং দিনের  শেষে ফিরে যায় সে যেখান থেকে এসেছিল সেইখানে। মাঝের এই সময়টাতে কেউ ভাগ্যের সহায়তা পায় আবার  কেউ বা দুর্ভাগ্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে এগিয়ে যায়। ভাগ্যের সহায়তা পেলে সে আরও একটু ভাল  জায়গায় পৌঁছতে পারতো। শৈশবটা যাদের  একটু ভাল ভাবে কাটে যৌবনে তারা একটু সুবিধাজনক অবস্থায় থাকে কিন্তু এসত্ত্বেও যদি ভাগ্য তাকে  সাহায্য না করে তাহলে জীবন তার বিষময়  হয়ে ওঠে। সবাই  চায় বিবাহিত জীবন  সুখের হোক এবং তার  সন্তান তার  সংসারের  মান মর্যাদা বাড়াক কিন্তু সকলের  ভাগ্যে  কি সেটা থাকে? কত ভাল মানুষের প্রতিষ্ঠা সত্ত্বেও তার স্ত্রী বা সন্তানের  হাতে এতটাই নিগৃহীত  হতে হয় যা ভাষায় প্রকাশ  করা যায়না। একজন মানুষ  যখন  তার স্ত্রী বা সন্তানের কাছে ছোট  হয়ে যায় তখনই তার হয় মৃত্যু, সে যতই তার শ্বাস প্রশ্বাস  চলুক  বা অন্যান্য কার্যকলাপ বজায় থাকুক। স্ত্রী এবং সন্তানের হাতে নিগৃহীত  ব্যক্তির বেঁচে থাকা মৃত্যুর ই সামিল। পিতৃহত্যা  বা প্যাট্রিসাইড বা স্বামীহত্যা বা ম্যাটিরিসাইড পড়েছিলাম  স্কুলে থাকাকালীন কিন্তু এই ধরণের ঘটনার  গুরুত্ব  অনুধাবন করতে পারিনি কিন্তু জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে এইরকম অনেক ঘটনার কথা শুনি তখন  অত্যন্ত  ব্যথিত  হই এবং প্রাণের  স্পন্দন থাকলেও তাকে মৃত বলেই মনে করি। কিন্তু যাঁরা এইরকম ঘটনার জন্য দায়ী, তাঁরাও  কিন্তু ছাড় পাবেন না, কালের  অমোঘ নিয়মে তাঁদেরও এই জনমেই হিসেব মিটিয়ে যেতে হবে। কেবল সময়ের অপেক্ষা। একটু বিবেচকের মতো ব্যবহার কি আশা করা যায় না?

Thursday, 22 June 2023

দামাল টিকটিকি

টিউব লাইটের কাছাকাছি একটা বেশ পেটমোটা টিকটিকি ঘুরঘুর করছে আলোর পাশে আসতে থাকা পোকাগুলোর লোভে। বোঝাই যাচ্ছে যথেষ্ট  পেট ভরেছে অন্তত  পেটের সাইজটা দেখে কিন্তু তবুও  ক্লান্তি নেই সেই নির্লজ্জ টিকটিকিটার। দেখছি আর ভাবছি মানুষের সঙ্গে এদের  খুব বিশেষ  পার্থক্য নেই। মানুষের  যেমন স্বভাব প্রয়োজনের তুলনায়  বেশি জমিয়ে রাখা, এই টিকটিকিটাও  হয়তো আমাদের বাড়িতে থেকে আমাদেরই  স্বভাব  রপ্ত করেছে এবং পরিবারের ই একজন  সদস্য  হয়ে গেছে। কিন্তু বাড়ির  সবাই  এই সহাবস্থানে বিশ্বাসী নয়, তাই একে দেখলেই ঝুলঝাড়ার কথা মনে পড়ে এবং ঐ অস্ত্রে তাকে ভয় দেখিয়ে তাড়ায়। দেখছি আর ভাবছি আমি যতক্ষণ আছি ততক্ষণ  মনের  সুখে যা প্রাণে চায় তাই করে নাও কিন্তু তিনি রান্নাঘর থেকে বেরোলেই তোমার  স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা বন্ধ। হঠাৎ দেখছি ঐ মোটু টিকটিকিটা কাউকে কিছু বলতে চাইছে । ওদের  ভাষা তো আমার জানা নেই কিন্তু  চেষ্টা করছি বোঝার  ওর ভাবভঙ্গী দেখে। বারবার  ঐ লাইটের কাছ থেকে দেওয়ালের তাকের  দিকে আসছে আবার  পরমূহুর্তেই আরও  একটা পোকা দেখে কপাত করে গিলে ফেলছে। এ কি রাক্ষস রে বাবা, এত খেয়েও আশ মিটছে না অনেকটা বিয়েবাড়িতে গিয়ে কিছু লোকের যেমন আকন্ঠ খাওয়া --যেন মনে হয় বাড়িতে গিয়ে আর তিনদিন  কিছু খাবেনা। মানুষের  সঙ্গে এত সাদৃশ্য  ভেবে খুব আশ্চর্য  হচ্ছিলাম। এবার  ওর গতিবিধির  ওপর একটু নজর বাড়ালাম। মাঝখানে খুন্তি নাড়ার আওয়াজ শুনে মনে হলো এবার  ডাক পড়বে খেতে আসার  জন্য। ওই মোটু টা একবার তাকের দিকে এসেই কেন আবার  লাইটের কাছে চলে যাচ্ছে? এবার  চোখ পড়ল তাকে থাকা টাইমপিসটার ওপর। কিরকম  অদ্ভুত লাগছে আজ টাইমপিসটাকে।নিজের  চোখকে কিছুতেই  বিশ্বাস করতে পারছি না। ঘড়ির  বড় কাঁটাটা কেমন যেন  মোটা মোটা লাগছে। বাজছে মাত্র ন'টা দশ, কিন্তু বড় কাঁটাটা এরকম  কেন লাগছে। চোখে কি কম দেখছি? বয়স অবশ্যই  হয়েছে কিন্তু তা বলে এত বিভ্রান্তি?   একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে দশটা মিনিট  কেটে গেছে হুঁশ নেই। ন'টা বেজে কুড়ি। আরে ঘড়ির  বড় কাঁটাটা এমন কেন লাগছে? মোবাইলটা নিয়ে এসে একটি ফটো তুললাম।  ইতিমধ্যেই বড় কাঁটাটা আরও একটু যেই না সরেছে অমনি দেখি তিনিও কাঁটাকে ধরতে চেষ্টা করছেন।  ধাঁধায় পড়ে গেলাম। খুব  ভাল  করে লক্ষ্য করতেই  দেখি একটা ছোট্ট  বাচ্চা টিকটিকি  ঐ কাঁটাটাকে ধরার  চেষ্টা করছে। কাঁটাটা যখনই  সরে যাচ্ছে তখনই  সেই বাচ্চা টিকটিকিটা  তাকে ধরার  চেষ্টা করছে এবং এই খেলাতেই মত্ত হয়ে মায়ের  খেতে আসার ডাককে  বারবার  উপেক্ষা করছে এবং মায়ের বিরক্তি উৎপাদন করছে। ভাবলাম নিজেদের  শৈশবের কথা। যখন  খেলায় মত্ত থাকতাম মা বা দিদিরা  যদি  ডাকত তখন  খুব  বিরক্ত  বোধ  করতাম  এবং একান্তই  যখন  খেতে আসতাম  তখনই  খাওয়া শেষে পোঁ করে দৌড়ে আবার  নিজের  খেলার  জায়গায়। এই দামাল  টিকটিকিটাকে  দেখে নিজেদের  শৈশবের কথা মনে পড়ে গেল। পরক্ষণেই আমার  ডাক পড়ল খেতে আসার  জন্য  কিন্তু শৈশবের সেই দুঃসাহস দেখানোর সাধ্য হলো না।

Thursday, 15 June 2023

পথ চলাতেই আনন্দ( তিন )

বাঙালি ভ্রমণ পিপাসু , আমরাও  তার ব্যতিক্রম নই ।বিভিন্ন সময়ে ভাইজাগে থাকা আমাদের একদল বাঙালি আছেন যাঁদের নাম আমরা পঞ্চপাণ্ডবের  নামানুসারেই রেখেছি এবং তাঁরা হলেন যথাক্রমে যুধিষ্ঠির ও তাঁর সহধর্মিনী দেবিকা, ভীম ও ভালান্দ্রা, অর্জুন ও সুভদ্রা, নকুল ও কারেনুমতি এবং সহদেব ও দেবিকা এবং কৌরব ও পাণ্ডব পক্ষের একমাত্র  সহোদরা দুঃশলা। দুঃশলা কিন্তু পাণ্ডবদের ও অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। আমাদের  এই পঞ্চপাণ্ডবের  যাত্রা বেশ সুন্দর ভাবেই  চলছিল  কিন্তু ইদানীং কালে মহাপরাক্রমশালী ভীম একটু সাংসারিক  কারণে বিচ্ছিন্ন  হয়ে পড়েছেন।  তবে এখানে সমস্ত পাণ্ডবদের উপস্থিতি ছিল। 
পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে মহাবীর অর্জুন  যেমন বাকি ভাইদের  তুলনায় বীরত্বে সর্বাগ্রগণ্য  ছিলেন  এখানেও আমাদের বর্তমান অর্জুন বাকি সকলের  তুলনায় এগিয়ে। কি অসাধারণ প্ল্যানিং, একদম নিখুঁত কারও  কোন অসুবিধা হয়না। আর এইখানেই অন্যরা ঘোড়া দেখে খোঁড়া হবার  মতো সব দায়িত্ব সেই অর্জুনের  উপর চাপিয়েই  নিশ্চিন্ত। অবশ্য সেইরকম  নিখুঁতভাবে করার  মতন ক্ষমতাও কারও নেই। যাই হোক সবাইমিলে আলোচনার পর স্থির হলো যে যাওয়া হবে ভিতরকনিকায় যা উড়িষ্যার কেন্দ্রপাড়া জেলায় অবস্থিত। চৌদ্দ ই  ফেব্রুয়ারি আঠারো সাল ধৌলি এক্সপ্রেসে হাওড়া স্টেশন থেকে রওনা দিলাম এগার জনের  দল। ট্রেনের  মধ্যেই  নিয়ে যাওয়া বিভিন্ন  খাবারের মধ্য  দিয়েই ব্রেকফাস্ট সম্পন্ন  হলো। পাঁচ পরিবারের পাঁচমিশেলি  খাবারে জলখাবার বেশ জমিয়েই  হলো। ভদ্রক  স্টেশনে অর্জুনের কথামতো দুটো বেশ বড় গাড়ি মজুত ছিল।  ভাগাভাগি করে বসে মালপত্র গাড়ির  মাথায় চাপিয়ে যাত্রা শুরু হলো। ঘন্টা তিনেক চলার পর একটা নদীর  ধারে এসে পৌঁছলাম। ট্যুর অপারেটরের লঞ্চ ঠিক করাই ছিল। সমস্ত  মালপত্র গাড়ির  লোকেরাই  উঠিয়ে দিল লঞ্চে এবং বৃদ্ধ পাণ্ডব তাঁদের  স্ত্রীরা পায়ের ব্যথা, কোমরের  ব্যথা নিয়ে হেলে দুলে লঞ্চে উঠলেন।  প্রায় মিনিট কুড়ি চলার  পর বৈতরণী নদীর  অপর পারে পৌঁছলাম।  তাদের  লোকেরাই সবাইকে জেটিতে উঠতে সাহায্য করল এবং নদীর  অপর পাড়ে থাকা দুটো গাড়িতে চাপিয়ে রিসর্টে পৌঁছে দিল। যাওয়া মাত্রই সবাই সরবত খেয়ে একটু ঠাণ্ডা হয়েই নিজেদের  ঘরের  দিকে রওনা দিলাম।  এবার  বিস্ময়ের পালা। এ তো ঘর নয়, এ যে তাঁবু। কোনদিন তাঁবুতে থাকার সুযোগ হয়নি, সুতরাং মনের মনে বেশ এক রোমাঞ্চ অনুভব  করলাম। তাঁবুর  তিনটে ভাগ। প্রথম ভাগে ঢুকে যেমন বসার জন্য  একটা ছোট্ট  বারান্দা হয় সেইরকম।  দুটো চেয়ার রাখা  আছে বসে আড্ডার জন্য।  চেন টেনে বন্ধ করে দিয়ে তালা লাগানোর  ব্যবস্থা আছে অর্থাৎ,  তালা লাগিয়ে দিলে তাঁবুর  ভিতরে যাবার  আর কোন  রাস্তা নেই।  তাঁবুর দ্বিতীয় ভাগ শোবার ঘর যেখানে এ সি ও লাগানো আছে এবং খাট ছাড়াও  টেবিল,  চেয়ার ও আয়নাও মজুদ। আর তৃতীয় ভাগে টয়লেট এবং প্রত্যেক ভাগেই  চেন টেনে বন্ধ করার ব্যবস্থা। তাঁবুর  এত সুন্দর ব্যবস্থা দেখে অর্জুনের প্রশংসা মনে মনেই  করলাম।  লাঞ্চ করতে একটু দেরীই  হয়ে গেল কিন্তু ঝটপট লাঞ্চ সেরেই আমাদের  জন্য  রাখা দুটো গাড়িতে পৌঁছলাম  আবার  সেই নদীর  ধারে যেখান থেকে আমরা ভিতরকনিকায় রিসর্টে আসার জন্য উঠেছিলাম। 
সবাই  বেশ  উত্তেজনার সঙ্গে  উঠেছি। লঞ্চের  ইঞ্জিন  স্টার্ট  হওয়া মাত্রই  কি যেন একটা  সড়সড় করে জলে নেমে গেল। দুঃশলা চেঁচিয়ে উঠলেন,  আরে বাবা এ যে একটা  বেশ বড় ধরণের  কুমির। অর্জুন  তখন  বলে উঠলেন, " ঠিকই  তো, এখানে কুমির ই  তো দেখা যাবে, এটা নোনাজলের কুমিরের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। ক্রমহ্রাসমান এই প্রজাতির  কুমিরের সংরক্ষণ এবং প্রজননের ব্যবস্থা এখানে রয়েছে এবং এছাড়াও  রয়েছে নানাধরণের  পাখি যা একটু লক্ষ্য করলেই চোখে পড়বে।" লঞ্চ তো আওয়াজ করে চলতে শুরু করল এবং আমরাও বিভিন্ন জায়গায় বসে নিজের নিজের মোবাইল ক্যামেরায় ছবি তোলার  জন্য  ব্যস্ত।  ছোট, বড়, মাঝারি নানাধরণের  কুমির  এদিকে ওদিকে দেখা যাচ্ছে আর চিরিক  চিরিক  ধ্বনি করে ফটো উঠছে এর ওর মোবাইলে। আমি দেখছি বিস্তীর্ণ  জলরাশি বিভিন্ন দিকে বাঁক নিয়েছে আর ম্যানগ্রোভের ছায়া জলে পড়ে নদীর  গভীরতা যেন  আরও  বাড়িয়ে দিয়েছে। বৈতরণী, ব্রাহ্মণী, ধামড়া ও পাঠশালা নদীর ভিন্ন ধরণের বাঁক এই ভিতরকনিকাকে মনোহর রূপ দান করেছে। একবার  এই বাঁক, পরক্ষণেই অন্য  বাঁকে লঞ্চ নিজের মনে চলেছে এবং মাঝিরা মাঝেমধ্যেই  চিৎকার  করে বলছে ঐ দেখিয়ে কিতনা  বড়া মগরমচ্ছ ( কুমির)। আমরা হাঁ করে দেখছি আর মনে মনে বেশ ভয় ও পাচ্ছি। ভাবছি, এই বড় কুমিরগুলো যদি লঞ্চে ধাক্কা মারে তাহলে  তো সব জারিজুরি শেষ।  অর্জুনের এখানে ধনুর্বাণ ও নেই আর নেই ভীমের সেই গদা। কি হবে তাহলে? পঞ্চপাণ্ডবদের যতই  বীর বলা হোক না কেন, অর্জুন  আর ভীম ছাড়া বাকি ত্রয়ীকে  কেমন ম্যাদামারা  বলেই মনে হয়। যুধিষ্ঠির  তো ধর্ম আর পাশা খেলেই গেলেন  আর নকুল সহদেবকে তো দুধেভাতে  পাণ্ডব  বলেই মনে হয়। মাঝেমধ্যে মহাভারতের  এখানে সেখানে একটু আধটু তাদের  যুদ্ধ করা বা বীরত্বের  কথা উল্লেখ  আছে বটে যেটা না লিখলে ব্যাসদেবের  কাছে গিয়ে কান্নাকাটি করত এই রাজতনয়দ্বয়। যাই হোক , আমার  মনের  মধ্যে যেটা ঘোরাফেরা করছিল  সেটা বললাম,  নকুলের কি হচ্ছিল  বলতে পারব না। চোখটা দেখে যে একটু আন্দাজ করব তাও সম্ভব নয় কারণ চোখে রয়েছে রোদ চশমা বা সানগ্লাস।  হঠাৎই  যেতে যেতে লঞ্চটা নদীর  এক কিনারায় পৌঁছাতেই   রোদ পোহানো একটা বিশালাকৃতি কুমির ( প্রায় ফুট পঁচিশেক) লঞ্চের  আওয়াজে বিরক্ত বোধ করে এত দ্রুত  জলে ছুটে এল যে আমার  মনে হল যে জস সিনেমায় দেখা  হাঙরের  লঞ্চকে আক্রমণের  কথা । ভয়ে বুকটা ধড়ফড় করে উঠল। ভাবছি, এ যাত্রায় বাড়ি ফিরে যেতে পারব কি না। যাই হোক , সেরকম  কিছু  হলো না আর আমরাও যেখান  থেকে  লঞ্চে উঠেছিলাম  সেইখানে ফিরে এলাম। কিন্তু জেটির কাছে এসে দেখি যে জলস্তর থেকে জেটির  উচ্চতা প্রায় দশ ফুট মানে আমরা যখন  যাত্রা শুরু করেছিলাম  তখন  ছিল জোয়ার কিন্তু এখন ভাটার  টানে জলস্তর এতটাই নেমে গেছে যে কি করে  ডাঙায় উঠব তা আর ভেবে পাচ্ছি না। কিন্তু মাঝিরা  এতে অভ্যস্ত।  তারা লঞ্চটা নোঙর  করে লঞ্চ থেকে বিরাট  একটা মোটা তক্তা  জেটির গায়ে ফেলল। কাঠের  পাটাতনে  মাঝে মাঝেই  আড়াআড়িভাবে কাঠের  তক্তা মোটা পেরেক দিয়ে আটকানো যাতে পা পিছলে গড়িয়ে না যায়। এরপর জেটির  উপরে দুজন লোক বাঁশ ধরে দাঁড়িয়ে আছে আর আমরা ভগবানের  নাম স্মরণ করে বাঁশ ধরে কাঠের  পাটাতনের উপর পা রেখে উঠছি। দুএকজন ছাড়া বাকি সবাই কেউ কোমর , কেউ পায়ের ব্যথায়  ভুগছে। জলে পড়লেই কুমিরের  পেটে যে যাবেনা , এই গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবেনা। সুতরাং , একে একে সবাই জেটির  ওপরে ওঠার  পর যুধিষ্ঠিরের মুখ থেকে  অস্ফূট স্বর বেরিয়ে এল বিজয়ী ভব এবং চোখেমুখে একরাশ অজানিত আনন্দ ছড়িয়ে পড়ল।  ডরপোঁক সহদেব  তখন  ভাবছে শুধু  শুধু এত দেরী না করলে জোয়ারের জল থাকত  আর এত কসরত করতে হতো না । গাড়ি দাঁড়িয়েই  ছিল, মিনিট  দশেকের মধ্যেই  রিসর্টে। একটু হাতমুখ ধুয়েই রিসর্টের লাউঞ্জে বসে শুরু হলো চা খাওয়া। এর পরেই লাউঞ্জের পাশেই খানিকটা ফাঁকা জায়গায় কাঠকুটো জ্বালানো  হল এবং তার চারপাশে রাখা হলো চেয়ার এবং ঐ বনফায়ারের মধ্যেই  শুরু হলো গানের আসর। আসতে লাগল প্লেটভর্তি গরম গরম পেঁয়াজি এবং চিকেন  পকোড়া।  ভালান্দারা, কারেনুমতীর গানের গলা যথেষ্টই  ভাল, সুতরাং  বলাই বাহুল্য জমে উঠল আসর। ঐখানে থাকতে থাকতেই লাউঞ্জে ডিনারের  ব্যবস্থা এবং দারুণ  সুস্বাদু সব খাবার দাবার।
এরপর তাঁবুতে যেতে হবে। কেমন  গা ছমছম করছে  কারণ জঙ্গলের  মধ্যে রিসর্ট।  সাপখোপ  ছাড়াও  থাকতে পারে নানাধরণের  জন্তু জানোয়ার।  সঙ্গে নিয়ে যাওয়া কার্বলিক অ্যাসিড চারদিকে ছড়িয়ে দিলাম।  হাতের কাছে রাখলাম  টর্চ  আর একটা বড় ছুরি আত্মরক্ষার জন্য।  বাইরের  চেনটায়  লাগালাম  তালা , দ্বিতীয়টায়  চেনটা সম্পূর্ণ ভাবে টেনে দিলাম  যাতে কোন জন্তুজানোয়ার ভিতরে না আসতে পারে। দুর্গা দুর্গা বলে শুয়ে একঘুমে রাত কাবার।  ভোরের  আলো ফুটে উঠছে। মোবাইল  ও ছুরিটা  নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি ফটো তোলার  বাসনায়। নানাধরণের  পাখির  ডাক, এত মনোরম পরিবেশে নিজের ই কেমন লজ্জ্বা লাগছিল  ঐ ছুরিটা সঙ্গে করে আনার  জন্য।  যাই হোক,  এবার  শুরু হলো দ্বিতীয় দিনের  প্রস্তুতি। ব্রেকফাস্ট করেই আবার  সেই পাড়ে যাওয়া এবং  নদীর  অন্য দিকে যাওয়া। ন্যাশনাল পার্কের কাছে নামা হলো এবং হেলে দুলে ঐ পার্কের  বিশাল  চত্বর পরিক্রমা করার সাধ্য  দুএকজন ছাড়া আর কারও  ছিলনা এবং আগেরদিন ভাটার  টানে জলের স্তর এত নীচে নেমে যাওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা বেশ টাটকাই  হয়ে আছে মনে। অতএব,  বাবা ফিরে চল নিজ নিকেতনে ,মানে  রিসর্টে। যদিও  ন্যাশনাল পার্ক  সম্পূর্ণ ভাবে ঘোরা হলো না তবুও যতটা প্রাপ্তি তাতেই মনটা ভরে গেল।  লাঞ্চ সেরে  সামান্য  বিশ্রাম  করেই পারমাদনপুর গ্রামে একটা পুরোন  মন্দির  দর্শন করতে গেলাম।  বেশ জরাজীর্ণ মন্দির,  দেখেই বোঝা যায় কোন  রক্ষণাবেক্ষণ  হয়না। পুরোহিতের চেহারাও  তেমন নধরকান্তি  নয় মানে বোঝাই যাচ্ছে দরিদ্র  গ্রামের  দরিদ্র  পূজারী।  ডেকে একশ টাকা দেওয়ায় খুবই খুশি। একটা ছবিও  তুললাম তাঁর এবং যে অভিব্যক্তি তাঁর চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়ল  তা ভাষায় প্রকাশ  করা যায়না। ফিরে এসে চা ও পকোড়া এবং রাতে পাঁঠার  মাংস  ও লুচি পায়েসের সমন্বয় এবং সর্বোপরি গাজরের  হালুয়া --এক দারুণ  অভিজ্ঞতা। পরদিন ফিরে আসার  সময় পর্যাপ্ত পরিমাণে গাজরের  হালুয়া আমাদের  দিয়ে দেওয়া রাস্তায় খাবার জন্য। এখানে উল্লেখ করা ভাল  যে অর্জুন দীর্ঘদিন  উড়িষ্যায় থাকার ফলে স্থানীয় ভাষার  উপর যথেষ্ট দখল এবং বহুবিধ  লোকের  সংস্পর্শ তাঁকে অত্যন্ত  প্রাজ্ঞ করেছে এবং এই রিসর্টের মালিক আমাদের আতিথেয়তায় সামান্যতম  ত্রুটি হতে দেননি। দ্বিতীয়দিন রাতে তাঁবুতে অনেক স্বাভাবিক  ও সাবলীল  এবং পরদিন  ব্রেকফাস্ট  করে ফিরে আসার  পালা। জোয়ারের  জন্য  জেটিতে কোন কষ্ট  হয়নি কিন্তু একটা দুঃখ চিরদিন  থেকেই যাবে কারণ দুঃশলার  দামী মোবাইল যেখানে অনেক দুষ্প্রাপ্য  ছবি এবং ভিডিও  ছিল তা জলে পড়ে যায় এবং কুমির বাবাজীবন আমাদের  কাউকে পেটে  না ভরতে পারলেও ঐ দামী মোবাইলটি গলাঃধকরণ  করেন
( অবশ্যই  অনুমান) এবং দুধের স্বাদ  ঘোলেই মেটান। 
আবার  লম্বা যাত্রা গাড়িতে ভদ্রক স্টেশন  পর্যন্ত  এবং ঐখানেই  লাঞ্চ করে অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ফিরে আসা।

Friday, 9 June 2023

পথ চলাতেই আনন্দ (দুই)

ভাইজাগের মহারাজা তখন মহেন্দ্র বাবু।তাঁরই অধীনস্থ তিন অঙ্গরাজ্য যথাক্রমে বিশাখাপটনম,  রাজমন্দ্রি ও বিজয়বাড়া যেখানে রাজ্যপাট সামলানোর দায়িত্বে রয়েছেন শ্রীনিবাসন, নরসিমহন ও প্রভাকর। মহারাজের অর্থনীতি ও সম্পদবৃদ্ধির দায়িত্ব আমার এবং শাসন পরিচালনায় সাহায্য করার জন্য রয়েছেন সচিব  সূর্যকুমার। সচিব সূর্যর কর্মদক্ষতা ছিল অসাধারণ।  যে কোন সমস্যাই তার কাছে ছিল  জলের  মতন। প্রত্যেক মাসেই দ্বিতীয় শনিবার মহারাজের কাছে সবাইকে একসঙ্গে সেলাম ঠুকতে হতো  তাদের  কাজের  ফিরিস্তি নিয়ে এবং যথারীতি খালি পেটে তো আর গুরুগম্ভীর আলোচনা করা যায়না, সুতরাং ব্যবস্থা এলাহি। আর সেইটাই হচ্ছে সমস্যা ।সূর্য ও আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত। সমস্ত কিছু নিপুণ ভাবে না হলে সূর্যর  হ্যাপা আর সেটাকে সুষ্ঠু ভাবে করতে গেলে চাই সম্পদ বৃদ্ধি। সুতরাং কাজের  সঙ্গে আমোদ প্রমোদের মূল কাণ্ডারি এই দুজনেই। একদিন  সূর্যকে বললাম এই হ্যাপাটা একটু অন্যদের  কাঁধে চাপানো যায়না? টাকা পয়সা যা খরচ হবে তা তো হবেই  কিন্তু ব্যবস্থাপনাটা একটু অন্যদের  কাঁধে চাপানো যায় না?
ঠিক বলেছো,  একটা উপায় বের করতেই হবে। এরই  মধ্যে অনেকবার আমাদের ই সামলাতে হয়েছে। সূর্যর  মাথায় খেলতো  নানাধরণের বুদ্ধি। একদিন  সুযোগ বুঝে মহারাজের কাছে ব্যাপারটা উত্থাপন করল। আমাদের এই প্রত্যেক মাসের কাজের পর্যালোচনা এখানে না করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে করলে কেমন  হয়? "খরচটা তাতে কি বাড়বে না কমবে?" , মহারাজের প্রশ্ন।
সূর্যর  চটজলদি উত্তর, " এটা ঘোষের কাছেই  জানা যাক।"
তলব হলো আমার। সব কিছুই প্ল্যান মাফিক চলছে। হাজিরা দিতেই ধেয়ে এল প্রশ্ন।  চিন্তান্বিত মুখে বললাম, "একটু সময় দিন, আমি হিসেব কষে বলে দিচ্ছি।" খানিকক্ষণ পরে বললাম,  " মহারাজ,  খরচ খানিকটা কমই হবে। "
"কি করে?"
উত্তর তৈরীই ছিল, বললাম ," এখানে খাওয়ার  পিছনে অনেক বেশি খরচ, কারণ লোকসংখ্যা এখানে অনেক বেশি এবং আনুষঙ্গিক খরচও  বেশি হয়।"
"ঠিক আছে, তাহলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই মিটিং হোক।"
অনুমতি মিলতে সূর্যর চিঠি তৈরী। এখন থেকে এক এক মাসে এক এক জায়গায় এই পর্যালোচনা হবে। সেই মতো ঠিক হল পরের মাসে রাজমন্দ্রি এবং তার পরের মাসে বিজয়বাড়ায় হবে এই মিটিং এবং তার পরের মাসে আবার  ভাইজাগে।
শনিবার ভোরবেলায় গাড়িতে মহারাজ,সস্ত্রীক শ্রীনিবাসন,  আমি ও সূর্য রওনা দিলাম  রাজমন্দ্রির পথে। মাঝখানে উদুপি রেস্তোরাঁয় টিফিন  করে পৌঁছে গেলাম নরসিমহনের অফিসে। ও ব্যবস্থা করেছে এক হোটেলে আর ইতিমধ্যেই  প্রভাকর ও এসে গেছে। বেশ ছিমছাম  ব্যবস্থা কিন্তু ওর আয়োজন  ছিল  একটু বেশ ভারী রকমের যদিও  লোকসংখ্যা  কম হওয়ায় পুষিয়ে গেছে। রাতে থাকার  ব্যবস্থা করেছে সুন্দরী গোদাবরী নদীর পাড়ে গেস্ট হাউসে।  ঘুমাব  কি, জানলা দিয়ে রাতের গোদাবরীর সৌন্দর্য্য দেখছি।
সুবিশাল  গোদাবরী,  এপ্রান্ত থেকে দেখা যায়না। অন্ধকারে চোখমেলে রয়েছি কিন্তু প্রায় তিন কিলোমিটার বিস্তৃত নদীর অন্য পাড় দেখার মতো চোখের দৃষ্টি আমার  নেই। ট্রেনে যেতে যেতে নদীটা  পেরোতে লাগে যে বহু সময়। এই সুবিশাল নদীর অববাহিকায় দুই প্রান্তে গড়ে উঠেছে বহু জনপদ এবং উর্বর হওয়ায় ফসলও হয় প্রচুর।  এই কারণে এই মহান  নদীকে দক্ষিণ গঙ্গা বলে। পরেরদিন সকাল বেলায় লঞ্চে গোদাবরী ভ্রমণের  ব্যবস্থা করেছে নরসিমহন।  রাজমন্দ্রির ঘাটে আমরা সবাই  পৌঁছে গেছি। শ্রীনিবাসনের স্ত্রীকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য নরসিমহনের স্ত্রীও এসেছেন।  সকাল বেলায় লঞ্চের ওপরের ডেকে আমরা সবাই  বসে আছি। লঞ্চেই ব্রেকফাস্ট , লাঞ্চ ও চায়ের ব্যবস্থা রয়েছে,  এছাড়াও  আছে নাচ ও গানের আসর। একটি অল্প বয়সী ছেলে ও মেয়ে যেভাবে নাচল তাতে ওরা যে অতি অল্প সময়েই  সিনেমায় নামবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আঁকা বাঁকা গতিতে লঞ্চ চলতে চলতে একটা গ্রামের  কাছে  এল। কিছু একটা পূজো হচ্ছে। ঢাক, ঢোল, কাঁসর ও নানাধরণের বাঁশি বাজছে, গ্রামের  লোকজন ও নাচছে।  ভারী মনোরম পরিবেশ। ইতিমধ্যেই  পূজো শেষ  হয়ে এসেছে। কপাল ভাল ছিল,  জুটে গেল  প্রসাদ।  ওদিকে লঞ্চের লোকজন তাড়া দিচ্ছে। গুটি গুটি পায়ে সবাই  এগোলাম লঞ্চের দিকে। 
লঞ্চ এগোচ্ছে নিজের  মতন আর আমরা মনোরম দৃশ্য উপভোগ করছি। শ্রীনিবাসন মাঝেমধ্যেই ফটো তুলছে আর আমরা সবাই  গল্প গুজবে মত্ত। কোন কোন জায়গায় তিনটে চারটে বাঁক,নদীর  পাড়ে থাকা পাহাড়গুলো যেন দিক নির্দেশ করছে কোথায় যেতে হবে। গোদাবরীর দুই পাড়ই যেমন উর্বর, তার ছোঁয়াচ  ও যেন লেগেছে পাহাড়ের গায়ে। ঘন সবুজ  জঙ্গলে ভরা পাহাড়ের দিকে তাকালেই চোখ  জুড়িয়ে যায়। লঞ্চ দেখতে দেখতে একটা পাহাড়ের কাছে গিয়ে থামল। ওখানে একটা মন্দির  আছে। আমরা খানিকটা উঠে ক্ষান্তি দিলাম এবং ওখানে বসেই নরসিমহনের স্ত্রীর আনা কিছু মুখরোচক খাবার খেলাম।  একটু চায়ের কথা ভাবতে ভাবতেই লঞ্চের  লোকেরা বলল চা তৈরী হয়ে গেছে। তরিঘরি উঠে পড়লাম চায়ের তেষ্টা মেটাতে। মাঝপথেই  হলো লাঞ্চ  এবং তারপরেই  ফেরার  পালা। অনতিদূরে  নির্মীয়মাণ পোলাভরমের বাঁধ চোখে পড়ল  কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও  যাওয়া হলোনা কারণ তাহলে ফিরতে অনেক দেরী হয়ে যাবে।
সন্ধে নামছে, পাহাড়ের  ছায়া গোদাবরীর জলে পড়ে আরও মায়াময়  করে তুলেছে। নিস্তব্ধ অন্ধকারে লঞ্চের আলো যেন  প্রদীপের মতো লাগছে আর ভুটভুট আওয়াজ  পাহাড়ের গায়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে বলছে ফিরে যা , ফিরে যা। বেশ ঘন অন্ধকার,  হঠাৎই  লঞ্চ গেল থেমে, আটকে গেছে চড়ায়। যতক্ষণ  জোয়ার  না আসছে বা অন্য  কোন লঞ্চ এসে না টানছে ততক্ষণ  নট নড়ন চড়ন।  অতএব, অপেক্ষা করা ছাড়া কোন রাস্তা নাই। যাই  হোক, খানিকক্ষণ পরেই যেন সোঁ সোঁ করে  এক আওয়াজ শোনা গেল আর দুলকি  চালে লঞ্চটাও নড়ে উঠল এবং ফের ইঞ্জিন  স্টার্ট হলো এবং আমরা ফিরে এলাম  বেশ রাতে। রাতের  খাবার গেস্ট  হাউসে খাবার  আগে আমি আর মহারাজ  বাদে ওরা একটু বসে খিদেটাকে  চাগিয়ে নিল। তারপর হৈ হৈ করে গল্প সেরে গোদাবরীর হাওয়া গায়ে লাগিয়ে টানা ঘুম।  পরদিন ছিল  সোমবার  কিন্তু কি একটা কারণে ছিল  ছুটি। বেশ দেরী করে উঠে ব্রেকফাস্ট সেরে এবং লাঞ্চ করেই গাড়িতে চড়ে ফিরে এলাম  ভাইজাগে।  রথ দেখা  কলা বেচা দুইই সম্পন্ন  হলো।

পথ চলাতেই আনন্দ (এক)

জীবনের অপর নাম গতি । জীবন যখন গতিহীন হয়ে যায়, তখনই  ঘটে মৃত্যু। মানুষ  যতক্ষণ চলাফেরা করছেন ততক্ষণ  তিনি অমুক বাবু বা তমুক বাবু আর স্পন্দনহীন নিথর দেহটা তার নাম গোত্র হারিয়ে হয়ে যায় বডি। ছোটবেলা থেকেই  দুরন্ত, এখানে ওখানে যেতে হলেই দে ছুট, পাড়ার লোকজন বলত ঘোড়া। একটু বড় হতেই সাইকেলের প্রতি আকর্ষণ।  জোরে সাইকেল চালিয়ে এখান থেকে সেখান, ভিড়ের মধ্যেও কাটিয়ে কুটিয়ে কাউকে ধাক্কা না মেরে সবার আগে গন্তব্যে পৌঁছানোর  এক আলাদা তৃপ্তি। কে কি বলল বা কেউ মেডেল দিল কি দিলনা  তাতে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই, নিজেই নিজের  পিঠ চাপড়ানো আর কি। আরও  বড় হয়ে স্কুটার  বা মোটরসাইকেল  নিয়ে তীব্রগতিতে পৌঁছে যাওয়াতেই যেন দারুণ তৃপ্তি। এককথায় জীবনকে গতিময়  করে তোলা যেন নিজের  কাছে এক চ্যালেঞ্জ। 
স্কুলে পড়াকালীন ইংরেজিতে রচনা লিখতে হতো "এ জার্নি বাই ট্রেন"  এবং " এ জার্নি বাই বোট"। মাঝে মাঝেই ধাঁধায় পড়ে যেতাম যখন বন্ধুদের মধ্যে আলোচনা শুরু হতো যে কোনটা বেশি আনন্দ দায়ক। আমার  তো দুটোই  দারুণ লাগে কিন্তু কোনটা বেশি ভাল লাগে তা নিয়ে ধন্দেই থাকতাম। আসলে বেড়ানোর মধ্যেই আনন্দ।  যখন ট্রেনে যাই তখন মনে হয় আহ্ এর মতন মজা আর হয়না বিশেষ করে যদি থার্ড ক্লাসে  ( বর্তমানে যেটা সেকেন্ড ক্লাস কিন্তু তাতে কোন গদি আঁটা থাকত না) যাওয়া হতো। খটখটে কাঠের বেঞ্চ মাঝে মাঝে ফাঁক, ওপরে একটা বাঙ্ক  এবং তারও ওপরে লোহার শিক দিয়ে তৈরী আরও  একটা ছোট  বাঙ্ক। জেনারেল কম্পার্টমেন্ট  হলে তো কথাই  নেই, গাদাগাদি ভিড়,  পায়ের কাছে বসে লোক, প্যাসেজে বসে লোক, বাথরুম যেতে হলে ত্রাহি ত্রাহি রব। এর গায়ে লাথি,ওর কোমরে ধাক্কা, বিভিন্ন লোকের  গায়ে বিভিন্ন রকম  গন্ধ ( অবশ্যই  সুখকর নয়) সবকিছু সয়ে বাথরুম যদি বা পৌঁছানো গেল দেখা গেল সেটা ভেজানো।  ল্যাচটা ঘুরিয়ে ঢোকার  চেষ্টা করতেই ভিতর থেকে এক অস্ফূট আর্তনাদ, 
" উঁহু, আমি আছি" । তা ভাল কথা , ভেতরে আছ তো ছিটকিনিটা  দাওনি কেন বাপু বলে মনে মনে গজরাতে থাকা। এত কষ্টে মরুতীর্থ হিংলাজ হয়ে এসে নিজেকে ঠিক রাখা যে কত কঠিন কাজ  সেটা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ জানেনা। ভেতরের  লোক বেরোনো মাত্রই একে তাকে গুঁতো মেরে সেঁদিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়া এবং তার পরেই বিপদের মাত্রা অনুধাবন করা। ছিটকিনিটা আছে কিন্তু যেখানে ছিটকিনিটা আটকাবে  সেটা নেই বা থাকলেও সেখানে আটকাচ্ছে না। এহেন  পরিস্থিতিতে মাথা খাটিয়ে  কার্যসিদ্ধি হলে নোবেল পুরস্কারের জন্য  মনোনয়ন হওয়া  উচিত।  তারপর বীরের  মত বাইরে এসে আবার  যুদ্ধ  করতে করতে নিজের  জায়গায় ফিরে যাওয়া। যাবার  সময় যাদের  গায়ে পা লেগেছিল  তাদের  কাছে দুঃখ প্রকাশ করে নিজের  পাপস্খালন করা। জায়গায় বসেই অসমাপ্ত কথা বা গল্পের ফের শুরু করা। এর মধ্যেই বিভিন্ন ফেরিওয়ালার ভিন্ন স্বাদের বিপণন এবং এটা সেটা করতে করতে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যাওয়া। এত কষ্টের মধ্যেও আনন্দটা ছিল একেবারেই বিশুদ্ধ নির্মল। তখন মোবাইল  বলে কোন  জিনিস  হতে পারে এটা    স্বপ্নেও ভাবতে পারা যেতনা কিন্তু স্মৃতিশক্তি   ছিল  বড়ই  প্রখর এবং নাম ধাম গোত্র সবই যেন মনে থাকত যদিও  ভবিষ্যতে আর কোনদিন তার সঙ্গে দেখা হবে কিনা সন্দেহ। এখন রিজার্ভ  কম্পার্টমেন্টে যাতায়াত,  লোকের  সংখ্যা সীমিত  কিন্তু বন্ধুত্ব  বা আলাপ ঐ ক্যুপের মধ্যেই  সীমিত থাকে ,সাইড বার্থেও  পৌঁছায় না যদি না তাঁরা পূর্ব পরিচিত  না হন। ফার্স্ট ক্লাস ( যা আজকাল  উঠেই গেছে) বা এ সি টু টায়ার  বা এ সি ফার্স্ট ক্লাসে সেই  মজাটা পাওয়া যায়না, সবাই গোমরামুখো হয়ে তাদের  স্টেটাস সিম্বল জাহির  করে। কেউ  কারো সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কথা বলবে না পাছে যদি সে ছোট হয়ে যায়। গপ্পিষ্ঠি লোকের  পেট  ফুলে যাওয়ার অবস্থা। সুতরাং সাধারণ  লোক আমার  অবস্থা  সহজেই অনুমেয়। আমি সেকেন্ড ক্লাসে  খুব  স্বচ্ছন্দ যেখানে কথা বলতে বলতে  গন্তব্য স্থলে পৌঁছাতে পারি।

সাঁতার  না জানায় বরাবরই  জলে আমার বড্ড ভয়। বাড়ির কাছে গঙ্গা থাকলেও বাড়ির  নিষেধে গঙ্গাস্নান হতোনা যদি না কাউকে দাহ করতে  যেতে হতো বা ঘাটে পিণ্ডদান  করতে হতো। প্রতিমা বিসর্জনের  সময় ও কড়া হুঁশিয়ারি, গঙ্গায় নামা চলবে না। সুতরাং নৌকায় চড়া,  এটা অকল্পনীয় ছিল।  কিন্তু যেখানেই  বাধা নিষেধ  সেখানেই তীব্র আকর্ষণ।  ফরাক্কা ব্যারেজ হবার আগে গঙ্গা ছিল শীর্ণ, বেশিরভাগ জায়গায় জল থাকত হাঁটু পর্যন্ত।  কিন্তু কোন কোন জায়গায় জল থাকত বেশ গভীর।  এইরকম ই একটা জায়গা ছিল  রাধারঘাট। তখন  ওখানে ব্রিজ  হয়নি, গাড়ি ঘোড়া সব পেরোত ঐ রাধারঘাটের অস্থায়ী  কাঠের ব্রিজ  দিয়ে। বর্ষার সময় যখন  গঙ্গা  টইটুম্বুর তখন  কাঠের ব্রিজ  আর থাকত না এবং তখন বড় বড় নৌকা জোড়া দিয়ে গাড়িগুলো চলাচল করত আর সাধারণ  মানুষের জন্য  ছিল  নৌকা ও মাঝি। রাধারঘাটের অন্য  পাড় থেকে ছাড়ত কান্দি যাওয়ার বাস। ওখান  থেকে  যেতে হতো খাগড়াঘাট স্টেশন যেখান থেকে হাওড়াগামী বা হাওড়া থেকে উত্তরবঙ্গ বা আসাম যাওয়ার  ট্রেন  ধরতে হতো। ফরাক্কা স্টেশন পৌঁছে গঙ্গা পেরোতে হতো স্টিমারে এবং অন্য পাড়ে গঙ্গার চর পেরিয়ে মালদহ বা উত্তরবঙ্গের জন্য  দাঁড়িয়ে থাকা  ট্রেনে উঠতে হতো। যেখানেই  বাধা সেখানেই আকর্ষণ।  অতএব নৌকায় চড়ে ভরা গঙ্গা এপার ওপার  করার  মধ্যে ভয় থাকলেও তীব্র আকর্ষণ ও ছিল। সুযোগ  জুটে গেল।ক্লাব থেকে নৌকায় লালবাগ ও নসীপুর  যাওয়া হবে। বহরমপুর থেকে লালবাগ  যেতে হলে স্রোতের বিপরীতে যেতে হয় , সুতরাং শুধু দাঁড় বেয়ে যাওয়া বেশ কঠিন  ব্যাপার ছিল। সুতরাং দাঁড় টানা মাঝি ছাড়াও  আরও  দুজন মাঝি গুণ টানতো। নৌকার পালে লম্বা দড়ি বেঁধে দুজন মাঝি গঙ্গার  পাড় বরাবর  টানতে টানতে যেত কিন্তু ফেরার সময় গুণ টানার  দরকার  পড়ত না কারণ  তখন  স্রোতের  পক্ষে নৌকা চলত। নৌকার ছই এর মধ্যে বসে থাকা এবং নৌকার  মধ্যেই রান্না করে খাওয়ার  এক আলাদাই  মজা। এখানে যেহেতু সবাই চেনাজানা গল্পের  পরিধিও  ছিল  সীমিত।  কিন্তু গঙ্গার বাতাসে যাত্রা নিত এক অন্য মাত্রা। হৈ হৈ করে কয়েক  ঘন্টা কিভাবে কেটে যেত কিছুই বোঝা যেতনা। এর পরেও জল বিহার  হয়েছে বিভিন্ন  সময়ে কোন সময় লঞ্চে বা ক্রুজে এবং  আনন্দ ও হয়েছে অসামান্য। 
ভ্রমণ যাদের  প্রিয় তাদের কি ট্রেন বা কি নৌকা বা লঞ্চ সবই আনন্দ দায়ক। তাই কোনটা বেশি ভাল সেটা বলা মুশকিল। 

Tuesday, 16 May 2023

হরকরা

ভজাটা বরাবরই একটু ডানপিটে ধরণের। সেই ছোট্ট থেকেই একটু সবার উপর খবরদারি করা ওর যেন স্বভাবেই পরিণত হয়েছিল। অবশ্য  সেটার একটা কারণ ও ছিল। বয়সের  তুলনায় ও ছিল একটু হাঁফালো আর সেইটাই ওর ছোট থেকেই দাদাগিরি করার  অভ্যাস হয়ে গেছিল। কথায় কথায় বন্ধুদের হাতটা একটু মুচড়ে  দেওয়া  বা মাথায় টকাম করে একটা চাঁটি বা আচমকা কারও  পিঠে গুম করে একটা কিল মেরে দেওয়া ওর যেন  মজ্জাগত  হয়ে গেছিল। বন্ধুরা ওর এই ধরণের  আচরণে যে স্বভাবতই নারাজ থাকবে এটা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। তখন ও ফ্ল্যাট কালচার  আসেনি, পাড়ার অস্তিত্বর বেশ রমরমা।  সবাই সবাইকে চিনত , বাড়ির হাঁড়ির খবর ও মুখে মুখে প্রচারে তিল থেকে তালের পর্যায়েও চলে যেত। কোন বাড়ির  মেয়েকে ঐ পাড়ার কোন ছেলের  সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেছে এজাতীয়  মুখরোচক  ঘটনা যে কি সাঙ্ঘাতিক  পর্যায়ে চলে যেত এক কথায় তা অভাবনীয়। সুতরাং খুব বুঝে সুঝে পা ফেলো বাবা। ভজা যেহেতু একটু লীডার গোছের ছিল, অনেক সময়ই  মেয়ের দাদা বা মা ভজাকে ডেকে  একটু অনুরোধ  করত যাতে বেপাড়ার ছেলের থেকে বাড়ির  মেয়েটার বেইজ্জতি  না হয়। একদম ভজার  মনের  মতো কাজ। সুযোগ  বুঝে ছেলেটাকে একটু কড়কে দেওয়া না পর্যন্ত ওর পেটের  ভাত ই হজম  হতো না। আর এইসব করতে গিয়ে পড়াশোনায় একদম লবডঙ্কা। প্রত্যেক  ক্লাসেই  দুবছর  তিনবছর করে থেকে নিজেকে একদম পোক্ত করে তুলেছিল  যার ফলস্বরূপ  তার ছোট ভাইয়ের থেকেও  ছোট ছেলেদের সঙ্গে পাশ করা। কিন্তু যেভাবেই  হোক না কেন সে স্কুলের  গণ্ডি পার করতে সক্ষম হয়েছিল। 
পরের  পর্যায়টা  খুব একটা সুখকর ছিল না তার পক্ষে। অন্য সমবয়সী ছেলেরা যখন  পাশ করে  চাকরি বাকরিতে ঢুকে গেছে, কারও  কারও  বিয়েও  হয়ে গেছে এবং বাবাও হয়ে গেছে তখনও সে দাঁড়াতে পারেনি নিজের  পায়ে। ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর এর তার যার যেমন  প্রয়োজন সেখানেই  সে ছাতা ধরে দাঁড়াচ্ছে। ইতিমধ্যেই  তার বাবা চলে গেলেন এবং বিশেষ  কিছু না রেখে যাওয়ার জন্য অল্পদিনের মধ্যেই  প্রায় নাভিশ্বাস ওঠার  জোগাড়। যা কিছু ছিল  তা দিয়ে ভজা ও তার  মায়ের কোনরকমে দিন চলে যাচ্ছিল।  কিন্তু বসে খেলে রাজার ধনও শেষ হয়ে যায়, এই আপ্তবাক্য তো অস্বীকার  করার  নয়। কিন্তু পেটে গামছা বেঁধে তো পরোপকার করা যায় না। কিন্তু এর মধ্যেও ভজার হাসিমুখে সবার কাজ করতে কোনরকম  দ্বিধা ছিলনা। কিন্তু বেশিরভাগ লোকই নিজের  কাজটা হয়ে গেলেই একটু চা জলখাবার খাইয়ে বিদায় দিত।  এরই মধ্যে পাড়ায় ভাড়া নিয়ে এলেন  সুধীর বাবু।  তিনি ছিলেন পোস্টাল  ডিপার্টমেন্টের  উচ্চপদস্থ  অফিসার।  ভজার  এই নিঃস্বার্থ ভাবে সকলের  উপকার  করা তাঁর  চোখ এড়াল না। ঐ সময় তাঁরই  ডিপার্টমেন্টে কিছু পিওনের পদ ভর্তি হবে। তিনি ভজাকে একদিন  রাস্তায় দেখতে পেয়ে তাকে তাঁর  বাড়িতে আসতে বললেন। ভজা ভাবলো যে পাড়ায় আসা নতুন  ভদ্রলোকের  কোন  প্রয়োজন  আছে, আর সেকারণেই  উনি ডাকছেন। হাসিমুখে সম্মতি জানালো আসার কথা।
সন্ধ্যে বেলায় ভজা খেয়াল  রাখছে কখন সুধীর বাবু অফিস থেকে ফেরেন। তারপর একটু বিশ্রাম নিয়ে হাতমুখ ধুয়ে চা জলখাবার খাবার পরে ও যাবে মনস্থ  করেছে। সাড়ে সাতটা নাগাদ  দরজায় কড়া নাড়ল সে। সুধীর বাবু ওকে দেখেই ভেতরে নিয়ে গিয়ে বাইরের ঘরে বসালেন এবং একটু চা করার  কথা বললেন।  ভজা তো অবাক। এতদিন  সবার  কাজ করার পর লোকে তাকে  চা খাওয়ার কথা বলেছে আর এই ভদ্রলোক কোন  কাজ  না করিয়েই চা খেতে বলছেন  এইটা ভেবেই  সে তাঁর  সম্বন্ধে একটু উঁচু ধারণাই  পোষণ করলো। চা বিস্কুট খাওয়া হলে সুধীর বাবু সরাসরি ওকে জিজ্ঞেস করলেন  যে সে কোন কাজ  করে কিনা এবং বাড়িতে তার কে কে আছেন।  ভজা ঘাবড়ে গেল, হঠাৎই  এরকম কথা কেন। যাই  হোক  জানালো যে সে বেকার এবং বাড়িতে তার মা রয়েছেন। 
 সংসার  চলে কি করে?
মানে বাবা যেটুকু টাকা জমা রেখেছিলেন  তাই  দিয়ে আর লোকের  এটা সেটা করে যদি কেউ কিছু দেন, তাই দিয়ে।
পড়াশোনা কতদূর  করেছো?
মানে স্কুলের  গণ্ডি পেরিয়েছি  কিন্তু তার পর আর পড়াশোনার সুযোগ  হয়নি।
চাকরি করবে? তোমার  যা কোয়ালিফিকেশন,  তাতেই হবে। আমাদের  অফিসে পিওন  নেওয়া হবে, তুমি চাইলে করতে পার। ভেবে আমাকে জানিও।
ভজা তো নিজের  চোখ, কান কে বিশ্বাস ই করতে পারছিল না। এতদিন  লোকে সবাই তার কাছ থেকে কাজ নিয়েছে এবং পরে  কিছু চাইতে পারে ভেবে  এড়িয়ে গেছে আর এই ভদ্রলোককে নিশ্চয়ই  ভগবান  পাঠিয়েছেন।  আমাকে কি করতে হবে স্যার? হঠাৎই  স্যার  শব্দ টা মুখ থেকে বেরিয়ে গেল। 
আমি কাল একটা ফর্ম  এনে দেব,  তুমি তোমার  স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার  মার্কশিট ও সার্টিফিকেট আমার  কাছে এনে দিও আর দুজন ভদ্রলোকের  কাছ থেকে ক্যারাক্টার সার্টিফিকেট  আনতে হবে।
ঠিক আছে স্যার।  আমি এখন আসি।
মুহুর্তের মধ্যেই  একটা দারুণ  আনন্দ  তাকে গ্রাস করল। বাড়িতে গিয়ে মাকে বলল, " মা, এতদিন  পর ভগবান  আমাদের  দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছেন। " এরপর  সব ঘটনা মায়ের কাছে খুলে বলল। মা দুর্গা দুর্গা বলে  কপালে হাতজোড় করে প্রণাম  করলেন এবং তারপর ভজার  বাবার  ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বাঁধভাঙা  চোখের  জল  গাল বেয়ে নামতে থাকল। এরপর চলল সে তার প্রিয় বন্ধু নন্তুর বাড়ি সবকিছু খুলে বলতে।  নন্তু যদিও  চাকরি করত কিন্তু তবুও  ভজার  সঙ্গে তার  বন্ধুত্ব ছিল  ভীষণ  গভীর কারণ ভজা ছিল  সবার  সুহৃদ। পড়াশোনায় একটু কমতি হলেও  মনটা ছিল  বিশাল। 
যাই হোক, সুধীর বাবুর কল্যাণে সে পোস্টম্যানের চাকরি করতে লাগল।  খুব খুশী সে, হৃদয়টা হয়েছে আরও  বড়।  কিন্তু এরই মাঝে সে বিএ পাশ  করে ফেলেছে, তাও সুধীর বাবুর  উৎসাহে। হয়েছে প্রমোশন এবং যথারীতি বদলি। অবশ্য  বেশি দূরে নয়,  পাশের   শহরেই,  মাত্র পনের  কিলোমিটার দূরত্বে। ভজার  মা দেহরাখার আগে ছেলের  বিয়ে দিতে পেরেছেন  এবং ছোট ছোট  দুই নাতি নাতনিকে দেখে ও যেতে পেরেছেন।  
ভজা রিটায়ার করলেন।  ছেলেমেয়েদের সাধ্যমত ভাল স্কুলে পড়িয়েছেন এবং প্রাণপাত করে মাস্টার মশাইদের  কাছে প্রাইভেট  পড়িয়েছেন এবং তারা ও জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের  পথে। মেয়ের বিয়ের পরে এবং ছেলেও চাকরির  সূত্রে বাইরে থাকায় বাড়িতে কেবল বৃদ্ধ  ভজা ও তার স্ত্রী। কাজ এখন অনেক কম। স্বামী , স্ত্রী দুজনেই  মোবাইল ফোনে ব্যস্ত, মাঝে মধ্যে একটু কথা বার্তা। ভজা হঠাৎই  স্বগতোক্তি  করল, " আমি হরকরাই  থেকে  গেলাম  গো। আগে বাড়ি বাড়ি চিঠি বিলি করতাম আর এখন সকাল থেকেই একজনের  পাঠানো ভাল  মেসেজ অন্যদের  কাছে পাঠিয়ে দিই। এটাও কি হরকরার কাজ নয়?"

Saturday, 13 May 2023

বিবর্ণ স্মৃতি

অনেক দাম দিয়ে কেনা কত ঝলমলে কাপড় জামাও  কালের  গতিতে কেমন বিবর্ণ হয়ে যায় সেখানে স্মৃতির  জোয়ারে যে ভাটা পড়বে তাতে আর কি সন্দেহ আছে? ফেলে আসা দিনগুলোর  দিকে পিছন ফিরে তাকালেই মনে পড়ে অনেক ঘটনা, সবগুলোই  যে প্রয়োজনীয় তা নয় ,অনেক হাব্জি গুব্জি ও মনে আসে আবার  অনেক  কথাই হাজার  মনে করার  চেষ্টা করা সত্ত্বেও  মনে পড়েনা  তখনই।  বয়স নিশ্চয়ই  একটা ব্যাপার,  সেটাকে অস্বীকার ও করা যায় না। কিন্তু কোন এক সময় হঠাৎই  তিনি উদয় হন মনের  মধ্যে এবং আবার ও ভুলে যাবার  আগে যদি তাকে শব্দবদ্ধ না করা যায় তাহলে তা চিরতরেই  বিস্মৃতির আড়ালে চলে যেতে পারে।

এইরকমই আমার  কিছু পুরোনো বন্ধুর  কথা মনে পড়ছে যারা আমাকে ছেড়ে দিয়ে পাড়ি জমিয়েছে  না ফেরার দেশে। খুবই অন্তরঙ্গ, আমার খুশীতে তাদের ও খুশী , দুঃখে পিঠে হাত রেখে বলতো," এত ভেঙে পড়ার  কিছু নেই, আমরা তো পাশে আছি; আবার  ফিনিক্স  পাখির মতো উড়ে যাবি  আকাশে আর সঙ্গে সঙ্গে আমরাও  উড়ব  তোর সাথে।" চাকরির সূত্রে একঝাঁক পায়রা এসে হাজির  হলো কলকাতার  বুকে সুদূর দক্ষিণ  দেশ হতে। নক্ষত্রের  সমাবেশ  বলা যেতে পারে। কেউ বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের  উদীয়মান নক্ষত্র,  কেউ বা বিখ্যাত  লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের ঝলমলে ছাত্রী আবার  কেউ বা অসুস্থতার কারণে স্কুল ফাইনাল  পরীক্ষার  উজ্জ্বলতম ছাত্রী হওয়া সত্ত্বেও  পড়াশোনা চালিয়ে যেতে অসমর্থ।  কিন্তু আগুন  তো চিরদিন ছাই চাপা পড়ে থাকতে পারেনা, তা কোন না কোন  সময় প্রতিভাত  হবেই। তাদের  কাজের  মাধ্যমেই সেই প্রতিভার বিচ্ছুরণ হতে লাগল যার অবশ্যম্ভাবী প্রতিফলন সেই অফিসের কাজের মধ্যে। তার নাম যশ বাংলা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ল  দাক্ষিণাত্যে এবং ধীরে ধীরে ভারতবর্ষের  বিভিন্ন  প্রান্তে। অফিসের  উত্তরণের  সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গতকারীদের ও উত্তরণ  হলো এবং ভারতবর্ষের  বিভিন্ন  প্রান্তে তারা পতাকা বহন করতে লাগল। কিন্তু কর্মসূত্রে গেঁথে ওঠা মালার পুঁতিগুলো  এদিক সেদিক  ছড়িয়ে পড়লেও মনে মনে সর্বক্ষণ ই একটা আশা যে আবার আসিব ফিরে, মিলিব সবার সাথে সেই পুরাতন ঝিলের ধারে। হাসিব, খেলিব  গাহিব সবাই সেই পুরাতন গান।  হয়তো  সবটাই  হয়ে ওঠেনি কিন্তু পুরোন সেই স্মৃতির  রেশ আজও ঝলমলে হয়ে আছে। খোলা আকাশের  নীচে  বসে গান, তর্ক বিতর্ক,  মান অভিমান  সবই মনে পড়ছে, মনে পড়ছে সেই ছুটির দিন সবাই মিলে পুরোন কলকাতা পরিক্রমার  কথা। সবাই মিলে তারামহলে টিফিন  খেতে যাওয়া বা অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে  নাটক  দেখতে যাওয়া বা রবীন্দ্র সদনে স্বনামধন্য  শিল্পীদের  অনুষ্ঠান  শুনতে যাওয়া সবকিছুই  মনে পড়ছে  আর আবার  ভুলে যাবার  আগে তাকে স্মৃতির  মণিকোঠায় সাজিয়ে রাখতে চাই।

সেদিনের তরুণরা আজ প্রায় বৃদ্ধ, অনেকেই  আজ এই সুন্দর  পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে আবার  কেউ কেউ অপেক্ষারত জিনিসপত্র  গোছগাছ করে । ডাক এলেই চলে যাবে। যারা এই মূহুর্তে রয়েছে তারা ব্যস্ত   স্মৃতি রোমন্থনে। কখনও সখনো মিটিং হলে বা পিকনিক  হলে তারা একত্রিত  হয় কিন্তু ঐ আনন্দের  মধ্যেও চোখদুটো খোঁজে  সেই পুরোন বন্ধুদের  আর সবার অলক্ষ্যে রুমাল দিয়ে চোখটা মোছে এবং চশমার  কাচটা পরিষ্কার  করে নেয়। চৌধুরীর  হাতটা ছিল ভারী মিষ্টি। তবলার  বোলগুলো যেন প্রাণ  পেত তার আলতো আঙ্গুলের  টোকায়। স্বভাবটাও ছিল বড় মিষ্টি তার সদাহাস্য  মুখের  মতন। কত ছেলেমেয়েদের  সে উৎসাহ যুগিয়েছে গান  বাজনা করার  জন্য  এবং পরবর্তীকালে তারা যথেষ্ট  ভাল  গান করেছে। সুজিতের ছিল প্রাণখোলা গলা এবং কি শ্যামাসঙ্গীত বা ভক্তিগীতি বা রবীন্দ্র সঙ্গীত বা অতুলপ্রসাদী বা রজনীকান্তের  গান যা কিছুই গাইত  তা একটা আলাদা মাত্রা পেত। মাধবিকা গাইত  প্রধানত নজরুল গীতি এবং পুরোদস্তুর  প্রশিক্ষণের  ছাপ তার গলায় ছিল।  প্রিয়রমা, কণিকা সবাই অফিসের  ফাংশনে রীতিমত অংশ গ্রহণ করতো এবং অনুষ্ঠানকে  প্রাণবন্ত করে তুলত। ম্যানেজমেন্ট বললে জয়ন্তর  কথা সবচেয়ে আগে আসবে। ও ছিল  মেরুদন্ড,  কথা কম কাজ বেশি। তৃপ্তিদার  কথা অবশ্যই  বলতে হবে। হঠাৎই  একটা কাগজ  নিয়ে খসখস করে গান লিখে, তার সুর ও দিয়ে দিত এবং চৌধুরী  ও আমাকে দুই হাতে শক্ত  করে ধরে লাঞ্চরুমে দরজা বন্ধ  করে গান শুনতে বাধ্য  করতো। দরজা বন্ধ করে তার পিছনে চেয়ার টেনে বসে( যাতে আমরা বাইরে পালিয়ে যেতে না পারি) হারমোনিয়ম টেনে নিয়ে স্বরচিত  এবং সুরারোপিত গান আমাদের  শুনতে বাধ্য  করতো। তবলায়  চৌধুরীর হাজার  চেষ্টাও গানকে তালে রাখতে পারত না। একদিকে গলা আর অন্যদিকে  হারমোনিয়মের সুর, সে যে কি ভয়ানক অভিজ্ঞতা তা বলে বোঝানো যায়না। গান শেষ  হলে মতামত  জানতে চাইলে কি যে বলা  উচিত  ভেবে পেতাম  না। অনেক ভেবে চিন্তে একটা জুতসই উত্তর  খুঁজে পেয়েছিলাম  এবং সেটা হলো যে ঠিকই  আছে তবে একটু স্কেলটা  চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে যার চটজলদি  সমাধান ছিল  ও একটা স্কেলচেঞ্জ  হারমোনিয়ম কিনে ফেলবে। আর চৌধুরীর  উত্তর  ছিল, তালটা কেটে যাচ্ছে তো, একটু ডেটল লাগাতে হবে। এহেন  তৃপ্তিদা রবীন্দ্র সদনে অফিসের  অনুষ্ঠানে সোলো  গাইবেই  গাইবে যেখানে গাইবেন শ্রদ্ধেয় সাগর সেন এবং ফিরোজা  বেগম।  ত্রাতা  সেই একজন, সুজিত  ব্যানার্জি। অনেক কষ্টে বুঝিয়ে সুজিয়ে কোরাস গানে অংশগ্রহণ  এবং তাকে একেবারে পিছনের  দিকে রাখা যাতে তার গলা মাইক্রোফোনে ধরা না পড়ে। এইসব আনন্দের মুহুর্ত গুলো যদি না বলা হয় তবে সমস্ত প্রচেষ্টাই  একেবারে পানসে  হয়ে যাবে এবং ম্যাড়মেড়ে হয়ে যাবে। সবচেয়ে গ্ল্যামারাস ছিলেন আমাদের  অফিসের  প্রধান  শ্যামল ধর। ছিলেন  অমরনাথ  মিত্র মুস্তাফি এবং ব্রেবোর্ন রোড শাখার প্রধান শচীন  দাশগুপ্ত এবং সুব্রত রায়চৌধুরী।  ছিল শিবু ,সুশান্ত, মোহন, তরুণ,  শচী, নির্মল এবং অবনী। ছায়াদির উপস্থিতি ছিল একদম নির্বাক কিন্তু প্রয়োজনীয় যা কিছু করা দরকার  তা উনি নিঃশব্দেই  করতেন।

আজ আমরা অনেককেই হারিয়েছি। স্যার ( শ্যামল ধর), অমরনাথ মিত্র মুস্তাফি,  শচীন  দাশগুপ্ত,  সুব্রত রায়চৌধুরী, মোহন,  শুভ সবাই একে একে চলে গেছেন এবং হৃদয়ে এক একটা মোক্ষম  আঘাত  হেনে গেছেন। বিনয় দা, কান্তি দা, মধু( পাল), বাড়ারি, সবিতা, বিভাস এবং সাহা সর্দার আমাদের  কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন। বিদায় নিয়েছে সমীর,পার্থ ও স্বপন, খলিল ও ভগীরথ কিন্তু চৌধুরীর চলে যাওয়া মন থেকে কিছুতেই  মেনে নিতে পারিনি, সেইরকম  মানতে পারিনি অসীম  ধৈর্য্যশীলা সবিতার  চলে যাওয়াকেও। কিন্তু গতবছর উপর্যুপরি  দুই দিনে চৌঠা জুন এবং পাঁচই জুন সুজিত  এবং শঙ্খপাণির প্রয়াণ এক মহা ধাক্কা। দুজনেই  ছিল একাধারে বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ী।  আজ তাদের  চলে যাওয়া প্রায়  বছর গড়াতে চলল কিন্তু যে রেশ তারা  মনের মাঝে রেখে গেছে  তা ভোলা কঠিন। তাদের  সকলের  প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিবর্ণ স্মৃতিকে  একটু ঝাড়পোঁছ করে চাগিয়ে তোলার অক্ষম  প্রচেষ্টা।