Friday, 7 October 2022

বুড়ো বুড়ির গপ্পো

বেশ বড় মাপের  পার্কের  একটা দিক সিনিয়র সিটিজেন  মানে বুড়োবুড়িদের জন্য নির্দিষ্ট  হয়েছে। রয়েছে নানাধরণের ফুলের গাছ আর বার্ধক্য নগরীর পার্ক বলে অনেকটা জায়গাই এই বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের জন্য  রাখা হয়েছে। আজকাল শহরের  বিভিন্ন  লোকালয়ে এই ধরণের ছোটখাটো পার্ক হয়েছে যেখানে এই বুড়োবুড়িরা এসে একটু বুকভরে নিঃশ্বাস  নিয়ে নিজেদের  মধ্যে একটু গল্পগুজব  করতে পারে। এই পার্কটা বেশ বড়, সুতরাং বাচ্চাদের জন্য ও অনেকটাই  জায়গা রয়েছে তাদের  খেলাধূলার জন্য,  রয়েছে নানাধরণের উপকরণ, আর তার পাশেই রয়েছে একটা জিমন্যাসিয়াম যেখানে অল্পবয়সীদের ভিড়, নানাধরণের কসরত হচ্ছে সেখানে।  আছে সেখানে কিছু মাঝবয়সীরাও যাঁরা শরীর সচেতন এবং সবচেয়ে মজার  ব্যাপার কিছু মেয়েরাও এই সচেতনাতে  সাড়া দিয়েছেন এবং অবশ্যই  সেখানে কিছু মাঝবয়সী মহিলারাও  আছেন। অবাক  হওয়ার কথা, শ্বাশুড়ি ও বৌমাও রয়েছেন তাঁদের  মধ্যে খানিকটা হাম কিসিসে কম নেহির  মতন ব্যাপার স্যাপার। বাচ্চাদের  নিয়ে মায়েরা কিংবা যেখানে একটু বেশী পয়সা আছে সেখানে কাজের  লোকেরা বাচ্চাদের  নিয়ে খেলাচ্ছে এবং মায়েরা নিজেদের মধ্যে নানান বিষয়ে আলোচনায় মত্ত-- কোন কোন সময় শ্বশুর শ্বাশুড়ির পিণ্ডি চটকানোও তার মধ্যে আছে। উল্টোদিকে শ্বাশুড়িদের মধ্যেও  বৌমা এবং তার  বাপের বাড়ির  নিন্দেবান্দাও  বাদ নেই। অবশ্য  এই সব নিয়েই তো সংসার , নাহলে আর মজাটা কোথায় ?  এই সবনিয়ে  হাজারো সিরিয়াল  হয়ে গেছে আর লোকে  হাঁ করে এই সব মহাভারতের মতো সিরিয়ালগুলো গোগ্রাসে গেলে। ঐসময় যতই প্রিয় বন্ধুই হোক না কেন  নট ওয়েলকাম অ্যাট অল, নো ডিসটার্বেন্স পারমিটেড। যাক গে, আজকের  বিষয় বস্তু হচ্ছে বুড়োবুড়ির গপ্পো।

গেট দিয়ে ঢুকেই ডানদিকে একটা ছোট্ট  সাইনবোর্ডে বাঁকা ট্যারা ভাবে লেখা আছে ফর সিনিয়র সিটিজেন'স ওনলি। সুন্দর  ফুলের গাছ দিয়ে বেড়া দেওয়া বেশ প্রশস্ত একটা জায়গা। সুন্দর সাজানো গোছানো ফুলের গাছ এখানে ওখানে। মাথার  উপর ছাতা করা সিমেন্টের  বাঁধানো গোল বসার  জায়গা অনেকগুলো যেখানে  অনেক ভিন্ন বয়সী ভিন্ন  স্বাদের আলোচনাকারী বুড়োবুড়ি বসে গল্প গুজব করতে পারেন। এখানকার  মেম্বারশিপ প্রায় বাঁধা। নতুন  কোন বুড়ো বুড়ি এলেই হঠাৎ ঐ বাঁধা মেম্বারের জায়গায় বসতে পারবেন  না। ঐ ছাতাগুলোও ভিন্ন  আলোচনাকারী মেম্বারদের জন্য।  কোন জায়গায় ধর্মীয় আলোচনা তো কোথাও  রাজনীতি বা কোথাও   সঙ্গীতের  আলোচনা চলে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে এক রসের  ব্যক্তি অন্য রসে বেমানান। এছাড়াও  রয়েছে বুড়িদের আলাদা বসার  জায়গা। জীবনের  শেষ প্রান্তে এসেও  লেডিজ  আর জেন্টস।  কিছুদিনের  মধ্যেই  তো একই জায়গায় পৌঁছাতে হবে, সেখানেও  কি লেডিজ আর জেন্টস থাকবে? যাই হোক, ঐ বাঁধানো সিমেন্টের ছাতাওয়ালা সিটে মাথা ঢোকানো যে সে  কম্মো নয়, সেখানেও  কারও  রেকমেন্ডেশন বা কেউ হঠাৎই  না ফেরার  দেশে চলে গেছেন  এবং একই ধরণের আলোচনায় অংশ গ্রহণ করবেন এইরকম  লোকই  ঐ বিশেষ  জায়গায় বসতে পারবেন  নাহলে হয়  অন্য টাইম স্লটে বসতে হবে আর তা নাহলে ইতিউতি উঁকিঝুঁকি  মেরে কোথায় জায়গা খালি আছে দেখে বসতে হবে। অন্য পাড়ার  কুকুর  বেপথু হয়ে যদি অন্য কোন  জায়গায় ঢুকে পড়ে তার যা হাল হয় এখানেও  প্রায় সেইরকম অবস্থাই  হয়। এখানে কেউ কামড়াকামড়ি করেনা বটে কিন্তু জোড়া জোড়া কোটরাগত  ঠাণ্ডা  হিমশীতল দৃষ্টিতে নবাগত বৃদ্ধ প্রায় দগ্ধ হয়ে যান।
বিভিন্ন  ছাতার তলায় বিভিন্ন ধরণের আলোচনা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বুড়োবুড়িদের খিটিমিটির কথা নয়তো বৌমার উপেক্ষার কথা। সত্তরোর্দ্ধ ব্যক্তিদের আলোচনার বিষয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বৌমার এবং বৌ ন্যাওটা ছেলের উপেক্ষার কথা বিশেষত  যেখানে বাবা ও মা তাঁদের  সন্তানের  উপর নির্ভরশীল আর ষাটোর্দ্ধ  এবং সত্তরের মধ্যে আলোচনার বিষয়বস্তু নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্যের কথা, প্রায় হিন্দুস্থান পাকিস্তানের  মতন। এ যদি বলে ডান তো অন্যজন বলেন  বাম। যাক যতই  ডান বাম চলুক  না কেন নিজেদের মধ্যে, জিত  সেই একপক্ষের। আলোচনায় ক্ষান্তি  দিয়ে বলতে হবে আচ্ছা বাবা তুমিই  ঠিক নতুবা কোন অজুহাতে স্থান  ত্যাগ করা, নিদেন পক্ষে বাথরুম  চলে যাওয়া। যাঁরা তুমিই ঠিক  বলতে পারেন  তাঁরা এই সিটে বসবেন না আর যাঁরা তা মেনে নিতে পারেন  না তাঁরা পরদিন  এসে বন্ধুবান্ধবদের  সঙ্গে প্রসঙ্গ উত্থাপন করে খানিকটা হাল্কা হয়ে ফিরে যান তাঁরই  কাছে। এটা ঠিক  কথা  যে একটু  ফ্যাঁস ফোঁস  না হলে সংসারের মজাটা ঠিক  জমেনা। এই ফ্যাঁস ফোঁস  করতে করতেই  একদিন  এই সংসারের  সব মায়া কাটিয়ে চলে যেতে হবে সবাইকে,  কেউ দুদিন  আগে  আর  কেউ দুদিন পরে। 


Monday, 26 September 2022

গরীবের সন্ধানে

পূজো এসে গেছে। চারদিকে  সাজো সাজো রব। এক নিদারুণ  উন্মাদনা সবাইকে কেমন যেন  গ্রাস করেছে। কুচি কাচা থেকে বুড়ো হাবড়া সবাই যেন কেমন  চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন রকম  সমস্যা কিন্তু হিন্দুদের  বিশেষত  বাঙালিদের  সবচেয়ে বড় উৎসব এই দুর্গাপুজো ম্রিয়মান অর্থনীতিকে এক কোরামিন ইঞ্জেকশন দিয়েছে যেন,  চোখ মেলে চাইছে বাঙলার অর্থনীতি।
                     
                   গত দুবছর করোনার প্রকোপে লোক সেরকম ভাবে উৎসব উদযাপন  করতে পারেনি, সাধারণ  গরীবগুর্বোদের অবস্থা তো আরও  তথৈবচ।  চারদিকে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের  দুর্দশা ছিল  সীমাহীন। না আছে রোজগার পাতি, না আছে তাদের  ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ভালোমন্দ  কিছু কিনে দেওয়ার সামর্থ্য।  এবছর মায়ের  আগমনের  আগেই করোনা নামক  দৈত্য বিদায় নিয়েছে , অবশ্য একেবারেই  যে আপদ বিদায় হয়েছে তা নয়, নব কলেবরে নতুন নামে তিনি আবির্ভূত হয়েছেন  কিন্তু টীকার প্রভাবেই হোক আর মানুষের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা বাড়ার জন্যই হোক তারা এখন  মরিয়া হয়ে গেছে। সমস্ত রাজ্যে দুর্নীতির  রমরমা, এ বলে আমায় দেখ ও বলে আমায় দেখ কিন্তু এ সত্ত্বেও  পূজোর  সংখ্যা বেড়েছে আর তারই সঙ্গে বেড়েছে লোকের  আয় করার ক্ষমতা বিশেষ করে এই সময়। দুর্নীতির নাগপাশে আষ্টে পৃষ্টে বাঁধা সরকারের  নেতা মন্ত্রীরা কিন্তু টিভি চ্যানেলে কোমরবেঁধে ঝগড়া দেখলেই আপ্তবাক্য মনে পড়ে যায় চোরের  মায়ের  বড় গলা। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার উপরতলায় চোর এবং সাধুর কুশল বিনিময় দেখলে মনেই হবেনা যে কিছুক্ষণ  আগেই টিভির  চ্যানেলে এরা প্রায় বাহুযুদ্ধে সামিল হচ্ছিল। আসলে ব্যাপারটা কি,বর্তমান দলে কখন দমবন্ধ  অবস্থা হবে কেউ জানেনা, সুতরাং নতুন  পদক্ষেপে যাতে বিন্দুমাত্র  দুর্ভোগ  না হয়, তার আগাম প্রস্তুতি রাখা সবসময়ই  ভাল। পূজোর বাজেটে কেউ কম যায়না। প্রতিবছর বাজেটের পরিমাণ বেড়েই চলেছে এবং প্রতিটি পূজোরই  পৃষ্ঠপোষক কোন নেতা বা মন্ত্রী। যার যেমন ওজন,  তার বাজেটের ওজন ও সেইরকম।  নেতারা চাপ দেন ব্যবসায়ীদের  আর তাঁরা থোড়াই  নিজের  পকেট থেকে দেন, সুদে আসলে সাধারণ মানুষের পকেট কাটেন।  এর ওপর আছে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা। ফি বছর বাড়ছে পূজোয়  সরকারী অনুদান।  যত পূজো,ততই  অনুদান।  দেশে চাকরির  সংস্থান নেই, যোগ্য চাকরি প্রার্থীকে ঘেঁচুকলা দেখিয়ে অযোগ্য  লোকজনদের উৎকোচের বিনিময়ে চাকরি  দিয়ে  দেওয়া, এ এক অসহনীয়  পরিস্থিতি। ছেলেমেয়েদের মধ্যে পড়াশোনার  চল কমেছে, মাস্টার মশাইদের সম্মান  কমেছে, ফলে ফুলে বেড়েছে শুধু নেতা,মন্ত্রী ও তাঁদের  পারিষদবর্গের। রমরমিয়ে রথের চাকা চালিয়ে যান নেতা, চাকার তলায় পিষ্ট হন সাধারণ জনতা। যত কম  বলা যায় ততই  মানসিক  শান্তি বজায় থাকে। আরে বাবা, এত কথা বলা কেন? খেয়ে দেয়ে চুপ করে বসে থাকতে পারনা? সেটা পারলেই আসবে অপার শান্তি।

গতকয়েক বছর ধরে এক নতুন হুপোৎ হাজির  হয়েছে। সেটা হচ্ছে দরিদ্র জনগণের উপকার করা। কিছু লোকের  এটা বরাবরের অভ্যেস  কারণ তাঁরা হয়তো সেই দারিদ্র্যকে খুবই কাছ থেকে দেখেছেন  কিম্বা তাঁদের যে শিক্ষা প্রাপ্তি ঘটেছে তা সত্যিই খুব সুন্দর। যে কারণেই  হোক না কেন সাধারণ মানুষের কষ্ট  দেখলে তাঁরা স্থির  থাকতে পারেন না এবং তাঁরা সাধ্যমতন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। বহু সংস্থাই আছে যারা বিপদে আপদে সাধারণ মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান এবং এদের মধ্যে রামকৃষ্ণ মিশন এবং ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের  নাম প্রথমেই  মনে পড়ে। এঁরা সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী এবং কোনরকম  নাম কামানোর জন্য  এঁরা কিছু করেন না, এঁদের  কর্মযজ্ঞ বিশাল। এঁরা ছাড়াও  কিছু সংস্থা আছে যারা বিভিন্ন সময়ে সাধারণ জনগণের  পাশে এসে দাঁড়ান। কিন্তু এদের  মধ্যে কতজন নিঃস্বার্থ ভাবে আসেন  তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। এঁরা বিভিন্ন  পেশায় যুক্ত এবং তাঁদের  পেশার  প্রসারের জন্যই  এগিয়ে আসেন।  তাঁদের  দরকার  একটা প্ল্যাটফর্ম  এবং একবার  সেই উঁচুতলার সোপানে উঠতে পারলে আর পায় কে? দুই থেকে চার, চার থেকে আট, এঁদের  খ্যাতি দিনদিন  বেড়ে ওঠে এবং তার সঙ্গেই  বেড়ে ওঠে তাদের ব্যবসায়িক দিক। একটা প্ল্যাটফর্ম  পেলেই সেটা ভাঙিয়ে নানান কায়দায় লোকের  ঘাড় ভাঙা এবং কেষ্টবিষ্টুদের সঙ্গে ওঠাবসার সুবাদে সরকারী, বেসরকারি সুযোগের  সদ্ব্যবহার করেন  এঁরা এবং অধিকাংশ  লোক ই এই জাতীয় মতলববাজ। আর কুম্ভীরাশ্রু বহানোয় এঁদের  জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু এঁরা নিজের গাঁটের  কড়ি থোড়াই খরচ করেন? না, সেই সব হয়ে গেছে প্ল্যাটফর্ম  পাওয়ার আগে। এখন  ধীরে ধীরে সূতোটানার পালা এবং যা খরচ হয়েছে তা সুদে আসলে উঠিয়ে আনা। এঁরা ফটোশুটে  খুবই পারদর্শী এবং এঁদের  বাহন এই গরীব  জনগণ। সুতরাং, গরীব  খোঁজ।  আর এই গরীব  খোঁজার প্রতিযোগিতায় সামিল  হন এই জাতীয় বহুলোক।  আর এই তথাকথিত  গরীবদের ও পোয়াবারো। এরা একবার  এই সংস্থা আর একবার  ওই সংস্থায় মুখ দেখায় এবং তাদের  কাছ থেকে প্রাপ্ত সামগ্রী বাজারে বেচে দেয়। শীতের  সময় যদি একই মানুষ চারটে কম্বল পায় তারা কি চারটে কম্বল গায়ে দেবে না একটা রেখে বাকি তিনটে বিক্রি করবে? আর এই বিতরণের  সময়  পেটোয়া ফটোগ্রাফার  ফটাফট ছবি তুলে বিভিন্ন  জায়গায় পাঠিয়ে দেয় এবং কেল্লা ফতে।এই প্রক্রিয়ায়  সামিল  হয়েছে বহু  ব্যাঙের ছাতার  মতো গজানো সংস্থা এবং বহু  গজুদারা। আর এই তথাকথিত  গরীবরাও আছে খোশ মেজাজে। বহু সংস্থা আবার  এই তথাকথিত  গরীবদের উন্নয়নের জন্য  বিদেশ থেকে প্রচুর টাকা পায় এবং তার  বহুলাংশই  নিজেদের বিলাস ব্যসনে ব্যয় করে এবং নামমাত্র  কিছু গরীবদের  জন্য বরাদ্দ করে। ব্যানার লাগানো, ফেস্টুন লাগানো খান চারেক গাড়ি থেকে কিছু তথাকথিত গরীব দরদী লোক নেমে, " অ্যাই এখানে তোরা কজন আছিস? জামাটা খুলে একটা  নোংরা বা ছেঁড়া গেঞ্জি পড়ে এখানে এসে লাইন  দিয়ে দাঁড়া।" কেউ বা ছেঁড়া লুঙ্গি বা গেঞ্জি আবার কেউ বা আদুর গায়েই খালি পায়ে এসে লাইনে দাঁড়ালো এবং একটা দামী গাড়ি থেকে একটু হিরো গোছের লোক, চোখে দামী সানগ্লাস,  পায়ে হেব্বি জুতো নেমে এলেন  এবং একজন পার্শ্বচর  একটা বড় গোছের  সাদা বাক্স এবং একটা মিনি বোতল তাঁর হাতে দিতে থাকল এবং তিনি সেই লাইনে দাঁড়ানো গরীবদের  হাতে দিতে থাকলেন  এবং  ফটাফট  ছবি উঠতে থাকল।  সবাইকে দেওয়া হলে এক আত্মতৃপ্তির হাসি ও ঢেকুর  তুলে তিনি গাড়িতে উঠে  পড়লেন। সম্প্রচারের গাড়িটাও তাঁর গাড়ির  পিছু পিছু চলে গেল  এবং এই সঙ্গেই সাঙ্গ হল' গরীবদের  উন্নয়নের  পালা । 

সিরিয়ালের শুটিং না  সত্যি সত্যিই কোন জনহিতকারি সংস্থার দান সেটা বোঝা গেলনা কিন্তু একটা জিনিস প্রকট হলো যে সবটাই  মেকি, লাভের  মধ্যে ঐ কয়েক জন গরীবদের অন্তত একদিন  ভাল মন্দ খাওয়া দাওয়া। কবে বন্ধ  হবে এইরকম  চটজলদি দারিদ্র্য  দূর করার কৌশল? যদি সত্যিই  কিছু জনহিতকর কর্ম করতে হয়, তবে এমন কিছু করা দরকার  যাতে লোকজন  নিজের  পায়ে দাঁড়াতে পারে এবং তাদের  ভিক্ষার আশ্রয় না নিতে হয়। ভিক্ষার দান নিতে নিতে তাদের  কর্মক্ষমতা একদম শূন্যে এসে ঠেকে এবং কোন  কাজই তাদের  করতে ইচ্ছা করেনা। কায়িক  পরিশ্রমের ফসল একবার  উঠতে শুরু করলে হাত পাততে  তার লজ্জ্বা বোধ হবে এবং আমরা সেইদিনের প্রতীক্ষায় থাকব। যেদিন  এরা মাথা তুলে দাঁড়াতে শিখবে সেইদিন এই ভেকধারী সমাজসেবীও উধাও  হয়ে যাবে। আমরা কি একটু চেষ্টা করতে পারিনা?

Wednesday, 10 August 2022

বানপ্রস্থ

পূর্বে প্রচলিত কথা ছিল  পঞ্চাশোর্ধে বনং ব্রজেত অর্থাৎ  পঞ্চাশ  পেরোলেই রিটায়ারমেন্ট ফ্রম অ্যাকটিভ লাইফ। রাজা রাজড়ারা তাঁদের  সাধের সাম্রাজ্য সন্তান সন্ততিদের হাতে ন্যস্ত করে বনে চলে যেতেন এবং বাকি জীবনটা ধর্মকর্মে ব্যস্ত থেকে কাটিয়ে দিতেন। কিন্তু একটা খটকা মনের  মধ্যে থেকেই  যায়। রাজা মহারাজারা সাধারণত পরনির্ভরশীল ছিলেন  অর্থাৎ দাসী বাঁদি বা ভৃত্য পরিবৃত থাকতেন এবং তাঁদের সমস্ত কাজ এই চাকর বাকররাই করতো। তাহলে বনে যাবার পর হঠাৎই  নিজের কাজ নিজেরা করতে শুরু করে দেবেন  এটা ভাবা খুবই কষ্টকর। তাহলে কি তাঁরা সমস্ত  লোক লস্কর সমেত যেতেন আর যদি সেটাই হয় তাহলে সেই লোকদের  থাকার  জন্য কাছাকাছি তাদের  বাসস্থান বা বেঁচে থাকার জন্য  নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের জোগাড় করতে হতো যার অর্থ  আরও একটা জনপদ গড়ে ওঠা । তাহলে বন আর কি করে বন থাকে? এই ধন্দ মেটানোর জন্য ভাবতে বাধ্য  হতে হলো যে ঐ ব্যবস্থাপনাই কি আজকের  বৃদ্ধাশ্রমের ব্লুপ্রিন্ট?  নানাভাবে দীর্ঘদিন ধরেই এই প্রশ্নের  উত্তর  খুঁজে চলেছি, তাই ভাবলাম  যে কোন সহৃদয়  ব্যক্তি হয়তো আমার অনুসন্ধিৎসা মেটাবেন বা আমার  নিজস্ব  চিন্তাধারাকে তাঁদের  মেধা দিয়ে পরিপুষ্ট করবেন। তবে একটা কথা ঠিক যে রাজা বা রানী সাধারণ জনগণের  মতো হাতে বাজারের থলি ঝুলিয়ে দোকান বাজার  করতে যাবেন আর  চাইলেও ঐ বনবাদাড়ে কে দোকান খুলতে যাবে রাজা রানীর চাহিদা মেটানোর জন্য? এইসব আবোল তাবোল চিন্তা মাথার  মধ্যে ঘুরপাক খায়। তারপর তো শরীর সরাগতের ব্যাপার  আছে। রাজা রানীরাও তো আদতে মানুষ।  তাঁদের ও শরীর খারাপ  হতে পারে। আগে না হয় রাজবৈদ্য ছিল, হুকুম  হলেই নিদান নিয়ে তারা হাজির হতো কিন্তু এই বনে তাদের  বয়ে গেছে থাকতে। তারপর তাঁদের  কেউ মারা গেলে  অপরজন  কি করতেন? শবদেহ করা কি তাঁদের  দ্বারা সম্ভব? এই নিদারুণ  অবস্থা থেকে বাঁচার  একমাত্র  উপায় যে কাছাকাছি কোন  লোকালয়ের   উপস্থিতি এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের  দেখভাল  করার  জন্য  পর্যাপ্ত  লোক লস্কর। মানে আজকের  দিনে পেনশন ভোগী। পেনশনের টাকায় যেমনভাবে  চলা দরকার  তেমনভাবে  চলো।

মাঝে মাঝেই মনে হয় বৃদ্ধাশ্রমে চলে গেলে কেমন  হয় বিশেষ করে যখন  সংসারে খিটিমিটি লাগে। তবে মাঝে মাঝে ফ্যাঁস ফোঁস  না হলে সংসারটা  যেন কেমন  পান্তা ভাত হয়ে যায়। অবশ্য  পান্তা ভাতে পেঁয়াজ,  লঙ্কা ছাতু দিয়ে খাওয়াটাও  একটা ভীষণ  ডেলিকেট খাওয়া আর তার মধ্যে যদি শুকনো লঙ্কা ভেজে মাখা  খাওয়া যায় তাহলে সেটা একটা বিশেষ মাত্রা পায়। সুতরাং মাঝে মধ্যে বৃদ্ধাশ্রমের চিন্তা মাথায় আসেনা  এরকম  নয় কিন্তু ভাল মন্দ  সবকিছু মানিয়ে নিয়ে চলাটাই তো জীবনের আর একটা নাম। কালের গতিতে স্বামী স্ত্রীর  দুজনের মধ্যে কেউ না কেউ তো একজন হয়ে যাবে, তখন  কি করা যাবে? সবাই  তো আর   জেনারেল বিপিন রাওয়াত এবং তাঁর  স্ত্রীর  মতন সৌভাগ্যবান বা সৌভাগ্যবতী নন যে দুজনেই  একসঙ্গে চলে যাবেন।  অতএব  কাউকে না কাউকে একা থাকতেই হবে, উপায় নেই। ছেলে মেয়েরাও  দূরে থাকে , কর্ম ব্যস্ততার মধ্যে তাদের ও নিজেদের  সংসার  ছেড়ে বৃদ্ধ বাবা বা মাকে দেখতে আসাও  সবসময়  সম্ভব  হয়ে ওঠেনা।  তাহলে উপায় কি? ছেলের  সংসার  বা মেয়ের সংসারে কাবাব মে হাড্ডি হয়ে থাকা নতুবা নিজের  বাড়িতেই থেকে অপরের স্মৃতিতে বিভোর  হয়ে থাকা  বা নতুন বন্ধুর  খোঁজে বৃদ্ধাশ্রমের পথে পা বাড়ানো। বন্ধুর  খোঁজে বৃদ্ধাশ্রমের  পথে পা বাড়ানো খুব  একটা খারাপ  কিছু নয় কিন্তু সেখানে গিয়েও যে সমমনোভাবাপন্ন লোক পাওয়া যাবে এমন কোন  নিশ্চয়তা নেই। এছাড়া রয়েছে বৃদ্ধাশ্রমের  নিজস্ব  নিয়মকানুন  যা পছন্দ  না হলেও  মেনে চলতেই হবে যদি ওখানে একান্তই থাকতে হয়। তাছাড়া কর্মীদের  মুখঝামটা যে মাঝেমধ্যেই  শুনতে হবেনা এমন গ্যারান্টিও নেই। সুতরাং গরম  কড়াই  থেকে আগুনের  মধ্যে ঝাঁপ দেওয়ার  কোন মানে  আছে কি? বাইরে থেকে ঝাঁ চকচকে রূপ  দেখে না ভোলা শ্রেয়। নিজের  বাড়িতেই  থাকা এবং পাড়া প্রতিবেশীদের  সঙ্গে সৌহার্দ্য পূর্ণ  সম্পর্ক  বজায় রাখাটাই  সবচেয়ে ভাল।  ভগবানের  দেওয়া দান একটা জীবনের  উৎকর্ষতা তারিয়ে তারিয়ে  উপভোগ  করে কালের নিয়মে ফিরে যাবার  আগে দেহদান করে জীবনের  যতপাপ খানিকটা ক্ষালন করা মনে হয় সর্বোত্তম। নিজের  ছোট পরিসর নিজের  সাম্রাজ্য  মনে করে মন চল নিজ নিকেতনে বলে আমার বিচার তুমি কর তব আপনার করে বলে সুন্দর পৃথিবীকে জানাও বিদায়।

Friday, 5 August 2022

বাস্তুহারা

গল্পের  নামটা উদ্বাস্তু না বাস্তুহারা হওয়া উচিত তা নিয়ে একটু ধন্দে ছিলাম। বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী আমি কখনোই  নই, গড়পড়তার চেয়ে একটু সামান্য  বেশি। ভাবলাম  কোন  বন্ধুবান্ধবদের  কাছে জেনে নেব  সমস্ত  ঘটনাটা বর্ণনা করে কি হওয়া উচিত  নামটা। একটু গভীর ভাবে চিন্তা করে বাস্তুহারা নামটাই দিলাম  কারণ  উদ্বাস্তু কথাটা সাধারণত  ব্যবহার  হয় যেখানে কেউ নিজের  দেশ ছেড়ে যে কোন  কারণেই  হোক পালাতে বাধ্য হয় এবং অন্য  দেশে তাকে আশ্রয় নিতে হয় যেমন  হয়েছিল  দেশভাগের  সময়। বাস্তুহারাদের ক্ষেত্রেও প্রায় সেইরকম ই কিন্তু সেটা দেশভাগের জন্য নয়, কোন  প্রাকৃতিক  দুর্যোগ  হেতু বা কারও অত্যাচারের জন্য  যেখানে তার ফিরে যাবার  সম্ভাবনা থাকে। ধারণা ঠিক  নাও হতে পারে এবং সংশোধনের কথাও মনে থেকে গেল। 

সরকারি প্রকল্পে  যে আবাসনগুলো গড়ে উঠেছিল সেগুলো ঠিক তাৎক্ষণিক  চাহিদার কথা মাথায় রেখে, অদূর ভবিষ্যতে কি হতে পারে সেই কথা মাথায় ছিল  বলে বিশেষ  মনে হয়না। সরকারের কাজ   তখন  ছিল জনগণের  সেবা করা এবং সেটাই হওয়া উচিত কিন্তু উন্নয়নের জন্য যে টাকার দরকার সেটা কিভাবে আসবে তা নিয়ে খুব  গভীর  চিন্তাভাবনা ছিল  বলে মনে হয়না। স্বাধীনতার পর  দেশ গড়ে তুলতে অনেক অর্থের  প্রয়োজন। কিন্তু জনগণের  উপর ট্যাক্স  চাপানো চলবে না, তাদের নিখরচায় বা সামান্য টাকার বিনিময়ে স্বাস্থ্য পরিষেবা দিতে হবে, গরীবদের জন্য  বিনামূল্যে রেশন দিতে হবে, তাদের বিনামূল্যে মাথা গোঁজার ঠাঁই দিতে হবে, নিম্ন মধ্যবিত্ত , মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের জন্য আবাসন তৈরী করে দিতে হবে এবং তা বিক্রি করা হবে কোন  লাভ  না করেই। বিনামূল্যে বা অত্যন্ত  স্বল্প  মূল্যে শিক্ষার  ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু এই বিশাল  কর্মযজ্ঞের  জন্য যে অর্থের প্রয়োজন  তার সংস্থান কি করে হবে সেটাও  তো ভাবার প্রয়োজন।  শুধু টাকা  ছাপিয়ে আর বেসরকারী উদ্যোগপতিদের  উপর ট্যাক্স  চাপিয়ে এটা কতটা সম্ভব সেটা  নিয়ে বিশেষ ভাবনাচিন্তা ছিল বলে মনে হয়না। এর উপর ছিল রাজনৈতিক নেতাদের সাধারণ  মানুষের  ভিতর এক ধারণার  সৃষ্টি করা যে বেসরকারী উদ্যোগপতি মানেই  তারা সাধারণ  জনগণের  শত্রু এবং বিশেষ  চিন্তায় উদ্বুদ্ধ  হয়ে এক নতুন কথার আবিষ্কার   শ্রেণীশত্রু  ও শ্রেণীসংগ্রাম। উদ্যোগপতিদের  কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও জাতীয় কথাবার্তা কতটা ভাল  করেছে তাতে যথেষ্ট  সন্দেহ  রয়েছে। অন্তত  একটা জিনিস  করা সম্ভব  হয়েছে, তা রাজনৈতিক  চেতনা বাড়ানোর  নামে মানুষের  মনে হিংসার বীজ খুব  সুন্দর ভাবে বুনে দিতে পেরেছে এবং উত্তরোত্তর  তা বেড়ে এক বিশাল  মহীরুহের আকার ধারণ  করেছে এবং সেটা আজ বিভিন্ন ভাবে শাখাপ্রশাখা বিস্তার করেছে এবং কখনো তা জাতিভেদে এবং কখনো তা ধর্মভেদের  মাধ্যমে প্রতিফলিত  হয়েছে। কিন্তু যাঁরা এই বীজ বপন করেছেন  তাঁরা সবজায়গায় সুন্দর ভাবে মিলে মিশে আছেন, একবার  সাপের গালে আর একবার  ব্যাঙের  গালে চুমু খাচ্ছেন। 

ফিরে আসা যাক মূল বক্তব্যে। সরকারী উদ্যোগে গড়ে ওঠা আবাসনগুলো মানুষের বেড়ে ওঠা চাহিদার  সঙ্গে তাল না মেলাতে পারায় সেগুলোর পরিবর্ধনের প্রয়োজন অনুভূত হয়েছে এবং বয়স বাড়ার  সঙ্গে সঙ্গে হাত পায়ের জোর  কমেছে এবং উপরতলায় থাকা লোকজনের লিফটের প্রয়োজন মনে হয়েছে। এই আবাসনগুলো যখন  হয়েছিল  তখন কেউ এই চিন্তা করেননি যে বয়স হলে সবার সিঁড়ি ভেঙে চারতলায় বা পাঁচ তলায় উঠতে কষ্ট  হবে এবং লিফটের  চিন্তা মাথায় আসেনি।  অবশ্য  লিফট করে ওঠা লোকজন মানে এক বিশাল  ব্যাপার এবং নিশ্চয়ই  তারা পুঁজিপতি। মনে পড়ে যখন  জ্যোতিবাবুর হিন্দুস্থান  পার্কের  বাড়িতে  লিফট বসানো হয় তখন  কাগজে কাগজে সমালোচনার  প্রতিবেদনে ছেয়ে গিয়েছিল।  সেইরকম ই সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন  তাঁর চেম্বারের সংলগ্ন  বাথরুম  সংস্কারের তীব্র  সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। হয়তো সকলের মনে আছে যে কারও  বাড়িতে ফ্রিজ থাকলে তাকে বুর্জোয়া শ্রেণীভুক্ত করা হতো এবং আরও  কিছুদিন  পরে যখন  সাদাকালো টিভি এল তখন  যার  বাড়িতে টিভি এল তারা ছাড়া পাড়ার  আর সবাই  সেই ঘরের  আনাচে কানাচে পর্যন্ত  দখল করে নিত। আমাদের  মানসিকতা তখন  এর বাইরে বেরিয়ে আসতে পারেনি। রেডিও তে মোহনবাগান  ইস্টবেঙ্গল  ম্যাচের ধারাবিবরণী অজয় বসু, কমল ভট্টাচার্য এবং পুষ্পেন সরকারের মাধ্যমে সম্প্রচার  একটা গোটা পাড়ার  লোক একসঙ্গে শুনতো।  সুতরাং বোঝা যায় সাধারণ  মানুষের  কি অবস্থা ছিল। আবাসন গুলোর এক্সটেনশন করার জন্য সবাই এককাট্টা  হয়ে দরখাস্ত  করেছে এবং কর্পোরেশনের স্যাংশনের জন্য  প্রয়োজনীয় অর্থের বহু গুণ অর্থ  বিভিন্ন ধাপে সাম্মানিক মূল্য হিসাবে দিতে হয়েছে।  কিন্তু এ সত্ত্বেও  সমস্ত আবাসিকরা বিভিন্ন  কারণে এই উদ্যোগে সামিল  হতে পারেন  নি এবং বহুতলীয়  এই বাড়িগুলোর ফাঁকা অংশগুলো  খানিকটা  হাঁ করা মড়ার মাথার  খুলির  মতন লাগত। এইরকম ই কয়েকটা ফাঁকা জায়গা কিন্তু আমফানের সময় বহু পাখির  আশ্রয়স্থল হয়েছিল।  যখন  প্রবল ঝড়ে সমস্ত গাছগুলো একের পর এক ধূলিসাত হয়ে যাচ্ছে  তখন ঐ পাখিগুলোর কি দুর্দশা। যখন গাছগুলো সাধারণ অবস্থায় থাকে তখন  রোজ সন্ধেবেলায় পাখিদের  মধ্যে অনবরত ঝগড়া লেগেই থাকে। কাকের সঙ্গে শালিকের বা শালিকের নিজেদের  মধ্যে বা শালিকের সঙ্গে ময়নার  ঝগড়া নিত্যদিনের ব্যাপার  কিন্তু আমফানের  সময় সবাই নিজেদের  ঝগড়া ভুলে একসঙ্গে সবাই আশ্রয় নিয়েছে ঐ মড়ার খুলির  মুখের মধ্যে। শাটার টানা ব্যালকনিতে বসে তাদের  ঐ করুণ অবস্থা লক্ষ্য  করেছি। এক্সটেনশন  না করা ঐ ফ্ল্যাটের  ভদ্রলোক কিন্তু খুবই  মানবিকতা দেখিয়েছেন  ঐ অবস্থাতেও।  প্যাকেট প্যাকেট  বিস্কুট,  ভাত ছড়িয়ে দিয়েছেন তাদের  উদ্দেশ্যে এবং ঐ সময়ে তারাও  ঝগড়া ভুলে নিজেদের  মধ্যে ভাগ করে খেয়েছে। সাধারণত  কাকেদের থাকে দাদাগিরি কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার তারা কিন্তু সব বৈরীতা ভুলে নিজেদের  বাঁচিয়ে রেখেছিল।  আস্তে আস্তে আমফান বিদায় নিল, এখন ঘরে ফেরার  পালা। কি ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে তা নির্ধারণ  করার পালা। বহু গাছই  ভেঙে গেছে ,যে কয়েকটা নিজেদের  বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে  তা সবাইকে স্থান  দিতে অপারগ। এখানে কোন সরকারী সহায়তা নেই , নেই কোন  তার  থেকে দুপয়সা  রোজগার করা, আছে শুধু ঐ কয়েকটা এক্সটেনশন  না করা ফ্ল্যাট এবং বিভিন্ন বাড়ির কার্নিশ এবং গাছগুলো  বেড়ে উঠে ডালপালা বিস্তার  করার অপেক্ষা। এরই  মধ্যে   এক্সটেনশন  না করা ফাঁকা ফ্ল্যাটের দেয়াল উঠতে শুরু হয়েছে আর পাখিগুলো একদৃষ্টে  লক্ষ্য  করছে কতটা উঠল ঐ দেওয়াল এবং  দিন গুনছে ফের বাস্তুহারা হবার  আশঙ্কায়। গাছগুলো তো এখনও  সেইভাবে বেড়ে ওঠেনি যাতে সবার বাসস্থানের  স্থান হয়। হায়, কারও পৌষমাস আর কারও  সর্বনাশ। 

Wednesday, 3 August 2022

অথ যৌধেয় বিবাহ কথা

যুধিষ্ঠিরের নিজের  পছন্দের স্ত্রী দেবিকা যদিও সেটা ঘটকালি  করেই এবং তাদের একমাত্র  পুত্র যৌধেয়। মহাভারতে এদিক সেদিক আতিপাতি করে খুঁজেও যৌধেয়র বিয়ের কথা জানা গেলনা এবং অধুনা যৌধেয়র ও বিয়ের কথা প্রায় সেইরকম পর্যায়েই চলে যাচ্ছিল  কিন্তু ভগিনী দুঃশলার অতি আদরের প্রিয়পাত্র যৌধেয়( আজকের  নুটু) তার পিসির  কথা একদমই  ঠেলে ফেলতে পারলনা এবং তারই সহপাঠিনী এবং দীর্ঘদিনের বান্ধবী ও বহু সুখ দুঃখের সমব্যথী তিতলির  সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারটা চুকিয়ে ফেলে সবাইকে চিন্তামুক্ত করতে চাইল। এখন জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরকে পায় কে, আনন্দে আত্মহারা এবং তারই সঙ্গে দেবিকাও। অন্য পাণ্ডবরাও খুবই খুশি এই খবরে কিন্তু যুধিষ্ঠির ও দেবিকার কপালে ফুটে উঠেছে চিন্তার  ভাঁজ  কারণ ভীম ও বালন্দারার দীর্ঘদিনের অনুপস্থিতি এবং নকুল ও কারেনুমতীর বিশ্ব পরিভ্রমণ। উপস্থিত  কেবল অর্জুন ও সুভদ্রা  এবং সহদেব  ও দেবিকা। অর্জুনের  সহায়তায় যুধিষ্ঠির তাঁর দুই হাঁটুই  প্রতিস্থাপন  করিয়েছেন  এবং সহদেবের ও অবস্থা তথৈবচ। তিনিও যুধিষ্ঠিরের  পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন এবং এখনও টলোমলো অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন নি এবং ইদানীং কালে অর্জুনের শরীরটাও  বিশেষ  যুতসই  নয়। 

নুটু এবং তিতলি দুজনেই  বাইরে থাকে এবং বর্তমানে তিতলি প্রাগে  পোস্ট ডক্টরেট করতে চলে গেছে এবং নুটু ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সে থিসিস  জমা দেবার  উদ্যোগ করছে। তিতলিরা যমজ বোন এবং ওর চেয়ে কিছু সময়ের বড় তিয়াস তার বন্ধু শতদ্রুকে বিয়ে করে ক্যালিফোর্নিয়ায় গুগলে কর্মরত। তিতলির কিন্তু মনোগত ইচ্ছা কোন ইনস্টিটিউটে পড়ানো এবং একই মনোভাব নুটু বা যৌধেয়র। নুটু টাটা কনসালটেন্সির তিনবছরের চাকরির সম্পর্কে ছেদ ঘটিয়ে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সে রিসার্চ করতে লেগে গেল  এবং সেই কারণেই তার ডক্টরেট করাটাও একটু দেরী হয়ে গেল। কিন্ত জ্ঞান পিপাসা এমনই একটা জিনিস যা মেটাতে মানুষ সহজলভ্য সুখ ছেড়ে অনিশ্চয়তার পিছনে ধাওয়া করে। ঠিক  সময় বের করে নুটু ও তিতলির জীবনে স্থায়িত্ব আনাটা  একটু গোলমেলে হয়ে যাচ্ছিল  কিন্তু ভগবান  যখন সহায় হন তখন কোন বাধাই তার গতিরোধ করতে পারেনা। তিয়াস এবং শতদ্রু কাজের ফাঁকে একটা ছোট্ট  বিরতি নিয়ে সুদূর  আমেরিকা থেকে তিতলির বিয়েতে যোগ দেওয়ার পরদিনই সন্ধের ফ্লাইটে ব্যাক টু আমেরিকা।  

আজকের  যুগের  ছেলেমেয়েদের  যতই  দেখি ততই  আশ্চর্য  হয়ে যাই। আমাদের  সময় যেন  একটা গদাই লস্করি চাল ছিল, হচ্ছে হবে এইরকম ধারণাতেই মন মজে থাকতো কিন্তু এখন এই জেটগতির  যুগে এই এখানে,  এই সেখানে। কি সুন্দর  টাইম ম্যানেজমেন্ট,  একেবারে টাইট শিডিউল, কোথাও কোন নড়চড় হবার  উপায় নেই। নুটু এসেছে রবিবার,  বিয়ে সারলো সোমবার  এবং অষ্টমঙ্গলা সেরে শনিবার ফিরে যাবে ব্যাঙ্গালোরে থিসিস জমা দেবার জন্য। তিতলিও কয়েকদিন পরেই চলে যাবে প্রাগে তার ইনস্টিটিউটে যোগ দিতে। এরই  মধ্যে সময় করে খুব  ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করে যাচ্ছে এবং তাদের  আশীর্বাদ  পাথেয়  করে নিজেদের চলার জীবন মসৃণ করতে। 

সোমবার বিয়ের পর্ব মিটেছে যৌথ উদ্যোগে সময়াভাবের জন্য। মঙ্গলবার  দুপুরে আরও একদফা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজন এবং তারপরেই ভাঙা হাটের  পালা। তিয়াস ও শতদ্রু পাড়ি দিয়েছে তাদের  কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে। বুধবার আত্মীয়স্বজনের  সঙ্গে দেখা করার পালা। সওয়া ছটা নাগাদ নুটু ও তিতলি নামল ধবধবে একটা সাদা গাড়ি থেকে।তরতর করে উঠে চলে এল প্রাণোচ্ছল এক তরুণ ও তরুণী।  এ কুলুকুলু রবে বয়ে যাওয়া নদী নয় এ ঝরঝর করে ঝর্ণার মতো খুবই  পরিচ্ছন্ন  ও মার্জিত কথাবার্তা। নয় নয় করে কিভাবে ঘন্টা দেড়েক সময় কেটে গেল বুঝতেই  পারলাম  না। " উঠি এবার " শুনে সচকিত  হয়ে উঠলাম। মন চাইছিল ঝর্ণার  গান  আরও  কিছুক্ষণ শোনার কিন্তু উপায় নেই তাদের  অনেক কমিটমেন্ট,  সুতরাং বাধা দেওয়া যায়না। একরাশ আনন্দের  ডালি  উজাড় করে দিয়ে রেখে গেল ঝর্ণার অনুরণন। 

Wednesday, 27 July 2022

ভোম্বল

বছর তিরিশ আগেও  মধ্যবিত্ত অধ্যুষিত দক্ষিণ কলকাতার  এই উপনগরী আজকের বৃদ্ধাবাসে পরিণত হয়নি। বিভিন্ন বয়সের  নানাধরণের ছেলেমেয়েদের কলকলানিতে গমগম করতো এই উপনগরী। আশির দশকের প্রথমভাগে যখন এই উপনগরী সরকারী প্রকল্পে গড়ে ওঠে তখন এক ঝাঁক বিশিষ্ট  বিদ্বজ্জন ও নানা পেশার কলাকুশলীরা এখানে আসেন এবং তাঁদের  মিলিত প্রচেষ্টায় এই উপনগরী সংস্কৃতির  এক প্রাণকেন্দ্র  হয়ে ওঠে। এঁরা সবাই  শহরের  বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন জায়গায় থাকা পাড়া কালচারে অভ্যস্ত ছিলেন এবং ফ্ল্যাট কালচার আত্মস্থ করতে বেশ খানিকটা সময় নিয়েছিলেন। বাসের রুট তখন এদিকে বিশেষ না থাকায় লোকদের  যাতায়াত করা বেশ সমস্যার মধ্যেই ছিল। ধীরে ধীরে লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে লাগল  এবং শহরের অন্যান্য প্রাণ কেন্দ্রের সঙ্গে সংযুক্তি বাড়তে লাগল  বাস, মিনিবাস ও ট্যাক্সির  কল্যাণে। জমজমাট  হয়ে উঠল এখনকার  অন্যতম বৃহৎ বানপ্রস্থাবাস গল্ফগ্রীন।

তখনকার  যুবকরা  আজ প্রায় বৃদ্ধ। যাঁরা প্রৌঢ় ছিলেন তাঁদের অনেকেই  আজ সেই না ফেরার দেশে চলে গেছেন কিন্তু যাবার  আগে তাঁদের অভিজ্ঞতার ঝুলি উজাড় করে দিয়ে গেছেন  এবং আজকের এই মোটামুটি মধ্যবিত্ত ও বিত্তবানদের জন্য  একটা বাসযোগ্য সংস্কৃতি মনোভাবাপন্ন সোসাইটি  গড়ে তুলতে পেরেছেন। তাঁদের জানাই সশ্রদ্ধ নমস্কার। প্রত্যেক  বাড়িতেই তখন একটা দুটো বাচ্চা ছেলেমেয়ে ছিল এবং  সকাল বেলায় স্কুলের বাসের জন্য  বাবা বা মায়ের  হাত ধরে গুটিগুটি  পায়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে এবং জলের বোতল হাতে নিয়ে বাসকাকুর অপেক্ষায় থাকত। বিভিন্ন  স্কুলের  বিভিন্ন বাস,  তাদের  কাকুও  ভিন্ন কিন্তু বাসে উঠাতে আসা মা বাবাদের মধ্যে এক বন্ধুত্বের বাঁধন গড়ে উঠতে থাকল ঐ বাচ্চাদের বাসে তুলতে আসার সুবাদে। কোন বাচ্চার জন্মদিনে চেনাজানা বাচ্চাদের  সঙ্গে বাবামায়েরাও আসতেন এবং ধীরে ধীরে প্রীতির বাঁধন ও বেশ  মজবুত  হতে লাগল। স্কুলফেরত বাচ্চারা বাড়ি ফিরেই একটু খাওয়া দাওয়ার পর বিকেল  হতেই হৈ হৈ করে বেড়িয়ে পড়ত খেলার  জন্য এবং সমস্ত  জায়গাটা তাদের  কলকলানিতে  ভরে উঠত। সমাজ বন্ধন দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছিল এবংএকটা খুব  সুন্দর  পরিবেশ  গড়ে উঠেছিল।  ধীরে ধীরে এই বাচ্চারা বড় হতে লাগল এবং তাদের  অনেকেই  আজ শহরের  বাইরে এবং কেউ কেউ দেশের ও বাইরে।কিন্তু তাদের  ছোট থেকে বড় হওয়ার  সময়টা মানে মাঝের পনের বিশ বছর অত্যন্ত আনন্দ মুখর ছিল  এই গল্ফগ্রীন এবং এই সময়টা তুলে ধরাটাই আমার  উদ্দেশ্য। 
বাচ্চাদের  খেলার  সঙ্গে সঙ্গে একটু উঁচু ক্লাসে পড়া ছেলেদের সন্ধের  পরেও বেশ  খানিকক্ষণ  আড্ডা চলত এবং খেলার  চেয়ে বেশী  খেলার  সমালোচনা চলত। সৌরভ তখন ছিল  ওদের আইডল এবং ও বেশী রান করলে এরা এত খুশী,  যে উচ্চগ্রামে আলোচনা হতো , দেখেছিস, দাদা স্টেপ আউট করে বাপি বাড়ি যা বলে কি সুন্দর  স্ট্রেট ড্রাইভ করে ছক্কা লাগাল। কিন্তু অল্প  রানে আউট হলেই বলতে থাকত যে ওর ব্যাটটা  অতটা অ্যাঙ্গেলে স্লাইস না করে একটু শরীরের  কাছে রাখলে ঐরকম  বাজে আউট হতো না। এইসব সমালোচনা বেশ মুখরোচক  হতো এবং কেউ পক্ষে বা বিপক্ষে বলে আলোচনাটাকে  একটা অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিত।  চুপ করে একবার  এ বক্তা আরেকবার অন্য বক্তার দিকে তাকাতো  যেন কত বোঝে কিন্তু কোনরকম  বক্তব্য রাখত না সে। ও ছিল  ভোম্বল, সবার প্রিয়। যখন  তার অন্য  সঙ্গী সাথীরা ঐসব আলোচনার মধ্যে না গিয়ে নিজেদের  মধ্যেই  খেলা বা ঝগড়া করত, ভোম্বল কিন্তু ওদের  দিকে ফিরেও তাকাতো না, কেবল আলোচনা শুনত কোনরকম  মন্তব্য  ছাড়াই। রাস্তার  পাশেই  ছিল  একটা টিউবওয়েল এবং আলোচনার কেন্দ্রস্থল  ছিল ওটা। সবাই  চলে গেলে ও খানিকক্ষণ  একাই থাকত কারণ ওর বন্ধুবান্ধবরা তখন  অন্য কোথাও  চলে গেছে। অফিস থেকে  কাউকে ফিরে আসতে দেখলে ও তাকে বাড়ি অবধি পৌঁছে দিত এবং যথাস্থানে ফিরে আসত। খাওয়ার  কথা কখনোই তাকে মনে করতে হয়নি কারণ সে সবার  প্রিয় ছিল।  অন্য  পাড়া  থেকে আসা তাদেরই  সমগোত্রীয়দের প্রতি  সে পুরোমাত্রায় সহানুভূতিশীল  ছিল  এবং তার সাঙ্গপাঙ্গোদের প্রতি কড়া নির্দেশ  ছিল  যেন  কোনরকম  অভদ্রতামূলক  আচরণ  না করা হয়। তার বন্ধুবান্ধবরাও  তাকে খুব  মানত এবং ভোম্বল  ছিল তাদের  অবিসম্বাদিত নেতা। একটা দারুণ  ম্যাজেস্টিক  ভাব ভঙ্গি  ছিল তার। দীর্ঘদিন  পর ছুটিতে  বাড়ি এসেছি এবং যথারীতি দোকান বাজার  করছি কিন্তু সেই লালচে শরীর ও মুখের কাছটা একটু কালো এবং সুন্দর পাকানো  লেজের সাদা ডগাটা নাড়িয়ে আর পিছু পিছু বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে না দিতে দেখায় ভেতরটা কেমন ছ্যাঁত করে উঠল এবং বাড়ি ফিরে এসে ওর খোঁজ নিতেই আমার  আশঙ্কাটা  ঠিক হলো। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। প্রকৃতির  নিয়মে ম্যাজেস্টিক ভোম্বল   আমাদের  সবাইকে ছেড়ে  ফিরে গেছে তাঁর কাছে।

Tuesday, 19 July 2022

সব্যসাচী

সব্যসাচী মানে যার দুহাত একসঙ্গে চলে। মহাভারতে অর্জুনের  সম্বন্ধে জানতে পারি যে তিনি দুইহাতেই তীর চালাতে পারতেন এবং সেই কারণেই  তাঁর অপর এক নাম সব্যসাচী। ছোটবেলায় ঠিক বুঝে উঠতে পারতাম না যে দুটো হাতেই একসঙ্গে কি করে তীর চালানো সম্ভব। স্যারদের  জিজ্ঞেস  করলে শুনতাম  বোস।পাশে বসা বন্ধুরা জামা টেনে বসিয়ে দিত। কিছুতেই প্রশ্নের  উত্তর  পেতাম  না। নিজের  মনে মনেই বলতাম  যে একহাত দিয়ে ধনুকটা ধরে অন্য হাতে তীরটা  ধনুকের  ছিলায় লাগিয়ে টেনে ধরার  পর ছাড়তে হবে। তা সেখানে অর্জুনের  হাতের টিপ বা নিশানা অন্যদের  তুলনায় অনেক নিখুঁত।  ছোটবেলায়  বাঁহাতে ধনুকটা ধরে ডানহাতে পাটকাঠি ভেঙ্গে  বানানো তীর  ধনুকের ছিলায় লাগিয়ে টেনে ধরে ছেড়ে দিয়ে আম পাড়ার  চেষ্টা করেছি কিন্তু আম পড়া তো দূর অস্ত , পাতাও এক আধটা পড়েনি বরঞ্চ আমার তীরটাই গাছে আটকে গেছে এবং দাদাকে বলে লম্বা লাঠি দিয়ে গাছ থেকে তীর নামাতে হয়েছে। এহেন  আমারও  অর্জুনের  মতো সব্যসাচী হবার  বাসনায়  উল্টো হাতে মানে ডান হাতে ধনুক  ধরে বাঁহাত দিয়ে তীর চালাবো বলে প্রস্তুতি নিচ্ছি, হঠাৎই  বড়দির  গলার  আওয়াজ, "অ্যাই ছোটু, হোম টাস্ক করিস নি কেন? আয় এদিকে বলছি " শুনে হকচকিয়ে গেলাম  আর তীর গিয়ে লাগল কলতলায় থাকা  আমাদের  বাড়ির কাজের  লোক সুরধ্বনি মাসির গায়ে। ওরে বাবা রে, মা রে এই দত্যিটার জ্বালায় এবার  মলুম।  যাই হোক, যতটা না লেগেছে  তার চেয়ে বেশী ঢং করে কাজটা সেদিনের  মতো যাতে না করতে হয়  তার জন্য  বিত্তেমি  করতে লাগল। সুরধ্বনি মাসির মোটা হাতে অনেকটা মলম লাগিয়ে দিয়ে কম কাজ করতে বলে মা রান্নাঘরে রাখা উনুনে  হাওয়া দেওয়ার  ডাঁটিওলা  পাখাটার  উল্টোদিক  ধরে পটাপট দুচার ঘা লাগিয়ে দিল আর বলল যা, হোমটাস্ক  না করে খালি খেলে খেলে বেড়ানো, যা পড়তে বোস গিয়ে। মাসির ওপর সমস্ত  রাগ গিয়ে  পড়ল আর বড়দির  ওপরেও।  হঠাৎই  ঐ সময় না ডাকলে হয়তো সেদিন  বাঁহাতেও  তীর চালাতে পারতাম  আর নিজেকে খুদে সব্যসাচী বলে ভাবতে পারতাম। 
এরপর অনেকদিন  কেটে গেছে। দাদার সঙ্গে  বিবেকানন্দ ব্যায়াম সমিতি ক্লাবে গিয়েছি। ওখানে একটা সুন্দর  বক্সিং রিং ছিল। শহরে দুটো রিং ছিল,  একটা এখানে আরও  একটা ছিল গোরাবাজারের শক্তিমন্দিরে।  কিন্তু এখানে ছিল  বিরাট  জায়গা এবং শহরের  মাঝখানে। সেইকারণে এখানে ভিড় হতো অনেক বেশী। হাঁ করে দেখছি দুজন হাতে গ্লাভস পরে বক্সিং লড়ছে আর রেফারি হিসেবে রয়েছেন  দুলুদা। পরে শুনেছিলাম  দুলুদা বেঙ্গল  চ্যাম্পিয়ন  বক্সার  ছিলেন।  আরও  অনেককেই দেখেছি বক্সিং লড়তে যাদের  মধ্যে চঞ্চল দা, রবি দা, শক্তি দা , দোদা  দা, মোহন দা, বীরেন দা, দিলীপ দা,অভয় দারা ছিলেন  এবং প্রত্যেকেই  খুব ভাল  বক্সার  ছিলেন। বীরেন দা, দিলীপ দা খুবই  ভাল ছাত্র  ছিলেন  এবং দুজনেই  ফিজিক্সের  অধ্যাপক  ছিলেন।  বীরেন দা রানাঘাট  কলেজের  হেড অফ দি ডিপার্টমেন্ট ছিলেন  এবং দিলীপ দা বহরমপুর  গার্লস কলেজে  পড়াতেন।  ঐ ক্লাবের  প্রতিষ্ঠাতা  প্রণব দা( পিনু দা) পরে পণ্ডিচেরি চলে যান এবং অরবিন্দ  আশ্রমে শরীর চর্চার অধ্যক্ষ  ছিলেন। পরে তিনি তাঁর জমানো টাকার  একটা বিরাট  অংশ  এই ক্লাবকে দান  করেন। বক্সিং রিংয়ের  দিকে হাঁ করে চেয়ে দেখতাম যে দুজনেই  কেমন ডান হাত, বাঁহাত  একসঙ্গে  চালিয়ে লড়ছে। তখন  ভাবতাম  এরাও  তো তাহলে সব্যসাচী।

বক্সিং এর প্রতি আমার  একটা আলাদাই  আকর্ষণ ছিল। নিজেও লড়তাম এবং শেখাতাম ও বাচ্চাদের। দীর্ঘদিন  বক্সিং কম্পিটিশন  বন্ধ ছিল। ক্লাবের  প্রধান  কর্ণধার  দুলুদা বললেন  যে এবার  কিন্তু বক্সিং কম্পিটিশনটা চালু করতেই হবে। সবচেয়ে উপভোগ্য হবে মলয় এবং দিলীপের লড়াই এবং তারপরেই হবে জয়দেব এবং শ্যামলের  লড়াই। সব মনে মনে ছকে নেওয়া  হচ্ছে কে কার সঙ্গে লড়বে এবং কাকে কি দায়িত্ব  দেওয়া হবে। কিন্তু মানুষ  ভাবে এক, ভগবান করেন  আর এক এবং তাঁর  কথাই  শেষ  কথা। পরের দিন  শো , সব কিছুই  ঠিক ঠাক চলছে, হঠাৎ বাড়ি থেকে খবর এল আগামীকাল  শিলিগুড়িতে জরুরী কাজে যেতেই হবে এবং এগারোটার মধ্যেই  পৌঁছাতে হবে।সুতরাং ঐদিন  রাতেই  কামরূপ এক্সপ্রেস  রাধারঘাট থেকে ধরতেই হবে। রাতে কামরার  দরজা কেউ খুলতেই  চায়না, ভাবে বোধহয় ডাকাত উঠছে। যাই হোক,  অনেক  অনুনয় বিনয় করার পর কেউ একজন খুলে দিলেন। গিজগিজ করছে ভিড়, তিলধারনের স্থান নেই। কাঁধে একটা ছোট ব্যাগ, কোনরকমে একটা  বই বের করে ইন্টারভিউ এর জন্য  প্রস্তুতি নিচ্ছি। পা টনটন করছে, যখন  একদম পারছি না তখন যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি, ঐ জায়গাতেই সোজা হয়ে বসছি আবার  উঠে পড়ছি। এক ভদ্রলোক  তখন  একটু দয়াপরবশ হয়ে অন্যদের চেপে আমাকে একটু  বসার  জায়গা  করে দিলেন। ঐ ভাবেই  সকালে নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছে বাসে শিলিগুড়ি পৌঁছলাম  এবং একজন পরিচিতের বাড়ি গিয়ে স্নান করে বেরিয়ে পড়লাম  গন্তব্যস্থলে। সব কিছু  সেরে ফিরতে ফিরতে বিকেল  গড়িয়ে গেল এবং শিলিগুড়ির  আশ্রম রোডে  সেই পরিচিতের বাড়ি খাওয়া দাওয়ার পর আবার ফেরার পালা। কিন্তু আমার ভাগ্য ই খারাপ  ছিল,  ট্রেন লেট করায় বক্সিং কম্পিটিশনের  দ্বিতীয় এবং শেষ দিনেও এসে পৌঁছতে পারলাম না আর, আরও  একবার  সব্যসাচী হওয়া হয়ে উঠলনা।  দ্বিতীয় দিনে ঠিক  সময়ে না পৌঁছানোর জন্য  আমার  সঙ্গে যার লড়ার  কথা ছিল  তাকে ওয়াক ওভার দেওয়া হলো আর শুনে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। 
এরপর কর্মসূত্রে বিভিন্ন  জায়গায়  ঘোরা শুরু হলো। কোন জায়গায় বেশীদিন  থাকতে ইচ্ছে করেনা। বিভিন্ন জায়গায় যাব, সেখানকার  লোকদের  সঙ্গে মিশব  এবং তাদের  সংস্কৃতির  সঙ্গে  পরিচিত হয়ে নিজেকে একটু বেশীরকম অভিজ্ঞ করব এটাই ছিল  মনোগত  বাসনা। তিনবছরের  মেয়াদ  ফুরোবার আগেই নতুন  কোন জায়গায় যাবার  বাসনা মনের মধ্যে চাগিয়ে উঠত।  পোস্টিং হলো বিশাখাপটনম শহরের  দ্বারকানগর শাখায়। ওখানে একজন  বিচিত্র  ধরণের ভদ্রলোকের  সঙ্গে কাজ করবার  সুযোগ  ঘটল। ভদ্রলোকের নাম পাস্তুলা সূর্যনারায়ণ ঐ ব্রাঞ্চের  অ্যাকাউন্টান্ট।  মাঝারি লম্বা, ছিপছিপে চেহারার ভদ্রলোকের  মাথাভর্তি চুল এবং ব্যাকব্রাশ করা। সদাহাস্যময়  ভদ্রলোক কখনও  কাউকে না করতেন  না, যতক্ষণ  সম্ভব  হতো সকলকে  খুশী রাখার চেষ্টা করতেন  । তাঁর পাশে বসে কাজ করতে করতে হঠাৎই  আমার  চোখ পড়ে গেল  তাঁর  দিকে। বিশ্বাস করতেই পারছিনা নিজের  চোখকে।  বারবার  চোখ কচলাচ্ছি আর ভাবছি ঠিক দেখছি তো। উনি বাঁহাতে নিজের  স্ক্রোল যোগ  করছেন  এবং ডান হাতে একটা  চিঠি লিখছেন। আমি নিজের  চোখে না দেখলে, অন্য  কারও কাছে শুনলে কিছুতেই  বিশ্বাস  করতাম  না। আমি অন্য  স্টাফদের  যখন  বলছি তখন  কেউই আশ্চর্য হলনা। মানে  সবাই জানে তাঁর  এই বিশেষ  গুণের  কথা। এই পিংলে চেহারার  ভদ্রলোকের ও এক ভীষণ  নেশা বক্সিং। তখন  এম ভি পি কলোনিতে থাকি। একটা রবিবার  দুপুর  বেলায় ওয়ার্ল্ড  হেভিওয়েট বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপের লড়াই হবে, সবেমাত্র  খাওয়াদাওয়া সেরে টিভি খুলে বসেছি, হঠাৎ গেট খোলার  আওয়াজে বাইরে এসে দেখি সূর্যনারায়ণকে। আসুন আসুন বলে ভিতরে নিয়ে গিয়ে বসালাম।  উনি বললেন  টিভি চালু করতে কারণ  উনি বক্সিং লড়াই দেখতে এসেছেন ঋষিকোণ্ডায় চলতে থাকা পিকনিক  ছেড়ে।  আমার  দেখা প্রকৃত  সব্যসাচীর  এই আশ্চর্য রকম  ঝোঁক  দেখে আমি সত্যিই  বিস্ময়ে  হতবাক হয়ে গেলাম।  অনেকেই  হয়তো  দুইহাতেই  লিখতে পারেন  বা কাজ করতে পারেন  কিন্তু একই সঙ্গে দুটো ভিন্ন ধরণের কাজ করতে কাউকেই  দেখিনি। হয়তো এইরকম  প্রতিভাশালী  অনেকেই  আছেন  কিন্তু আমার  দেখা একজনই  সব্যসাচী যাঁর নাম পাস্তুলা সূর্যনারায়ণ। 

Tuesday, 5 July 2022

অর্জুনের অ্যালেন অভিযান

বহুদিন  কোন অভিযান না হওয়ায় সমস্ত পাণ্ডব এবং তাঁদের সহধর্মিনীরা ভীষণ বিষণ্ণ। এযাবত  জানা আছে যে যুদ্ধে যোদ্ধাদের  স্ত্রীরা সাধারণত সহগামী হন না, তাহলে এখানে তার ব্যতিক্রম  কেন? না না, এ সেইরকম অভিযান  নয় এটা হলো ভোজনরসিকের অভিযান,  সুতরাং স্ত্রীরা  সেখানে পিছিয়ে থাকবেন! ঐ চিন্তা ভুলেও  মাথায় এলে পরের কয়েকদিন  অন্তত মুখ শুকিয়ে থাকতে হবে এবং শুকনো পাঁউরুটি চিবিয়ে থাকতে হবে নতুবা বিস্কুট মুখে দিয়ে জল খেতে হবে। অতএব,  ভুলেও  ঐ চিন্তা মাথায় না এনে তাদের ই পরিচালনের ভার দেওয়া ভাল।

হতচ্ছাড়া করোনার  জ্বালায় সেই দুহাজার উনিশের  নভেম্বর মাসের  পর আর কোন বড় অভিযান  হয়নি। সর্বজ্যেষ্ঠ  পাণ্ডব  যুধিষ্ঠিরের  দুই হাঁটু প্রতিস্থাপনের  পরপরই এল কুঁতকুঁতে চোখের  দেশ চীন  থেকে করোনা এবং সমস্ত  পৃথিবীকে ব্যতিব্যস্ত  করে তুলল। এল বহির্বিশ্বের জীবের মুখ ঢাকার মাস্ক, স্যানিটাইজার এবং নভোচারীদের মত পোষাক যার গালভরা নাম পি পি ই কিট। সমস্ত  পৃথিবী জুড়ে এই তিন ব্যবসার  রমরমা আর তার  সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শুরু হলো কিছু অসাধু নার্সিং হোমের ফুলে ফেঁপে ওঠা ব্যবসার। চাচা, আপন প্রাণ  বাঁচা বলে লোকের  ঘটি বাটি বিক্রি করেও যদি আরও  কিছুদিন  এই মায়াবি  পৃথিবীতে থাকা যায় তার জন্য আকুল ব্যাকুলতা। চারিদিকে বহু লোক বেকার হলো কিন্তু নেতা, মন্ত্রী এবং তাদের  সান্ত্রীদের  কিছু কম হলোনা, তারা যথেষ্ট  সুযোগ সন্ধানী এবং কি করলে তাদের  পাঁচ পুরুষ  বসে খেতে পারে তার ঘাঁতঘুঁত সব নখদর্পণে। মাঝখানে একটা ছোট্ট বিরতি হয়েছিল টিভিতে সিরিয়াল  চলার  মাঝে যেমন বিজ্ঞাপনের  বিরতি হয়। আর সেই  ফাঁকেই  স্ট্র্যাটেজিস্ট  অর্জুন অভিযান  চালালেন টোকু সাহেবের  বাগান বাড়িতে এবং তাঁর অভিযান চালানো মানেই সাফল্য।  সেখানে দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীম না থাকলেও  অভিযান  অত্যন্ত  সফল। করোনার প্রকোপ যখন  একটু পড়তির মুখে তখন  আবার  সহদেবের হাঁটু প্রতিস্থাপন এবং সেখানেও অর্জুনের  উপস্থিতি মানে এক কথায় যেমন  কানু বিনা গীত হয়না তেমনই  অর্জুন বিনা পাণ্ডব অকল্পনীয়। শরীর থাকলেই যেমন  অসুস্থতা  থাকবে তেমন  অর্জুন ও কিছুদিন বিশ্রাম নিয়ে আবার  পূর্ণোদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়লেন নতুন  অভিযানে।

উত্তর কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়ি  কাছে সেন্ট্রাল  অ্যাভিনিউ ( যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত অ্যাভিনিউ) এর চল্লিশ  নম্বর বাড়ির  একতলায় স্বল্প পরিসরে এই অ্যালেন কিচেন।  একশ ত্রিশ বছর  আগে স্কটিশ  সাহেব  অ্যালেন  তাঁর নামানুসারেএই কিচেনের স্থাপন  করেন। পরে তাঁরই কর্মী  জীবন কৃষ্ণ সাহাকে তিনি এটা দিয়ে দেন। এটা এক ঐতিহ্যবাহী দোকান  এবং এখানকার  চিংড়ির  কাটলেট  ও চিকেন কাটলেটের প্রসিদ্ধি সর্বজনবিদিত। সিংহের  বয়স হলেও  সে সিংহই  থাকে এবং তার তেজের  বিন্দুমাত্র  ঘাটতি হয়না। মধ্যম পাণ্ডব  অর্জুনের  ক্ষেত্রেও  তা ব্যতিক্রম  নয় । তিনি অভিযানের  আগে সমস্ত  সুবিধা অসুবিধার  কথা চিন্তা করে গতকাল অর্থাৎ  পাঁচই জুলাই দিন স্থির  করলেন। যুধিষ্ঠির এবং তাঁর  স্ত্রী দেবিকা,  বোন দুঃশলা, অর্জুন  এবং তাঁর  স্ত্রী চিত্রাঙ্গদা, এবং সহদেব ও তাঁর  স্ত্রী বিজয়া এই অভিযানে অংশগ্রহণ করলেন। ভীম এবং তাঁর স্ত্রী জলন্ধরা দীর্ঘদিন  প্রবাসে থাকায় অভিযানে অংশ নিতে পারেন নি এবং নকুল ও তাঁর সহধর্মিনী কারেনুমতী ইউরোপ ও আমেরিকা পরিভ্রমণে ব্যাপৃত থাকায় তাঁরাও অনুপস্থিত।  কিন্তু নকুলজায়া  কারেনুমতীর ঘ্রাণ শক্তি স্নিফার ডগকেও  হার মানাবে।  তিনি ঠিক  ঐ সময়েই ভিডিও  কল করেছেন এবং তিনি সমস্ত  অভিযানেই  অর্জুনের ই মতন  উৎসাহী হওয়ার জন্য একটু মনে দুঃখ  পেলেন তাঁরা না থাকার জন্য।  তাঁদের  প্রত্যাবর্তনের  পর আরও  একবার  অভিযান  চালানো হবে এই প্রতিশ্রুতির পর তিনি একটু শান্ত হলেন। কিন্তু তাঁর  চোখেমুখে  ফুটে ওঠা যন্ত্রণার অভিব্যক্তি  কারও  নজর এড়ায়নি।

ছোট্ট  দোকান  এই অ্যালেন।  কাঠের  কড়ি বর্গায় ইতিহাস  যেন মিলে মিশে আছে।সামনের  ভাগে রিসেপশন এবং রান্নার  জায়গা এবং ভিতরের  দিকে চারটে টেবিল  সম্বলিত  ষোল জনের  বসার ব্যবস্থা। এর মধ্যে ভিতরের ঘরে ঢুকতেই  বাঁদিকের টেবিলে দুজনের  বসার জায়গা এবং ঐ টেবিলের সামনের দুটো চেয়ার স্থান  পেয়েছে  ভিতরের  দিকে পাশাপাশি রাখা টেবিল  দুটোর  মাঝখানের  pরাজবাড়ির দুটো দেয়াল আলমারি যেখানে প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র থাকে। গাঁটগোঁট  চেহারার চেয়ারগুলোও দামী কাঠের,  নজর পড়লেই বোঝা যায়। সঙ্গে মানানসই টেবিলগুলোও তাই কিন্তু মার্বেল টপ ইতিহাসের হাজার বাহক। মেনু কার্ড চারটে টেবিলে চারটে রাখা,  রকম  আইটেম  নেই কিন্তু যেটাতে ওদের  বৈশিষ্ট্য  তার নীচে কালি দিয়ে দাগ দেওয়া। অর্জুন  তো এই বিষয়ে আগেই রিসার্চ  করে ফেলেছেন  এবং অ্যালেনের বিখ্যাত  চিংড়ির কাটলেট  এবং যারা চিংড়ি খান না বিভিন্ন  কারণে, তাঁরা চিকেন কাটলেটের  অর্ডার  দিলেন। খাঁটি ঘিয়ে  ভাজা দুই কাটলেটই  অনন্য, এ বলে আমাকে দেখ  ও বলে আমাকে দেখ। অসাধারণ অনুভূতি।  সহদেবের আরও  একটু  খেতে ইচ্ছে হওয়ায় দুটো চিকেন  কবিরাজি  চারজন ভাগ করে খেলেন।  যুধিষ্ঠির,  অর্জুন এবং দুঃশলা কাটলেটেই নিবৃত্ত  থাকলেন। এবার  ওঠার  পালা, বাইরে নেমেছে ঝিরঝির করে বৃষ্টি। গাড়িতে উঠতেই  নামল ঝমঝম করে।  স্বল্প পরিসর হওয়ায় বাইরে চওড়া ফুটপাতে রাখা গোটা  আটেক প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে থাকা ছেলেমেয়েরা আমরা গাড়িতে ওঠায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচল এবং তাড়াতাড়ি অ্যালেনে ঢুকে পড়ায় বোঝা গেল  যে এই ঐতিহ্যবাহী রেস্তোরাঁ সব বয়সী লোকদের কাছেই  সমান আকর্ষণীয়। অভিযান  কিন্তু এখানেই সমাপ্ত  নয়। আক্রমণ  শানানো  হলো চিত্তরঞ্জনের রসগোল্লার দিকে। কিন্তু তারা তাদের  ঐতিহ্যমতো ঠিক সাড়ে ছটায় দোকান  বন্ধ করে দেওয়ার ফলে রক্ষা পেল কিন্তু অভিযানের  সমাপ্তি কি এখানেই  হয় যেখানে রয়েছেন  অগ্রগণ্য  অর্জুন।  অতএব পরের আক্রমণ গিরীশ দে ও নকুড় নন্দীর সন্দেশ।  সেখানে আত্মতৃপ্ত  হয়ে খাওয়া এবং সঙ্গে লুন্ঠন ( অবশ্যই  নগদ নারায়ণের সহযোগিতায়)  করে ফিরে আসা  এক দারুণ  অভিজ্ঞতা।


Wednesday, 29 June 2022

নতুন সূর্যের প্রতীক্ষায়

আর কয়েকদিন  বাদেই আঠারই জুলাই  আমাদের  দেশ ভারতবর্ষে পঞ্চদশ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হবে। এইবার আমরা এক অভূতপূর্ব  জিনিস লক্ষ্য করতে চলেছি যেটা হচ্ছে এই প্রথম এক আদিবাসী ভদ্রমহিলার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ  করা এবং কোন অঘটন না ঘটলে তাঁর এই বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের  পনেরতম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেওয়া। এইবার একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক এই উপজাতির পূর্ব  ইতিহাস  খোঁজার জন্য। ইতিহাসের  বই খুঁজলে তাদের সম্বন্ধে হয়তো কিছুটা জানা যাবে কিন্তু তাদের জীবন যাপন সম্পর্কে কিছু ভাসাভাসা খবর জানা যাবে যদি না লেখকের সম্যক জ্ঞান না থাকে।

খুবই কাছ থেকে তাদের  জীবন যাপন করতে দেখার  সুবাদে সামান্য কিছু  সংযোজন করার  চেষ্টা করছি যদিও তা কতটা ফুটিয়ে তুলবে  সেটা সম্বন্ধে যথেষ্ট  সন্দেহ আছে। তবুও সামান্য প্রয়াস। আঠারশো সাতান্ন খ্রীষ্টাব্দের ও বছর দুই আগে অর্থাৎ আঠারশো পঞ্চান্ন সালে  তিরিশের জুন সাঁওতালদের হুল বিদ্রোহ হয়েছিল  যার পুরোভাগে  ছিলেন মুর্মু ভাইবোনেরা । তাঁরা হলেন  সিধু, কানু,  চাঁদ এবং ভৈরব মুর্মু এবং তাঁদের  দুই বোন ফুলো ও ঝানো। তখনকার  সমাজের  মাথাদের ও ব্রিটিশ  শাসকের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল সিধু কানুদের  নেতৃত্বে ষাট হাজার  সাঁওতাল তাদের  তীরধনুকের  উপর ভরসা করে। কিন্তু আগ্নেয়াস্ত্রে বলীয়ান ইংরেজরা তাদের  দমন করতে সফল হয় এবং সিধু  ও কানু বীরগতি প্রাপ্ত হয়। কিন্তু বিদ্রোহের বীজ তারা বপন করে যায় এবং সিপাহী বিদ্রোহের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে যায়।
শাসকের শোষণনীতি  যদি অব্যাহত থাকে তাহলে মনের মধ্যে ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা আগুনের  বহিঃপ্রকাশ হবেই সে আজ হোক বা কাল হোক। ব্রিটিশ সরকার তাদের  চিন্তাধারা বদলাতে বাধ্য  হয় এবং এদের সামগ্রিক  উন্নয়নে মাথা ঘামাতে  শুরু করে। তাদের উন্নয়নের জন্য  তাদের  থেকেই গ্রাম প্রধান  বা মোড়লের  সৃষ্টি করেন এবং তাদের  হাতে ট্যাক্স  সংগ্রহ করার অধিকার ও দেওয়া হয়। তাদের  জন্য  বরাদ্দ  জায়গা  যাতে  অন্য কেউ অধিগ্রহণ  করতে না পারে সেটার জন্য ও আইন প্রণয়ন করে। এখনও  সেই ধরণের  আইন বলবত আছে যে ট্রাইবাল (আদিবাসী অধ্যুষিত  এলাকাতে)এরিয়াতে  ট্রাইবাল( আদিবাসী) ছাড়া অন্য  কেউ জমির  মালিক  হতে পারবে না। এই আইনের  ভাল  ও মন্দ উভয় দিক ই রয়েছে। ভাল দিক হলো এতে আদিবাসীদের মূল কাঠামো অপরিবর্তিত  থাকবে  কিন্তু খারাপ  দিক  হলো এই ব্যবস্থায় তারা  আধুনিকতম  সুযোগ সুবিধায় বঞ্চিত থাকতে পারে। কিন্তু এইখানেই  সরকারের  একটা বিশেষ  ভূমিকা রয়েছে। আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের  তত্ত্বাবধানে যদি সামগ্রিক উন্নয়নের  ব্যবস্থা করা যায় তাহলে তাদের মূলকাঠামো অপরিবর্তিত  রেখে তাদের আরও  আধুনিক পরিষেবা দেওয়া যায়।
বিশাখাপটনম স্টিল প্ল্যান্টের ব্রাঞ্চে পোস্টিং থাকার সুবাদে এদের জন্য  কিছু কাজ করার  সুযোগ  এসেছিল।  স্টিল প্ল্যান্টের  জেনারেল  ম্যানেজার একদিন বললেন  যে তাঁদের  বহু কর্মী ও অফিসার যাঁরা আরাকুভ্যালি ও পার্বতীপূরম এলাকার  (আদিবাসী এলাকা) অধিবাসী  এবং  তাঁদের  বাড়ি তৈরির জন্য  ব্যাঙ্ক থেকে কোন রকম ঋণ দেওয়া যায় কিনা। ব্যবসা বৃদ্ধির  একটা বিরাট  সুযোগ হাতছাড়া করার  ইচ্ছা ছিলনা কিন্তু আদিবাসীদের  ছাড়া আর কাউকে বিক্রি করা যাবেনা শুনে একটু মনটা দমে গিয়েছিল  কিন্তু আশা একদম ছেড়ে  দিইনি। তাঁরই  অধীনস্থ  একজন সহকারী জেনারেল ম্যানেজারকে নিয়ে  রওনা দিলাম  আই টি ডি এর(ইন্টিগ্রেটেড ট্রাইবাল  ডেভেলপমেন্ট অথরিটির) উদ্দেশ্যে। তিনি একজন  জয়েন্ট কালেক্টর,  সুতরাং যথেষ্টই  ক্ষমতাবান।  তিনি আশ্বাস  দিলেন যে সরকার  একটা গ্যারান্টির ব্যবস্থা করবে এবং তাঁরাই ঋণ অপরিশোধিত  থাকলে অন্য কোন আদিবাসীদের  বিক্রির  ব্যবস্থা করবেন এবং একান্তই  অবিক্রিত থাকলে তাঁরাই ব্যাঙ্কের  ঋণ পরিশোধের  ব্যবস্থা করবেন।  সমস্ত কথাবার্তা হবার  পর হেড অফিসে প্রপোজাল  পাঠানো হলো কিন্তু ইতিমধ্যেই  বদলির নির্দেশ আসায় আর কিছু করা সম্ভব  হয়ে ওঠেনি এবং তার  ভবিষ্যত  যে কি হয়েছে তাও জানিনা। সকলের  ঐকান্তিক  উদ্যোগ না থাকলে কোন কিছু করাই অসম্ভব হয়ে ওঠে। যে কোন নতুন  উদ্যোগ  নেওয়ার  আগে সবাইকে সেই বিষয়ে অবহিত করা বিশেষ  প্রয়োজন।  অনেকের ই কোন  স্বচ্ছ ধারণা না থাকায় সে বাধার সৃষ্টি করে এবং অহমিকা বশত প্রকল্প  যাতে  বাস্তবায়িত  না হতে পারে তার জন্যও সর্বতোভাবে  চেষ্টা করতে থাকে। 

বছর পঞ্চান্ন ষাট আগের কিছু ব্যক্তিগত  অভিজ্ঞতার  কথা বলা যাক। আমরা তখন  স্কুলে পড়ি। বিবেকানন্দ ব্যায়াম সমিতিকে ডান হাতে রেখে টেক্সটাইল  কলেজের  দিকে যেতে কৃষ্ণনাথ কলেজের  মেন হোস্টেলের  উল্টোদিকে বড় বড় জারুল গাছের  নীচে কয়েক ঘর সাঁওতালদের বাস ছিল। গাছের ডাল থেকে ঝোলানো ঝুড়িতে তাদের  কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র থাকতো। মাঝে মাঝেই  দেখতাম  সেখানে তাদের  বাচ্চাকে শুইয়ে  দিয়ে তারা কাজকর্ম  করতো। গাছের  তলে পরিষ্কার  করে সুন্দর ভাবে নিকানো  থাকতো ঐ জায়গাগুলো। একটু বড় বাচ্চাগুলো ঐখানেই  খেলা করতো আর খুব ছোট শিশুরা ঝোলানো ঝুড়িতে শুয়ে থাকতো। কোন বাড়িতে কিছু পরিষ্কার  করার কাজ থাকলে তাদের ডাকা হতো এবং নামমাত্র  মজুরিতে  তারা কাজ করতো। ছেলেদের  মজুরি ছিল দেড় টাকা এবং মেয়েদের ছিল  একটাকা বা পাঁচ সিকে। বহরমপুর শহরে তখন  গাছগাছড়ার  অভাব ছিল না আর তার সঙ্গে  ছিল  নানাধরণের পাখি। ওরা তীর ধনুক নিয়ে  পাখি শিকার  করতো আর দিনের  শেষে শুকনো কাঠকুটো জ্বালিয়ে তারা রান্নাবান্না করতো। তারা কত কষ্ট করে থাকে  সেইসময় কোন ধারণাই ছিলনা। কিন্তু এত কষ্টের মধ্যেও  তাদের  কালো কোঁদা চেহারার  মধ্যে যে চমক ছিল  তা ভাবলেই  কেমন আশ্চর্য  লাগে। এত অযত্নের মধ্যেও  কালো নিখুঁত  শরীরে এত জ্যোতি কোথা থেকে আসে সেটা নিশ্চয়ই  গবেষণার বিষয়। এখন ছেলেমেয়েদের  মধ্যে নানাধরণের  ক্রীম ব্যবহার  বেড়েছে বটে কিন্তু চামড়ার  সেই উজ্জ্বলতা কোথায়?  স্কুলে পড়ার সময় থেকেই কিছু সামাজিক  দায়িত্ব পালন করতে শিখেছি। আমাদের  পাড়ার ক্লাবের  নাম ছিল  কিশোর  সংঘ এবং  আমাদের  একটা লাইব্রেরি ছিল। অসীম,  প্রদ্যুত,  দেবী , বাসুকি,অরূপ, চিত্ত, নান্টি ( ভাদুড়ি নামেই বেশি পরিচিত  ছিল), বুলান দাকে নিয়ে ছিল  আমাদের  ক্লাব। পাড়ার  সমস্ত  বাড়ি থেকে বাড়তি বইগুলো নিয়ে লাইব্রেরির  যাত্রা শুরু। মুসলমান পাড়ায় চিত্তদের একটা বাড়ি খালি পড়েছিল  এবং চিত্তর বাবার   সম্মতিতে ঐ বাড়িতেই  শুরু হলো লাইব্রেরি। তারপর প্রদ্যুত এবং ভাদুড়ির অক্লান্ত  পরিশ্রমে পাড়ার সব বাড়ি থেকে চাঁদা তুলে লাইব্রেরির  কলেবর বৃদ্ধি  করা হতে লাগল এবং লাইব্রেরির জন্য  কোন পয়সা নেওয়া হতোনা। এরপর  ঠিক  হলো যে বিনাপয়সায় লোকের  চিকিৎসার  ব্যবস্থা করতে হবে। একজন  খুব ভাল বৃদ্ধ হোমিওপ্যাথ ডাক্তার বাবুর  খোঁজ  পাওয়া গেল। তিনিও  আমাদের  উদ্যোগকে সমর্থন  জানালেন। সকলের  সমর্থনে বিনা পয়সায় রোগীদের  হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার  ব্যবস্থা হলো। এরপর আমরা ডাক্তার  রজত ঘোষের  বাড়ির  পাশে কাশিমবাজারের মহারাজের  একটা ছোট্ট  দেড়কাঠা জমি শ্রী সৌমেন নন্দী মহাশয়ের  কাছে দান হিসেবে চাইলাম  এবং তিনিও  সানন্দে সম্মতি দিয়ে ক্লাবকে দান করলেন।  এরপর শুরু হলো ক্লাবের  নিজস্ব  বাড়ি তৈরির উদ্যোগ।  কারো কাছে ইট, কারও কাছে বালি, কারও কাছ  থেকে সিমেন্ট  বা লোহার  রড নিয়ে শুরু করা হলো বাড়ি তৈরির কাজ। নিজেরাও হাত লাগিয়েছি এবং এই সাঁওতালদের থেকেই  জন মজুরের  কাজ করিয়েছি কিন্তু একজন অভিজ্ঞ  রাজমিস্ত্রির সহায়তা নিয়েছি নামমাত্র  পারিশ্রমিকে।  উগ্রবাদীদের টাকার  জুলুম  সমবেতভাবে প্রতিরোধ  করেছি এবং কারও  পক্ষে একটা টাকা নেওয়াও  সম্ভব  হয়নি। এরপর পাশ করে বেড়িয়ে যাওয়ার  পর ঐ ক্লাবের  বাড়ি বিক্রি করে অন্য জায়গায় বড় জায়গা কেনা হয়েছে কিন্তু সময়ের সঙ্গে চিন্তাধারার  আমূল পরিবর্তন  হওয়ায় এইরকম  সমাজ সেবামূলক  কাজ বন্ধ  হয়ে গেছে এবং কেবল পাড়ার  পূজো হওয়া ছাড়া আর কোন  কাজ  হয় বলে জানা নেই।কর্মসূত্রে অনেক  আদিবাসী সহকর্মীদের  পেয়েছি এবং তারাও  যথেষ্ট  দক্ষতার  সঙ্গে তাদের কর্তব্য  পালন  করেছে এবং আজও  করছে। তাদের অনেকেই  রিটায়ার  করে গেছে এবং তাদের  ছেলে মেয়েরাও  যথেষ্ট  উচ্চশিক্ষা লাভ করে অনেকেই উঁচুপদে অধিষ্ঠিত। 

একটা কথা ভেবে খুব ভাল  লাগে যে একসময় যারা ছিল  অবহেলিত আজ তারা নিজেদের  চেষ্টায় এবং সরকারি সহযোগিতায় আজ তারা সামনের  সারিতে আসতে পেরেছে। শ্রী গিরীশ চন্দ্র মুর্মু আজ ভারতবর্ষের  কম্পট্রোলার এন্ড অডিটর জেনারেল।  তার আগে তিনি জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্য প্রশাসক হিসেবে  দায়িত্ব পালন করেছেন।  এইরকম নানাধরণের বিভিন্ন  কাজে তাঁরা দায়িত্ব পালন করছেন  এবং ভারতবর্ষ  তার অভীষ্ট লক্ষ্যে নিশ্চয়ই পৌঁছতে পারবে। আগামী একুশে জুলাই আমরা জানতে পারব যে আমাদের  দেশের  প্রথম নাগরিকের  আসন এই আদিবাসী রমণী অলঙ্কৃত  করেন  কিনা এবং আমরা জাতপাত ধর্মের  উপর উঠতে পারব কিনা।


Friday, 24 June 2022

ভবঘুরে ও বাউণ্ডুলে

ভবঘুরে এবং বাউণ্ডুলে প্রায় সমার্থক হলেও পার্থক্য এদের  মধ্যে যোজনবিস্তৃত। ভবঘুরেরা সাধারণত  চালচুলোহীন, আজ এখানে তো কাল সেখানে,কেউ কিছু খেতে দিলে খায় নাহলে সারাদিন  অনাহারে কাটে। কখনো সখনো কোন অনুষ্ঠান বাড়িতে কিছু খাবার  উদ্বৃত্ত  হলে তারা এদের ডেকে কিছু দিয়ে দেয় আর  খাবার না বাঁচলে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া পাতায় পড়ে থাকা উচ্ছিষ্ট রাস্তার কুকুরগুলোর সঙ্গে মারামারি করে ছিনিয়ে নিয়ে খায়। এদের  জীবনধারণের প্রধান উপায় ভিক্ষা এবং মাঝে মধ্যেই  কোন সংস্থার উদ্যোগে গরীবদের খাওয়ার বন্দোবস্ত  হলে দুটো পেট ভরে খেতে পাওয়া। অনেকেই এই কথা বলেন  যে ভিক্ষা দেওয়া ঠিক  নয় এবং এতে মানুষকে আরও অলস করে তোলে। ঠিক আছে , মানলাম কথাটা। কিন্তু এদের  কর্মমুখী করবে কে? কে এদের  কাজের  ব্যবস্থা করবে, কি করে এদের  পেট চলবে একটু দয়া করে বলে দেবেন? প্রত্যেক  সরকারেই  একটা সমাজকল্যাণ দফতর থাকে এবং একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত  মন্ত্রীও  থাকেন কিন্তু বুকে  হাত দিয়ে কজন বলতে পারবেন  যে এই দফতরের  সমস্ত লোকই হৃদয়বান? কিছু কাজ তো নিশ্চয়ই  এদের করতে হয় লোক দেখানোর  জন্য  কিন্তু ঐ খাতে বরাদ্দ  টাকা কতটা তাদের  উদ্দেশ্যে ব্যবহার  হয় তাতে যথেষ্ট  সন্দেহ  আছে। এর বেশীরভাগ টাকাটাই নেতা, মন্ত্রী ও সরকারি আমলাদের রমরমাতেই চলে যায়, নামমাত্র  এদের  উন্নয়নের জন্য  ব্যবহার হয়। কথাটা সত্যিই  এবং তার থেকেও  বেশী তেতো। এটা সমস্ত দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য,  কোথাও  একটু ভাল তো কোথাও  চোখে পড়ার মতো নয়। মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্টের মতো শহরে কিছু কাজের  ব্যবস্থা কি করা যায় না? সবই সম্ভব  যদি থাকে সদিচ্ছা। শহরের  এই বিরাট  কর্মহীন গরীবদের  জন্য কিছু কর্মসংস্থান কিভাবে করা যায় তারজন্য সমাজবিজ্ঞানীদের  সাহায্য নেওয়া হোক। এরজন্য  থিওরিসর্বস্ব জ্ঞানীগুণীর প্রয়োজন  নেই, দরকার  বাস্তব সম্মত প্রকল্প এবং এই বিশাল কর্মযজ্ঞে তাদের  সামিল করা। এইপ্রসঙ্গে একজনের  কথা ভীষণ ভাবে মনে পড়ছে এবং তিনি হচ্ছেন  আজকের  আমূলের( আনন্দ মিল্ক ইউনিয়ন লিমিটেড) স্রষ্টা শ্রী ভার্গিস ক্যুরিয়েনের। উনিশশো ছিচল্লিশ সালে ভারতবর্ষের  সহকারী প্রধানমন্ত্রী সর্দার  বল্লভভাই প্যাটেলের অনুপ্রেরণায়  শ্রী ত্রিভুবনদাস প্যাটেলের উদ্যোগে গড়ে ওঠে গুজরাট মিল্ক মার্কেটিং ফেডারেশন।  তিনিই  আনেন  শ্রী ক্যুরিয়েনকে জেনারেল ম্যানেজার  হিসেবে এবং যদিও  তিনি জীবনের  শেষ দিন পর্যন্ত  চেয়ারম্যান ছিলেন কিন্তু এর সমস্ত  পরিচালন ভার শ্রী ক্যুরিয়েনের উপর ন্যস্ত করেন। তাঁর মৃত্যুর  পর সর্বময় কর্তা হন শ্রী ক্যুরিয়েন এবং তাঁর  স্বপ্ন সাকার করতে সমস্ত সদস্যদের উজ্জীবিত করেন  এবং তার ফলস্বরূপ  আজকের  বিশ্বের  বৃহত্তম  দুধ প্রস্তুতকারী এবং অষ্টম  বৃহত্তম দুধ ও ডেয়ারিজাত সামগ্রীর  সংস্থা। এইরকম  বিশাল  কর্মযজ্ঞে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে দরকার  অনেক ভার্গিস ক্যুরিয়েনের কিন্তু সমস্ত ক্ষেত্রেই অদূরদর্শী রাজনৈতিক নেতাদের  হস্তক্ষেপ এই কর্মযজ্ঞের অন্তরায়।

অন্যদিকে বাউণ্ডুলে হচ্ছে তারা যারা ঘরের  খেয়ে বনের  মোষ তাড়িয়ে বেড়ায়। তাদের ঘরে খাবারের  চিন্তা না থাকায় তাদের  মুখে মারিতং জগত। অবশ্য  কোন কোন সময় এরাও সমাজের  অনেক উপকারে আসে। যেমন অনেক  সংস্থা মাঝেমধ্যেই  এই ভবঘুরেদের খাওয়ানোর  বন্দোবস্ত করে বা জামাকাপড় দেয়, তখন  এই সংস্থার  সাফল্যের  পিছনে অনেক  বাউণ্ডুলেরই অবদান  থাকে। এরা সবসময় যে রাজনৈতিক  ছত্রছায়ায় থাকে তা নয়, অনেক ক্ষেত্রেই  তারা অন্যের বিপদে এগিয়ে আসে। সুতরাং কেউই ফেলনার  নয়। শুধু দরকার কাকে দিয়ে কি কাজ করানো যায় সেইসম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারণা।

সরকারী উদ্যোগেই সমস্ত  কাজ হয়ে যাবে এটা আশা  করা ভুল। বেসরকারী সংস্থার ও হাত বাড়ানো দরকার।  রামকৃষ্ণ মিশন,  ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ এবং আরও  অনেক  স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এই ভাল কাজে এগিয়ে আসে কিন্তু জনসাধারণের মধ্যে এই সার্বিক ভাবে সাহায্য  করার মনোভাব যতদিন  না জাগবে  ততদিন সুন্দর সমাজ গড়ার স্বপ্ন কোনদিন ই  বাস্তবায়িত হবেনা।

Friday, 17 June 2022

পরীক্ষা ---- সেকাল ও একাল

বার্ষিক পরীক্ষা তখন  শীতকালে হতো, রেজাল্ট  বার হতো তেইশে ডিসেম্বর। তারপর কদিন ছুটির আমেজ। বড়দিনে চার্চের সেজে ওঠার ধূম, তারপর দেখতে দেখতে পুরোনো বছরের বিদায় এবং নতুন বছরে আবার  সাজো সাজো রব। তখন  এখনকার  মতন সারা বছর ক্রিকেট  খেলা হতো না, কেবলই শীতের সময় মরশুমী ফুলের মতো ক্রিকেট  উঠত ফুটে মাঠে ময়দানে, অলিতে গলিতে। থান ইটের উইকেট বানিয়ে রাস্তায় ( যেসব রাস্তায় বেশি গাড়ি ঘোড়া চলত না) জমে উঠত ক্রিকেট।  মাঝে মাঝেই  পাড়ার  বড়রা শিং ভেঙে বাছুরের দলে ঢুকে পড়তেন এবং তাতে আরও  জমে উঠত খেলাটা। জলখাবার খেয়ে স্নান করে ভাত খাওয়ার  আগে পর্যন্ত  একপ্রস্থ খেলা, খাওয়া দাওয়ার পর বিকেল  গড়িয়ে সন্ধে পর্যন্ত  আরও  এক প্রস্থ খেলা। এই সময়টা হতো এই পাড়ার অমুক সঙ্ঘের  সঙ্গে ঐ পাড়ার তমুক  ক্লাবের খেলা। বিবেকানন্দ  ব্যায়াম  সমিতির  ছোটদের সঙ্গে খাগড়াঘাট বালকসঙ্ঘের  খেলা। বিবেকানন্দ ক্লাবের ছোটদের  ইনচার্জ ভুটানদা হতেন আম্পায়ার সে যে কোন  ক্লাবের  ছোটদের  সঙ্গেই  খেলা হোক না কেন। আর ভুটান দা আম্পায়ার  থাকা মানেই বিবেকানন্দ ক্লাবের জয় অনিবার্য।  কোনভাবে একবার  পায়ে বল লাগলে আর রক্ষা নেই, ভুটানদার আঙ্গুল  উঠে গেছে আউট সঙ্কেত  দিয়ে। কিন্তু নিজের ক্লাবের  ক্ষেত্রে সেটা নৈব নৈব চ। সেইকারণে কোন ম্যাচ  ঠিক  করতে গেলে প্রতিপক্ষ  টিম জিজ্ঞেস করতো কোন মাঠে খেলা  হবে আর ভুটানদার  আম্পায়ার  হওয়া চলবে না এই কড়ারে ম্যাচ  ঠিক হতো। ভুটানদার  ক্লাবের প্রতি অসীম  ভালবাসা কিন্তু ছিল অতুলনীয়। কিন্তু পরীক্ষার  কথা বলতে গিয়ে ক্রিকেট খেলার  কথা আসছে কেন? তখন  ক্লাবের  সেরা খেলোয়াড় ছিল  মনোজ, যেমন ব্যাট করতো আর তেমনই  করতো বোলিং। ভুটানদার  প্রধান  অস্ত্র  ছিল সে। এই মনোজ খেলাধূলোয় যেমন ওস্তাদ  ছিল,  পড়াশোনায় তেমনই  মা গঙ্গা। মনোজের  কিন্তু দুর্ভাগ্য,  ও দ্বিতীয়বারেও  এই ক্লাসের গেরো পেরোতে  পারেনি। অবশ্য  এটা কিছু নতুন  নয়। প্রত্যেক  ক্লাসেই  মনোজের  ভীষণ মায়া পড়ে যায়। ঐ বেঞ্চ, ঐ জানলার ধার মনোজকে ভীষণ ভালবেসে  ফেলে। এইবার  মনোজের  বাবা খুবই  রেগে  গেছেন আর বলেছেন  ক্লাবের কোন কথাই  যেন  তাঁর কানে না আসে। খুবই  স্বাভাবিক ব্যাপার  এটা, প্রত্যেক ক্লাসেই  যদি এমন মমত্ববোধ জেগে ওঠে তাহলে তো মুশকিল। ভুটানদার  ক্লাবের প্রতি প্রেম যতই  থাকুক  না কেন পড়াশোনার  দিকটাতেও  তাঁর নজর ছিল  খুবই  বেশি। 
তখন  টুকে পাশ করাটাও একটা শিল্পের  পর্যায়ে ছিল। মনোজের  মতন  কিছু  ছেলে ছিল যারা না টুকলে কিছুতেই  পাশ করতে পারত না। সুজন দা, পেলু দারা যতটা সময় চোতা তৈরী করতে ব্যয় করতো, তার অর্ধেক সময় পড়াশোনার জন্য  দিলে আরামসে  পাশ করে যেত। সাধন বাবু নতুন  এসেছেন স্কুলে, ভীষণ  কড়া ধাতের মানুষ।  পরীক্ষার  সময় কাউকে ঘাড় ঘোরাতেও  দেননা। সুজন দা, পেলু দারা ছিলেন  জাত টুকলি মাস্টার।  স্কুলের  সমস্ত  মাস্টার মশাইরা জানতেন  যে এরা সারা বছর যেমন টো টো করে ঘুরে বেড়ায় তাতে না টুকলে এরা কিছুতেই  পাশ করতে পারবে না। সত্যি সত্যিই  তাঁদের  সকলের  চোখ এড়িয়ে গিয়ে সুজন দারা টুকলি করতো কিনা একটু সন্দেহ  আছে। মাস্টার মশাইরা হয়তো জানলেও  কিছু বলতেন  না বা তাঁদের  চোখ এড়িয়েই  এদের শিল্পকর্ম  চলতো। কিন্তু মনোজ না ছিল  সুজন দাদের মত শিল্পী না ছিল পড়াশোনায় দড়। সুতরাং যা হবার,  তাই হয়েছে। কিন্তু এহেন শিল্পীরাও সাধনবাবু আসার  পরে হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষায় একেবারেই  গোল্লা কারণ সাধন বাবুর কাছে ট্যাঁ ফোঁ করার  কোন যো ছিলনা আর তার উপর তিনি ছিলেন  ট্যারা। ট্যারারা নানান ধরণের হয়। ওঁর চোখের মণিদুটোই  বহির্মুখি হবার কারণে এরা ঠাউরাতে পারেনি যে উনি কোন  দিকে তাকাচ্ছেন। কিন্তু এরা হচ্ছে জাত ধুরন্ধর।  ওঁর জাল কেটে বেরোনো এদের  কাছে প্রায় নস্যি। একবার  হেরে গেছে বলে বারবার  হার,  এ কিছুতেই  হতে পারেনা। সুজন একবার বাঁদিকে প্রশ্নপত্র  ধরে যেন  বুঝতে পারছেনা এইভাবে সাধন বাবুকে জিজ্ঞেস করল আর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর  চোখের  মণির অবস্থান  লক্ষ্য  করল। আরও একটা অন্য প্রশ্নে কি বলতে চাইছে  এটা  জানতে চেয়ে সে ডানদিকে প্রশ্নপত্রটা  ধরল আর খুবই  সূক্ষ্মভাবে তাঁর চোখের  মণির অবস্থান  লক্ষ্য করল। তার পরের ঘটনা খুবই সরল। শিল্পীদ্বয়  ধাঁধার সমাধান  ততক্ষণে করে ফেলেছে এবং হাফ ইয়ার্লির  হারের বদলা সুদে আসলে মিটিয়ে নিয়েছে বার্ষিক পরীক্ষায়। রতন বাবু খুব  কম কথা বলতেন  কিন্তু যখন  বলতেন তখন  সবাই তাঁর কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতন শুনতেন। ফাইনাল  রেজাল্ট  বেরোনোর  আগের দিন  টিচার্স মিটিং হতো যেখানে হেড মাস্টার  মশাই সমস্ত  মাস্টার মশাইদের সঙ্গে আলোচনা করতেন  পাশ ফেলের ব্যাপারে এবং সেখানে ক্লাস টিচারের ভূমিকা ছিল খুবই  গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো  কোন ছেলে কোনও কারণে রেজাল্ট খারাপ করে ফেলেছে তাকে পাশ  করানো হবে কি হবেনা সেখানে হেড মাস্টার মশাই অন্যান্য মাস্টার মশাই  বিশেষ করে ক্লাসটিচারকে জিজ্ঞেস করতেন। সেই  মিটিংয়ে রতনবাবু বলে উঠলেন, "তাহলে এই বাঁদরগুলো সাধনবাবুকেও হার মানালো।" আর বিশেষভাবে কিছু বললেন না কিন্তু  সবাই বুঝলেন  যে তাঁর মন্তব্যের  লক্ষ্য  সুজন ও পেলু। 
কলকাতার  পকেটমাররাও  এক একজন বড় শিল্পী ছিলেন।  বাসে ট্রামে  বা পথচলতি  জনতার পকেট মুহুর্তের মধ্যে ফাঁকা করে দিতে এদের  জুড়ি ছিল না। কিন্তু তাদের  সেই মগজের ব্যবহার ও একটা শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছেছিল  কিন্তু এখন তো সেটাও নেই, সেই শিল্পকর্ম আজ লুপ্ত হয়ে গেছে এখনকার গাজোয়ারির  কাছে। এখন  একটা ছুরি বা পিস্তল বুকে ঠেকিয়ে সমস্ত  জিনিস  কেড়েকুড়ে নিচ্ছে। শিল্প এখন পিছনের  সিটে। এখন  ছাত্ররা টোকা টুকির শিল্প হারিয়ে  একটা ছোরা  বা পিস্তল দেখিয়ে খোলাখুলিভাবে টুকে চলেছে  আর এর পরে ও পাশ করতে না পারলে ঝাণ্ডা ধরে বলছে পাশ করিয়ে দিতে হবে। অথচ সাংবাদিকরা যখন  তাদের  সহজ সরল ইংরেজি  বানান  জিজ্ঞেস করছে তারা এর ওর মুখের  দিকে চাইছে। কি পরীক্ষা দিচ্ছে তাও তারা জানেনা । কি হবে এদের পাশ করে বা পাশ করিয়ে দিয়ে? একটা কাগজের  শংসাপত্র কাছে থাকা ছাড়া আর বেশি কি? এদের দাদাদের ধরে কাকে মারতে হবে, কাকে ভয় দেখাতে  হবে এসব ছাড়া আর কিছুই  করতে পারবে না। এছাড়া আর কি হবে? বরং যদি হাতে কলমে  কিছু কাজ শেখে তাহলে দাদাদের না ধরেও মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারবে।
ছেলেমেয়েদের  উস্কানি  দিয়ে উত্তেজিত করা খুবই  সহজ কাজ। তারা বাসে ট্রেনে আগুন  দিয়ে দেশের  সম্পদ  নষ্ট  করবে আর এই রাজনৈতিক  দাদারা  তাঁদের  ছেলেমেয়েদের  বাইরে পাঠিয়ে উচ্চ শিক্ষিত করে এইআমজনতার মাথায় বসিয়ে দিতে পারবে। কবে যে এঁরা দলের  কথা না ভেবে দেশের  কথা ভাববেন  সেটাই  দেখার  বিষয়।

Thursday, 2 June 2022

নিরুদ্দিষ্টের প্রতি আহ্বান

উদো দাকে তো শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হলো বহু লোকের  চোখের জলের  মধ্যে। অনুত্তমের মনটা খুব  খারাপ।  শ্মশানে না গেলেও মনটা কিন্তু ওখানেই  চলে গেছে। ইতস্তত করছে সে, যাবে না অন্য কারও  সঙ্গে খানিকটা সময় কাটাবে। আচ্ছা দেখা যাক পানু দাকে পাওয়া যায় কিনা। পানু দা ছিল  অনুর দাদার  বন্ধু কিন্তু চারদিকে মন দিলে আসল যে জিনিস পড়াশোনা সেটা ভীষণ ভাবে ব্যাহত হয়। সুতরাং গড়াতে গড়াতে অনুর ক্লাসমেট  হয়ে গেছিল। তবে অনু কিন্তু পানুদাকে যথেষ্ট  সম্মান দিয়েই কথা বলতো। শুধু তার দাদার  বন্ধু বলেই নয়, পানুদা ছিল  একটা সত্যিকারের ভাল ছেলে এবং উদো দার একজন পরম চ্যালা। ব্যাগারঠ্যালা কাজ তো আর একা করা যায়না, তারজন্য  দরকার  একটা টিম  যেখানে সবাই  মোটামুটি সম মনোভাবাপন্ন এবং একজনকে তাদের  দলপতি হিসেবে স্বীকার  করে নেওয়া। টিম লিডার বা দলপতি হবার  যোগ্যতা উদো দার তো নিঃসন্দেহে ছিল  এবং তাঁর  চ্যালা চামুন্ডা  হবার  যোগ্যতা পানুদা বা অনুর ও ছিল। 

পানুদা থাকতো আমোদিনী পিসির বাড়ি ছাড়িয়ে পাকুড়তলায়।  ওর বাবার  ছিল  যথেষ্ট  পয়সা। কন্ট্র্যাকটরি,  রেশনের  ডিলারশিপ,  কয়লার  ডিপো ছাড়াও  জমিজমা থেকে রোজগারে একদম  যাকে বলে ফুলে ফেঁপে ঢাঁই। কিন্তু ভদ্রলোক  ছিলেন  খুবই  সাদামাটা, কখনও  উঁচু গলায় কথা বলতেন না , পোশাক আশাকেও ছিলেন খুবই  সাধারণ  কিন্তু ব্যবসায়ী বুদ্ধি ছিল  অত্যন্ত প্রখর। আগের  দিনে সব বাড়িতেই  পাঁচসাতটা ছেলেমেয়ে ছিল খুবই  স্বাভাবিক। আর তাঁর বাড়িতে হাম দো হামারা দোর  তো প্রশ্নই  নেই। কাঁচু দা, পানুদা, পিংলে,  মন্ডা ও যদুরা  ছিল  পাঁচ ভাই আর ছিল  মাঝে রত্নাদি যে অনুর  দিদির  সমবয়সী। পাড়াটা  ছিল  জমজমাট।  সবাই  সবাইকে চিনতো আর জমায়েত  বেশিরভাগ সময়েই  উদো দাদের  মাঠে নয়তো বেলতলায়।  পানুদার বাড়ি যেতে পড়তো ভেলু ঘোষের  বাথান এবং কোরবান শেখদের মসজিদ ।পাকুড়তলা পেরোলেই ছিল  মুসলমান পাড়া। আরও  একটু এগোলেই ছিল  হরি ধোবানির বাড়ি। তার  ডানদিকে ছিল  ভট্টাচার্য পাড়া আর বাঁদিকে চলে গেল রানীবাগান। বহুদিন পর  এদিকে এসেছে অনু, চারদিকে অনেক বাড়িঘর হয়ে গেছে , চেনা জায়গাই  যেন  কেমন অজানা অচেনা  হয়ে গেছে আর যেন  জিজ্ঞেস  করছে কে হে বাপু তুমি, কাকে দরকার? আমোদিনী পিসির  বাড়িটা ছিল  অনেকটা জায়গার উপর। মাটির  বাড়ি হলেও ছাদটা  ছিল  টিনের চাদরে মোড়া। মাঝখানে ছিল  একটা বড় উঠোন  আর অন্যদিকে ছিল  পিসির  মুড়িভাজার  জায়গা। বড় মাটির  খোলায়  কাঠের উনুনে পিসির  চালভাজা,  মুড়ি, ভাজা কলাইএর ডাল, ছোলাভাজা ও জাঁতায় পেষা ছাতুর যে কি দারুণ  স্বাদ বলে বোঝানো যাবেনা। জাঁতায়  পেষা হতো বলে  ছাতুটা মাখার পর একদম চন্দনের  মতন হতোনা কিন্তু সে এক অসাধারণ স্বাদ। পানুদার বাড়ি যাওয়ার মুখে খানিকক্ষণ  দাঁড়ালো অনু কাউকে যদি দেখতে পাওয়া যায়। পিসি তো বহুদিন আগেই  চলে গেছে তবুও  পুরোনো দিনের  কথা মনে করে একটু থামল। এদিক ওদিক  থেকে বেশ কয়েক জোড়া চোখ তার  দিকে লক্ষ্য রাখছে অজানা অচেনা  অনুর  দিকে । কাউকে খুঁজছেন  প্রশ্নে একটু থতমত খেয়ে গেল সে। 
না, কাউকে না, এখানেই  তো আমোদিনী পিসি  থাকতো, তাই না? 
হ্যাঁ, উনি তো বহুদিন  আগেই মারা গেছেন।  তা আপনি কি ওনার কেউ হন? 
 এটা এক মারাত্মক  ধরনের  বাউন্সার। সত্যিই  তো উনি তো  রক্তের  সম্পর্কের  কেউ নন কিন্তু তা সত্ত্বেও  অনেক কিছু। পিসির  যেমন  চেহারা ছিল  তেমনই মানানসই  ছিল তাঁর  রাশভরা  ব্যক্তিত্ব।  মুড়িভাজা বা চালভাজার সময় কেউ কিছু জিনিস  চাইলে সটান বলে দিত, বাপু একটু অপেক্ষা  করতে হবে। সকাল বেলায় স্নান  পূজো সেরে শুদ্ধ  কাপড়ে পিসির চাল বা মুড়ি ভাজা শুরু হতো। বিক্রি করার সময় ছিল  আলাদা। পড়াশোনা না জানা পিসির  কাজের  প্রতি যে নিষ্ঠা ছিল তার সিকিভাগ ও যদি কারও  থাকে তাই যথেষ্ট। এরই  মধ্যে একজন উদো দারই সমবয়সী একজন বিশাল  চেহারার  ভদ্রলোক এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন আর অনুর  দিকে আপাদমস্তক  দেখতে লাগলেন।  
চেনা চেনা লাগছে মনে হচ্ছে। তা আপনাকে তো উদোর বাড়ির  মাঠে দেখলাম মনে হয়। কে বটেন আপনি?
 অনু চিনতে পেরেছে জটু দাকে, একসময়ের  বিখ্যাত  ব্যায়ামবীর  জটু ঘোষ , কমল ভান্ডারীর সময়ের মিঃ জুনিয়র  ইন্ডিয়া। আপনি তো জটু দা। 
হ্যাঁ তাতো ঠিক,  কিন্তু আপনাকে তো ঠিক  মনে করতে পারছি না। 
আমি অনুত্তম, অনু। 
ও হো, এবার  ঠিক  মনে পড়েছে। তা কবে এলা? এখন  কোথায় থাকো? তোমরা তো  বহুদিন  আগে চলে গেছ।  তা, এখন কোথায় এসেছো? 
 মাসিমার বাড়ি, স্বর্ণময়ী  রোডে। 
ও তাই ভাবছি, চেনা চেনা লাগছে কিন্তু মনে করতে পারছিলাম না। 
আপনি কেমন আছেন  জটু দা, এখনও  শরীরচর্চা করেন? 
ওই একটু আধটু, বাড়ির পিছন দিকে ফাঁকা জায়গাটাতেই করি। তা এখানে কাকে খুঁজছো?  
অনেকদিন  পর  এসেছিলাম  এই পুরোন  পাড়াটাকে দেখতে। এসে দেখি উদো দা চলে গেছেন।  তারপর ভাবলাম  পানুদার  সঙ্গে একটু  দেখা করি।
আরে পানু তো অনেকদিন আগেই  এখান  থেকে চলে গেছে। ওদের  ভায়ে ভায়ে গন্ডগোল  হয়ে সবাই  অন্য অন্য জায়গায় চলে গেছে। একমাত্র  কাঁচু  আছে কিন্তু  ওর শরীরটাও  বিশেষ  সুবিধার  নয়।
তা ওদের  এতবড়  ব্যবসা?
সব ছোট ছোট হয়ে গেছে গো। লাঠি যখন  একসঙ্গে বাঁধা থাকে তখন  তার জোরই আলাদা। আর বাঁধন খুললেই তখন  একে অন্যের  শত্রু  হয়ে যায় গো। অত বিশাল  ব্যবসা সব নিজেদের  ঝটাপটিতে  শেষ  হয়ে গেল। পানুটা বিয়ে থা করেনি , ওর এইসব ঝুটঝামেলা ভাল  না লাগায় কোথায় যে চলে গেল কেউ জানেনা গো।

মনটা খারাপ  হয়ে গেল  অনুর। ভাল  মানুষ  হতে গেলে পড়াশোনায় ভাল  হতেই হবে এমন কোন কথা নেই। কত লোক আছে যাদের  মধ্যে অনেক বেশি মনুষ্যত্ববোধ  রয়েছে, যারা ঘরের খেয়ে বনের  মোষ তাড়ায়। তারা নিজের বলে কিছুই  ভাবেনা, অন্যের  বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে অথচ রাজনীতির  ধারও মাড়ায় না ,এইরকম  বিরল প্রজাতির  মানুষ  এখন  ভীষণ  কম, প্রায় নেই বললেই  চলে। এখন হচ্ছে স্বার্থের  যুগ, যতক্ষণ  স্বার্থ  রয়েছে ততক্ষণ  আছে আর তারপরেই  সব ভোঁ ভাঁ। আর একমূহুর্ত থাকতে ইচ্ছা করছিল না অনুর। একবার  যদি কোন জায়গা ছেড়ে চলে যাওয়া হয় তবে সেই জায়গায় আর ফিরে আসা উচিত  নয়। এলে মোহভঙ্গ  ছাড়া আর কিছুই  হয় না।
নিরুদ্দিষ্টের প্রতি  কাতর আহ্বান  করলেও চারিদিক  থেকে অট্টহাসি ছাড়া  আর কিছুই  শোনা যায়না। যা অতীত,  সুন্দর স্মৃতি যা  মনের  গহনে  রয়েছে  তাকে বর্তমানের লেজার রশ্মির সামনে না আনাই  শ্রেয়।

Saturday, 28 May 2022

"ব"

ঘুরছে না 'ব' বনবনিয়ে
ঘুরছে, যেন অলস পায়ে
গতির সেই উচ্ছলতা  হঠাৎ যেন উধাও  হয়ে
আসছে থেমে বাঁকের গায়ে
আছে কি কেউ সরিয়ে বাধা,দেবে 'ব' কে পূর্ব গতি
স্রোতের বেগে ছুটবে যে রথ 
চড়বে সোপান পরমোন্নতির?
যাঁরাই  বসেন মসনদে আচার  তাদের  হয় যে বদল
প্রতিশ্রুতির  ফাঁকা বুলি জনগণের ফাঁকা ঝুলি।
দিন গণি সেই আশায় আশায়
 কবে আসেন হারকিউলিস
 হাতে নিয়ে বিশাল কোদাল 
করবেন সাফাই 'ব' আস্তাবল।।

Thursday, 19 May 2022

একজন লেখকের অপমৃত্যু

গজুদার সঙ্গে আমার  পরিচয়  একটা অনুষ্ঠানে। চেহারার সেরকম  জেল্লা না থাকলেও তাঁকে দেখে নিজের মনে হয়েছিল যে ভদ্রলোক  বেশ করিত কর্মাএবং খুব  সৎ লোক। আজকাল  তো ঝাঁ চকচকে চেহারার  লোকদের  দেখলেই কেমন বুকটা ছমছম করে। কেতাদুরস্ত চেহারার লোক  কথায় কথায় কাঁধ ঝাঁকানি দেয়, কথাবার্তা বা আচার ব্যবহারে যথেষ্ট  কৃত্রিমতা, নজরে  এলেই কেমন যেন  সিঁটিয়ে যাই। হয়তো নিজের একটু গ্রাম্য ভাব থাকার এরজন্য  খানিকটা দায়ি। কিন্তু এটা মনে মনে ঠিক  করেই  নিই যে এঁর সঙ্গে একটু দূরত্ব  রাখাই ভাল। কিন্তু গজুদার নিজেকে একটু গুটিয়ে রাখা কিন্তু কথা বলার সময় সোজাসাপটা  কথাবার্তা আর অমায়িক  ব্যবহার আমাকে তাঁর  প্রতি একটু বেশিই  আকৃষ্ট করেছিল। বুঝলাম  এই ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার পটবে।  অনুষ্ঠান  ছিল আমাদের  ক্লাবের এবং অন্য একজন  মেম্বারের  সঙ্গে তিনি এসেছেন। সত্য দা সমস্ত  মেম্বারের সঙ্গে গজুদার  পরিচয় করিয়ে দিলেন কারণ  আমাদের সকলের উপর মেম্বার বাড়ানোর  ভার ছিল। আমাদের  ক্লাবের  নিজস্ব  কোন ঘর ছিলনা এবং ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কোন  মেম্বারের বাড়িতে ক্লাবের  মিটিং হতো বা নিদেন পক্ষে কোন  রেস্তোরাঁয় বা ছোট খাটো হলে। আমি একটু গায়ে পড়েই গজুদার সঙ্গে গভীর  আলাপ  করতে চাইলাম।  কথায় কথায় জানলাম যে উনি একজন  কেন্দ্রীয় সরকারের  উচ্চপদস্থ  কর্মচারী এবং সম্প্রতি তিনি রিটায়ার করেছেন। ধীরে ধীরে সম্পর্কের  গভীরতা বাড়তে থাকল এবং ব্যক্তিগত  স্তরে সেটা প্রায় পৌঁছে গেল। পরস্পরের  বাড়ি যাওয়া আসাতে বন্ধুত্বের গভীরতা বেশ জমে উঠল। 

কয়েক বছরের মধ্যেই  তাঁর  ওপর একটা  কেজো লোকের  তকমা সেঁটে গেল এবং তারই  ফলশ্রুতি তিনি হলেন  সম্পাদক এবং পরের বছর সভাপতি। আমাদের  ক্লাব ছিল সভাপতি  ভিত্তিক মানে তাঁর  কথাই হতো শেষ কথা যদিও  তিনি অন্যান্য সদস্যদের  মতামত ও নিতেন কিন্তু তিনি কোন সিদ্ধান্ত নিলে তা সকলেই মেনে চলতো। কিন্তু একটা কথা ঠিক  যে তিনি  সভাপতি থাকাকালীন  ক্লাবের যেরকম  রমরমা সেটা আর কোন  সময়েই হয়নি। প্রাণের স্পন্দন সবার  মধ্যেই সংক্রামিত  হয়েছিল। একটা কথা আছে না যে কোন  কোন সময় একটা ঝাঁকানির  প্রয়োজন  হয় যেমন গাড়ি চালানোর সময় কোন  সেরকম  পরিপক্ক নয় ড্রাইভারের  গিয়ার চেঞ্জের সময় হয়। গজুদার কোন কোন  সিদ্ধান্ত  সেরকম স্থির মস্তিষ্ক  প্রসূত না হলেও  তাঁর ঐকান্তিক ইচ্ছা আর অক্লান্ত  পরিশ্রম তাঁকে সাফল্যের  শিখরে পৌঁছে  দিয়েছিল।

কথায় কথায় জেনেছিলাম তিনি তাঁর  কর্ম ক্ষেত্রে একজন সর্বভারতীয় সম্পাদক ছিলেন  এবং তাঁর  সেই  অভিজ্ঞতাই ক্লাবের  উন্নতির  শিখরে পৌঁছতে   সাহায্য  করেছিল।  একটা গাড়ি সে যতই  পুরোন  হোক না কেন যদি চালু থাকে তা বসে থাকা এক নতুন  গাড়ির  থেকেও  ভাল  সার্ভিস  দেয়। সভাপতির  টার্ম ছিল  একবছর এবং দ্বিতীয়বার সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করার কোন  নিয়ম  না থাকায় চলন্ত গাড়িটা যেন ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল। পরে টুকটাক  রিপেয়ারিং হলেও  সেই মাত্রায় আর পৌঁছাল না। ধীরে ধীরে ক্রমহ্রাসমান  সদস্য সংখ্যা ক্লাবকে একটা প্রায় সাইনবোর্ডে  পরিণত করল যদিও  গজুদার  কোন পরিশ্রমে ঘাটতি ছিলনা কিন্তু কথা আছে না যথা রাজা তথা প্রজা। যদি সভাপতি শুধু আসনে বসার  জন্য ই হয় তাহলে তাকে ধাক্কা দিয়ে আর কতদূর  নিয়ে যাওয়া যায়? 

কিন্তু প্রতিভা এমনই  একটা জিনিস  যা কোন না কোন ভাবে বিচ্ছুরিত  হবেই। শুরু হলো গজুদার  লেখা এবং কিছুদিনের  মধ্যেই  লেখাগুলোর  প্রাসঙ্গিকতা ভীষণ  বলিষ্ঠ ভাবে প্রতীয়মান  হতে লাগল।  যে কোন  লেখক, তিনি যাই লিখুন  না কেন, যদি পাঠকের  পৃষ্ঠপোষকতা না পান তাহলে তাঁর  উদ্যমে অবশ্য ই ভাটা  পড়তে বাধ্য। কিন্তু কেউ যদি তাঁকে উৎসাহ দেন তা ছোট্ট  চারাগাছে  জল দিয়ে মহীরুহে  পরিণত করতে পারে। গজুদার প্রচেষ্টায় আমার  কাজ  ছিল সেই চারাগাছে জল দেওয়ার মতন। প্রথম প্রথম সেই বলিষ্ঠতা না থাকলেও  ক্রমে ক্রমে তা যথেষ্ট  মজবুত  লেখা হতে থাকল। একের  পর এক লেখা আসতে লাগল  এবং আমিও  চাতক পাখির  মতো লেখার  আশায় থাকতাম।  তারপর হঠাৎই  দেখি যে লেখার  সংখ্যা কমে কমে  একেবারেই  শূন্যে এসে ঠেকে গেল। ভাবছি হয়তো গজুদা বাইরে গেছেন কিংবা অন্য কোন কাজে ব্যস্ত আছেন।  কয়েকবার  টেলিফোন  করেও সাড়াশব্দ না পাওয়ায় যথেষ্ট  উদ্বিগ্ন  হয়ে পড়লাম।  হঠাৎই  একদিন  টেলিফোনের  অন্য প্রান্ত থেকে সাড়া পেলাম।  লেখা না আসার  কারণ  জানতে চাওয়ায় যা উত্তর  পেলাম  তাতে স্তম্ভিত  হয়ে গেলাম।  শুনলাম  বৌদি মানে গজুদার  স্ত্রী মানসিক ভাবে অসুস্থ।  প্রচন্ড  ধাক্কা খেলাম উত্তর শুনে। তিনি এতটাই  শুচিবাইগ্রস্ত হয়ে গেছেন  যে কেবল স্নান  আর ঠাকুর  দেবতাদের  সেবা ছাড়া আর কিছুই  করেন না। দুর্ভাগ্যবশত তাঁদের  কোন সন্তানাদি না থাকায় সংসারের  সেই আঠাটাই কোনদিন  জমাট  বাঁধেনি। আর তার নীটফল মানসিক  অবসাদ। বৌদি কারো  হাতের  রান্না খাবেন  না, হোম ডেলিভারি তো দূর অস্ত। সুতরাং গজুদাকেই ঘর ঝাঁট দেওয়া, মোছা, রান্না বান্না সব কিছুই  করতে  হয়। তারপরও  লিখতে বসলেই  বৌদির  চেঁচামেচি  শুরু হয়ে যায়। শুনে মনটা  খুব খারাপ হয়ে গেল। এই ব্রহ্মান্ডে একা সূর্য ই তো নয়, বহু ছোট বড় নক্ষত্র, গ্রহ উপগ্রহ  আছে যদিও  সূর্য  তুলনামূলক ভাবে কাছে থাকার  জন্য  তার উপস্থিতি সব সময়ই মনে পড়িয়ে দেয় কিন্তু রাতের আকাশে যখন  তিনি থাকেন  না তখন  চাঁদের  স্নিগ্ধ মহিমা বা ঝিকমিক করতে থাকা বহুদূরের নক্ষত্রগুলো  কি দৃষ্টিনন্দন  নয়? গজুদার লেখা রবীন্দ্রনাথ  বা অন্যান্য  নামী সাহিত্যিকদের  মতো না হলেও  তার ও একটা আলাদা বৈচিত্র্য  রয়েছে। বিরিয়ানি খেলেও  শুক্তোর ও তো একটা আলাদা স্বাদ  আছে।


উদ্বৃত্ত

ফাটকওয়ালা বাড়িটার সামনে আজ অনেক লোকের ভিড়। অনুত্তম  বা ডাকনামে  অনু বলে যার পরিচিতি, এই পাড়ারই  ছেলে কিন্তু অনেকদিন  বাদে নিজের শহরে এসে দেখছে অনেক পরিবর্তন। বেশ ডাকাবুকোই তো ছিল  সে এবং সেই কারণেই  তার পরিচিতির  ব্যাপ্তি ছিল বিস্তৃত।  খেলাধূলো, পড়াশোনায় যথেষ্ট  নামী ছেলে থাকায় সকলেরই  খুব  প্রিয় ছিল। কিন্তু বহুদিন পরে ফিরে এসে এতটা পরিবর্তন  সে আশা করেনি। ফাটকওয়ালা বিশাল বাড়িটা তার যথেষ্টই  পরিচিত এবং ঐ বাড়িতেই  থাকা উদো দা তো একসময় অনুর আইডল ছিল। দীর্ঘদেহী উদো দার চেহারা ছিল পেটানো এবং উনিও  খেলাধূলোয় বিশেষ  পারদর্শী এবং যে কোন  লোকের  বিপদে আপদে ঝাঁপিয়ে পড়তেন  বলে উদো দা যে সকলের কাছের মানুষ  হবেন  সেটা বলাই বাহুল্য এবং অন্য অনেকের  মতোই  অনুও উদো দার ভীষণ  বড় ভক্ত ছিল।

উদো দার ভাল  নাম একটা নিশ্চয়ই  ছিল কিন্তু খুব  কম লোকই  তার ভালনামটা জানত। আর নাম জেনে কাজ কি? প্রয়োজনে রাত বিরেতে যাকে ডাকলেই  পাশে পাওয়া যায় তাতে নামের  কি দরকার, উদো দা উদো দা ই। ব্যাস সাফ কথা। কিন্তু ঐ নামের  পিছনে একটা রহস্য  বা সত্য লুকিয়ে আছে যেটা অনু ভাবলেও  ঠিক  বুঝে উঠতে পারেনি। উদো দা যে স্কুলে পড়তেন  সেই স্কুলের  মাস্টার মশাই ছিলেন  সদানন্দ বাবু।  পাড়ার পূজো উদো দাদের  বাড়িতেই  হতো। একদিন  সদানন্দ বাবু গল্প  করতে করতে বলে ফেললেন  উদো দার  ভাল নাম। সবাই  উদগ্রীব  হয়ে শুনছে স্যারের কথা। উদো দার আসল নাম  উদ্বৃত্ত নারায়ণ মিত্র। সবাই  হাঁ হয়ে গেল ঐ অদ্ভুত  নাম শুনে।  সদা দা, এইরকম  নামকরণের  কি অর্থ  থাকতে পারে, পানু বাবু জিজ্ঞেস করলেন।  সদানন্দ বাবু অনেক  পুরনো লোক, উদো  দার দাদুকে ভাল মতন চিনতেন।  তাহলে  শুনুন  ঐ নামের  পিছনে আসল কি কারণ। এই যে বিশাল  বাড়িটা দেখছেন  যেখানে  আমরা বছর বছর  পূজো করছি, এটা উদোর  দাদুর  বাড়ি। উদোর  বাবারা ছিল পাঁচ ভাই এবং উদোর বাবা  ছিল  সবচেয়ে বড় ভাই। বলদেব বাবু বা উদোর  বাবা, এই যে দেখছেন  উদোকে, তার এককাঠি বাড়া।বলদেব  বাবুও  ভীষণ  জনদরদী ছিলেন এবং তাঁর ই গুণ উদো পেয়েছে। তাঁর ছোট ভাইদের  সব বিয়ে থা হয়ে ছেলেপুলে হয়ে যাওয়ার  পর বলদেব বাবু  যখন  কুমড়োকাটা  ভাসুরের  দায়িত্ব  পালন  করছেন  তখন  মায়ের  একান্ত অনুরোধ  ফেলতে না পেরে বলদেব বাবু বিয়ে করেন  আর তার  বেশ  কয়েকবছর  পর উদোর  আগমন। বলু দা বা বলদেব বাবুর  সম্বন্ধে তাঁর ডাকসাইটে জাঁদরেল উকিল বাবা কোনদিন ই উচ্চাশা  পোষণ করতেন না এবং কথায় কথায় অপদার্থ  হারামজাদাটার কিস্যু হবেনা বলতেন  যদিও  বলুদাও ওকালতি  করতেন কিন্তু বাবার সঙ্গে কিছুতেই  বনতো না। বলদেব বাবু ছিলেন  জনতার  উকিল  আর উদো টাও পড়াশোনায় খারাপ  ছিলনা এবং বাবার মতোই সেও হয়েছিল  জনতার উকিল। ওর দাদু অবশ্য  উদোর  ওকালতি  দেখে যেতে পারেননি কিন্তু স্কুলে ভর্তির  সময় খানিকটা  তাচ্ছিল্য ভরেই  নাম দেন উদ্বৃত্ত নারায়ণ মিত্র।  সেই উদ্বৃত্ত  মুখে মুখে  হয়েছে উদো।

উদো দা ছিলেন  অকৃতদার।  জনগণের  সেবা, বিনা পয়সায় বা নামমাত্র  পয়সায় গরীবগুর্বোদের  হয়ে মামলা লড়া এই ছিল  তাঁর  নেশা। পয়সা বিশেষ  করতে পারেন নি উদো দা কিন্তু তাঁর  দরজা ছিল  সব সময়ের জন্য  খোলা। মামলা  জিতে টাকা না দিতে পেরে গরীব মানুষ টা হয়তো মদের  একটা বোতল দিয়েছে, তাই সই। হারামজাদা আমাকে এবার  না খাইয়েই  মারবে বলে বোতলটা  রেখে দিয়েছেন আর আরও  একটা তীক্ষ্ণ  গালাগাল  বর্ষণ করে ভাগিয়ে  দিয়েছেন। আজ শহরের  এখানে ওখানে ছড়িয়ে থাকা  মুসলমান পাড়া, বাগদী পাড়া, মেথর পাড়া, মুচি পাড়া, ডোম পাড়ার আবাল বৃদ্ধ বনিতা জড়ো  হয়েছে তাদের চলে যাওয়া বাপ মা উদো দাকে একবার চোখের  শেষ দেখাটা  দেখতে এসেছে ফাটকখোলা বাড়ির মাঠে। কাল থেকে ফাটকটা  বন্ধ  হয়ে যাবে চিরতরের  জন্য  এই সাধারণ  মানুষ গুলোর  কাছে, পাহারা দেবে উদো দার ডাকসাইটে জাঁদরেল উকিল দাদুর  ভূত। ঐ বড় মাঠটা  আজ কানায় কানায়  ভর্তি এই অতি সাধারণ  গরীবগুর্বোদের ভিড়ে। কান্নার  রোল  উঠেছে আমাদের  বাপ মা চলে গেল বলে। ভগবান,  আল্লা এ কি তোমার  বিচার? হঠাৎই আর্তনাদ ভরা চিৎকারের  রেশ  বেড়ে গেল উদো দার  ভাইপোকে দেখে। ওই মুখাগ্নি  করবে বলে এসেছে , বড্ড ভালবাসত  যে ওকে। ওর জলভরা  চোখ অনুকে  দেখেও  চিনতে পারল না যদিও  অনু তাকে চিনতে পেরেছে। অনুর মনটা ও খুবই  ভারাক্রান্ত।  এতদিন  বাদে চেনা শহরটায়  এসে অনেকের কাছে অচেনা কিন্তু যে লোকটা  চিনতে পারতো সেই লোকটাও  আজ বহু দূরে  চলে গেছে। 

সংসারে যতদিন  প্রয়োজন ততদিন ই সবাই  মনে রাখে আর প্রয়োজন ফুরোলেই  হয়ে যায় উদ্বৃত্ত। তখন  উদো দা বা উদ্বৃত্ত নারায়ণ মিত্র জানতে পারে যে এই জনমের  মতো তার প্রয়োজন শেষ। অতএব,  চলো ফিরে যাই তাঁর  কোলে।

 

Sunday, 13 March 2022

মেলি নয়ন সুদূর পানে

কেমন করে যে বয়ে গেল  যৌবনের  ঝলমলে দিনগুলো নিজেরই অজান্তে নিজেই জানিনা। দেশের  একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে চললাম ছুটে কাজের তাগিদে, সামনে ঝুলছে প্রমোশনের ললিপপ; অতএব ছোট তার পিছনে, সমস্ত ব্যক্তিগত এবং সংসারের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য  বিসর্জন  দিয়ে, পৌঁছাতেই হবে সেই সোপানে। আমরা সবাই  পিরামিডের শীর্ষ বিন্দুতে পৌঁছাতে চেষ্টা করি কিন্তু নিজের নিজের সামর্থ্য ও চেষ্টা অনুযায়ী বিভিন্ন স্তরে আটকে যাই । এটাই স্বাভাবিক।  যে যত পরিশ্রম করবে সে ততটাই  উঁচুতে উঠবে অবশ্য  ভাগ্যের  কিছুটা সহায়তা থাকা চাই। বহুসময় এমনও দেখা যায় যে দুজনেই তুল্যমূল্য  কিন্তু একজনের  ভাগ্য সহায়ক হওয়ায় সে পরের স্তরে পৌঁছে গেল এবং অন্যজন তার পূর্বতন জায়গায়ই থেকে গেল। আবার  এমনও হয় যে একটা গাড়ি একটা সিগন্যালে  এগিয়ে গিয়েও পরের সিগন্যালে  আটকে গেল। এটা হামেশাই  হয় এবং ভবিষ্যতেও হবে। কখন বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এল খেয়ালই নেই, একদিন  একটা সীল করা খামে সেবা নিবৃত্ত হবার পরোয়ানা এসে গেল এবং ঝুলন্ত ললিপপটা চোখের  সামনে থেকে অদৃশ্য  হয়ে গেল। মাসের শেষ দিনে একটা বিশেষ  সভায় হঠাৎই হয়ে গেলাম  বিশেষ অতিথি এবং সেদিনের  সভার কেন্দ্রীয় আকর্ষণ। বেশিরভাগ লোকই সেদিন প্রশংসার বানে ভাসিয়ে দিল আবার  পিছনে কেউ কেউ  চাপা গলায় বলল,"যাক বাবা,বাঁচা গেছে, আপদ বিদায় হয়েছে।" এটাই স্বাভাবিক।  কোন লোকই  সবাইকে খুশী করতে পারেনা আর সবাইকে খুশী করতে গেলে তাকে নিজেকেই  অসুখী হতে হবে। যাই হোক,  একটা চলন্ত গাড়ি হঠাৎই  ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষায় থেমে গেল। যে মানুষটা গতকাল  অবধি ঘুম থেকে উঠেই প্রাতঃকৃত্য সেরে স্নান করে অফিস  যাবার  তোড়জোর করতো, আজও অভ্যেস বশত তাই করল কিন্তু আজ ড্রাইভার  এলনা  ব্রীফকেস নিয়ে যেতে, কেমন যেন অজানা অচেনা হয়ে গেল সবার কাছে,  হয়ে গেল  অপাংক্তেয়। সময়ই সময় এখন কিন্তু কি করে যে সময়টা কাটাবে তার কোন  ব্যাখ্যা নেই তার কাছে। যারা আগে থাকতেই  নিজেদের  রিটায়ারমেন্ট  প্ল্যানিং করে রাখে তারা কিছুদিন পরেই নতুন জায়গায় খাপ খাওয়ানোর কথা ভাবতে থাকে আর যারা এটা করতে অপারগ বা রিটায়ারমেন্টের পরে অপ্রয়োজনীয় তাদের হয় মুস্কিল। নতুন বন্ধুর খোঁজে তাদের  থাকতে হয়। ভাগ্য ভাল হলে মনের মতো বন্ধু মেলে আর তা নাহলেই প্রয়োজনের বন্ধুর খোঁজ করতে হয় । বেশিরভাগ  ক্ষেত্রেই  এই প্রয়োজনের বন্ধু মেলে , প্রয়োজন শেষ তো বন্ধুত্বও  শেষ। প্রকৃত বন্ধুর দেখা মেলাই ভার। তাহলে জীবনের  বাকি কটা দিন  কিভাবে কাটবে? যদি আত্মীয়স্বজন কাছাকাছি থাকে এবং তাদের  সঙ্গে সুসম্পর্ক  থাকে তবে তাদের নিয়ে একসঙ্গে ছোটখাট কোন ট্যুর করা যেতে পারে এবং এতেও মোটামুটি দুচার দিন বাইরে ঘুরে এলেও কিছু বিশুদ্ধ  বাতাসে শরীর ও মন চাঙ্গা হয়ে যাবে। তবে এই আত্মীয়স্বজনের  সঙ্গে সম্পর্ক তো একদিনেই  গড়ে ওঠেনা,  এরজন্য দরকার  দীর্ঘদিনের  নিরলস প্রচেষ্টা। এটা না থাকলে হঠাৎ কাউকে যেতে বললেই  সে যেতে রাজি  হবে এটা আশা করাই বাতুলতা।

ভগবানের  আশীর্বাদে আমাদের আত্মীয়স্বজনের  সঙ্গে মোটামুটি ভাল  সম্পর্ক  থাকার  সুবাদে মাঝে মাঝেই নির্মল বাতাসের  সন্ধানে আমরা বেরিয়ে পড়ি। মাঝে দুটো বছর আপদ করোনার  উৎপাতে এটা যথেষ্ট  ব্যাহত হয়েছে, শুধু আমাদেরই  নয় ,সবাইকে ব্যতিব্যস্ত করে ছেড়েছে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে কোথাও  যাওয়ার  ভীষণ  প্রয়োজন।  গোদের উপর বিষফোড়ার মতন আবার  বহুদিনের  হাঁটুর ব্যথাকে বিদায় জানাতে হাঁটু প্রতিস্থাপন  করতে হয়েছে। সুতরাং শারীরিক  ও মানসিক ভাবে প্রায় বিপর্যস্ত  অবস্থা। যাই হোক, সবার সঙ্গে আলাপ আলোচনার পর ঠিক  হলো ঘাটশিলা যাওয়া হবে। সেখানে প্রখ্যাত  লেখক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের স্মৃতিবিজড়িত কিছু ঘটনার  সঙ্গে পরিচিত  হওয়া এবং সুবর্ণরেখার  ধারে কিছু সময় কাটানোর এক প্রলুব্ধ হাতছানি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হাসপাতালের লাউঞ্জে বসে ডাক্তার বাবুর জন্য  অপেক্ষারত সময়ে যোগাযোগ করলাম  ওখানকার  এক হোটেলের সঙ্গে। ম্যানেজারের  সপ্রতিভ জবাবে খুবই  খুশি হয়ে জানুয়ারির  তেইশ এবং চব্বিশ  তারিখে কুড়ি জনের জন্য  দশটা ঘর বুক করা হলো শহর থেকে একটু দূরে। কিন্তু একটা মুশকিল  হলো যে একতলা, দোতলা এবং তিনতলায় মিলে দশটা ঘর হলো এবং খাওয়া দাওয়ার  ব্যবস্থা তারাই করবে জানালো। কিন্তু আবার  সেই করোনা নামক দৈত্যর তৃতীয় ঢেউ এসে পড়ায় সমস্ত  উৎসাহে আবার  জল পড়ে গেল। এর মধ্যে একজন  আসবে বম্বে থেকে, সুতরাং তার আসার  পরেই দিন স্থির করতে হবে এবং মার্চ মাসের  নয় তারিখ  সকাল বেলায় যাত্রা করে এগার তারিখ  সন্ধেবেলায় ফিরে আসা। বাস ঠিক  করা হলো এবং সাড়ে পাঁচটায় যাত্রা শুরু করে সবাইকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা দুটো বেজে গেল। ইতিমধ্যে এক বিপত্তি ঘটেছে। যে হোটেল  প্রথমে বুক করা হয়েছিল এবং পরে বহুচেষ্টায় তারিখ  বদলানো  হয়েছিল  তারা জানালো  যে তাদের  পক্ষে খাওয়ার ব্যবস্থা করা সম্ভব  নয়। এক ভীষণ সমস্যার মুখোমুখি হলাম।  আমাদের  সবাই সিনিয়র  সিটিজেন, কেউ কেউ সুপার ডুপার সিনিয়র  সিটিজেন।  এদের  খাওয়ার ব্যবস্থা না করলে সেখানে যাওয়াই বৃথা। অতএব শুরু হলো অন্য হোটেলের  খোঁজ।  ভগবান  সহায় হলে সব কিছুই সম্ভব। বিভূতিভূষণের বাড়ির  কাছেই  এক হোটেলের  খোঁজ  পাওয়া গেল, নাম তার হোটেল বিভূতি বিহার। এই হোটেলের  ম্যানেজার  ওমপ্রকাশ জী অত্যন্ত  ভদ্রলোক।  তিনি আমাদের  সবার  জন্য  একতলায় ব্যবস্থা করে দিলেন।  আগেভাগে বলে দেওয়ায় খাওয়ার  কোন কষ্টই হলোনা। বিকেল  বেলায় বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের  বাড়ি দেখা হলো। বাড়ির কম্পাউন্ডেই  একটা বাংলা মাধ্যমের  স্কুল চালান স্থানীয় কিছু বাংলাপ্রেমী ভদ্রলোক কোনরকম  সরকারি অনুদান  ছাড়াই।  তাঁদের  নিরলস প্রচেষ্টা এবং আমাদের  মতন কিছু বেড়াতে আসা লোকজনদের  সহায়তায় স্কুলটি চলে এবং কিছু সাংস্কৃতিক  অনুষ্ঠান ও করে তারা। যাই হোক কিছু টুকরো টুকরো স্মৃতি সঞ্চয় করে  সুবর্ণরেখার তীরে সূর্যাস্তের দৃশ্য উপভোগ করার জন্য রওনা দিলাম। মাঝপথে হিন্দুস্থান কপারের কারখানাকে রেখে ফিরে আসতে আমাদের দেরী হয়ে যাওয়ার জন্য মাঝপথেই দিনকর সেদিনের  মতো আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। অতএব,  হোটেলেই ফিরে আসা এবং বিশ্রাম  নেওয়া। অনেকটা জায়গা জুড়ে হোটেলের অবস্থান  এবং নানা ফুলের  সমাহারে এক অপূর্ব সুন্দর দোতলা হোটেল। দশ তারিখ  ভোরবেলায় উঠে স্নান করে জায়গার  চারপাশ  ঘুরছি এবং কোনও  জায়গায় চা পাওয়া যায় কিনা তার খোঁজ করছি কিন্তু না, আশে পাশে কোন চায়ের দোকান  নজরে  এলনা। হঠাত,  দূরে দেখি একটা দাড়িওয়ালা লোক বাবা জী হোটেলের  সামনে ঝাঁট দিচ্ছে। ওকে জিজ্ঞেস  করলাম  কখন খুলবে এই হোটেল? ও জানালো যে একটু পরে আসবে মালিক। আমি এধার ওধার ঘুরে চা না পেয়ে ভগ্নমনোরথ হয়ে যখন  ফিরছি তখন দেখি দাড়িওয়ালা বাবাজীর ঝাঁট দেওয়া শেষ।  এখনও  আসেনি লোক জিজ্ঞেস করায় সে হোটেল সংলগ্ন  একটা বাড়ি থেকে একজন মহিলাকে ডেকে আনল। আমি জিজ্ঞেস করলাম  বহেনজী, অভি চায়ে  মিল সকতা হায়? হাঁ, বাবুজী  অভি বনা কে দে রহা হুঁ। তুলসী পাতা দিয়ে খাঁটি দুধের  চায়ে  হাল্কা মিষ্টি দিয়ে যে চা খেলাম,  এককথায় অপূর্ব।  ওখানে আসা দুটো দেহাতি ছেলে, দাড়িওয়ালা বাবাজী এবং কুনি দেবী( হোটেলের  মালকিন) এবং আমার  দুকাপ চায়ের  দাম ষাট টাকা মিটিয়ে ফিরে এলাম।  বাড়তি  প্রাপ্তির  মধ্যে কুনি দেবীর ঘরে ভাজা একমুঠো মুড়ি সম্পূর্ণ আলাদা স্বাদের। সন্ধেবেলায় তাঁকে বলে রাখা কুড়িজনের  জন্য  চা হয়ে গেল ত্রিশটা,  এতই ভাল  লেগেছে সকলের। 

পরের দিন অর্থাৎ দশ তারিখ সকাল বেলায় ব্রেকফাস্ট করেই বেরিয়ে পড়লাম  গালুডি ড্যামের  দিকে। শীর্ণকায় নদীর কঙ্কালসার ফল্গুধারায় উজ্জীবিত  হয়নি বাঁধের ধরে রাখা জল, সুতরাং একটু হতাশই হতে হলো কিন্তু বর্ষার  আগমনে এই বাঁধই জলে টইটম্বুর হয়ে ওঠে এবং বিস্তীর্ণ এলাকার চাষে হাত বাড়িয়ে দেয়। খানিকক্ষণ  থেকে রওনা দেওয়া হলো যাদুগুড়ায় রঙ্কিনী দেবীর  মন্দিরের  উদ্দেশ্যে। যাদুগুড়া বিখ্যাত তার ইউরেনিয়াম ভান্ডারের  জন্য। সুতরাং ভারত সরকারের  কড়া নজরদারিই  স্বাভাবিক।  যাই  হোক,  তাকে পেরিয়ে রঙ্কিনী দেবীর  মন্দির  পৌঁছলাম।  মায়ের  মন্দিরে দূরদূরান্ত থেকে বহু লোক পূজো দিতে আসা মনস্কামনা পূরণের জন্য। একটা জিনিস  চোখে  পড়ল যে পুণ্যার্থীরা সবাই খুব  সুশৃঙ্খলভাবে পূজো দিচ্ছেন  যা সাধারণত অন্যান্য  মন্দিরে সচরাচর  চোখে পড়েনা। এরপর যাত্রা শুরু হলো নয়নাভিরাম  বুরুডি ড্যামের দিকে। এটা গালুডির মতো আধুনিকা নয় বরং বেশ পৃথুলা। সুতরাং এক বিস্তীর্ণ  সুগভীর জলরাশি মনকে বেশ টানে। ওখানে নৌকাবিহারের ব্যবস্থা ছিল  কিন্তু সময় হাতে না থাকায় এবং এত সুপার সিনিয়র সিটিজেনদের  নিয়ে তা অসমাপ্ত রেখেই  চলে আসতে হলো। ওখান থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের  টিলায় থাকা ঝর্ণা ধারা না দেখেই চলে আসতে  হলো। আসলে আমাদের  একটা ভুল  হয়েছিল কোন গাইড না নেওয়ায় আর আমাদের  ড্রাইভার ও ছিল  আনকোড়া। হোটেলে ফিরে এসে খাওয়ার পর একটু  ছোট্ট  ভাতঘুম দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম রামকৃষ্ণ মিশনের  উদ্দেশ্যে। সান্ধ্য আরতির এক বিশেষ  আকর্ষণ  এই রামকৃষ্ণ মিশন।  হোটেলে ফিরে আমাদের  সদা যুবতী তিরানব্বই বছরের  মাসিমা চল্লিশ পঞ্চাশের আধুনিকাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নাচে গানে মেতে উঠলেন যা সব পাওয়াকেই  ছাড়িয়ে গেল। পরের দিন এগার  তারিখ  ফেরার পালা। ব্রেকফাস্ট সেরে চল ফিরে নিজ নিজ ডেরায়,  মাঝখানে কোলাঘাটে শের ই পাঞ্জাবে অবশ্যই মধ্যাহ্নভোজন সেরে।

Saturday, 26 February 2022

সাঁঝ বসন্ত

হে বিটপী, ত্যজিয়া পুরাতনে
বরণ করেছ সতেজ নবীনে
উঠেছ সাজিয়া নব কলেবরে
ভেবেছ  কি কভু সেই পাখিদের 
ছিল যারা তব পুরাতন আশ্রয়ে
হইবে কি দশা ঘর ছাড়া হয়ে 
সাধ্য কি আছে সতেজ নবীনে
বিতাড়িত  করি শঙ্কা? বলিতে পারিতে 
হে পুরাতন, রহো না বক্ষে আরও  কিছুক্ষণ 
ফিরিত  আস্থা শঙ্কিত পাখিদের। 

Sunday, 13 February 2022

গল্প হলেও সত্যি

কোন কোন সময় যখন  শুনি যে এক অত্যন্ত  দরিদ্র পরিবারের থেকে একটা ছেলে বা মেয়ে ধনুকের ছিলা থেকে বেরিয়ে আপন গতিতে এগিয়ে চলেছে তখন মনে হয় আমি কি স্বপ্ন দেখছি না জেগে আছি। নিজের গায়ে চিমটি কেটে অনুভব করতে চেষ্টা করি যে এ কি গল্প না সত্যি। 

গতকাল  এক বন্ধুর বাড়ি থেকে ফেরার  সময় এইরকম  এক ঘটনার  মুখোমুখি হ'লাম। ওখান থেকে ফেরার  উপায় হয় নিজের গাড়ি নিয়ে যাও না হলে বেশ খানিকটা দূর হেঁটে এসে অটোতে চড়ে মেন রোডে এসে ট্যাক্সি নাও কিংবা ভাগ্য ভাল  থাকলে ট্যাক্সি পাওয়া গেলে সরাসরি বাড়ি ফিরে এস আর একান্তই  কিছু না থাকলে উবের নিয়ে চলে এস। কিন্তু এত নানান দিকে রাস্তা আর খোঁড়াখুঁড়ির দৌলতে উবের  পেলেও তাকে যথাযথ ডিরেক্শন  দিয়ে নিয়ে আসা বন্ধুর সাহায্য  ছাড়া  সম্ভবই  নয়। যাই হোক,  শেষ পন্থাই নিতে হ'ল অর্থাৎ বন্ধুর সাহায্য  নিয়ে উবেরে চলে আসা।

অনেক ঘোরাঘুরি করে ভদ্রলোক অনেকবার  টেলিফোন  করে এসে উপস্থিত  হলেন। এসেই হাঁফ ছেড়ে বললেন, " বাপরে, ফর্টিস হাসপাতাল  থেকে হাঁটু অপারেশন করা এক রোগীকে এখানেই  ছাড়তে এসে আমারও  অপারেশন করা স্পাইন্যাল কর্ডের ব্যথাটা চাগিয়ে উঠল।" আঁতকে উঠে আমার  গলা থেকে " অ্যাঁ" শব্দটা বেরিয়ে এল। 
স্যার,  আপনার  কি লাগল? 
না, না, না। ভাগ্যচক্রে আপনি এক হাঁটু অপারেশন করা রোগীকে নিয়ে এসে আবারও এক হাঁটু অপারেশন করা রোগীকে নিয়ে যাচ্ছেন। ধীরে ধীরে গল্পটা জমে উঠল রাস্তা সরু হওয়ার জন্য এবং গাড়ি নিয়ে তাড়াতাড়ি না যেতে পারার জন্য। করোনার  দৌলতে বাড়ির বাইরে না যেতে পারার জন্য একটু কথা বলার জন্য  ভিতরটা  হাঁকপাঁক  করে। সুতরাং যে কোন  লোক পেলেই তার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে এবং তার হাঁড়ির খবর জানতে ইচ্ছে করে। কথায় কথায় জানলাম  যে সদানন্দ বাবুর( উবর ড্রাইভারের  নাম সদানন্দ সরকার) স্পাইন্যাল কর্ডের অপারেশন  হয়েছে এবং কোনরকম পয়সা খরচ না করেই। একটু  বিস্মিত  হয়েই জিজ্ঞেস  করলাম,  কোথায়, কোন সহৃদয়  ডাক্তারের সহায়তায়?  তার  উত্তরে তিনি জানালেন  যে সরকারি হাসপাতাল  পি জি হাসপাতালে ডাক্তার  অমিতাভ  চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে একদম নিখরচায়। সঙ্গে সঙ্গে বহু সমালোচিত মুখ্যমন্ত্রীর প্রশংসাও করলেন। শুনে মনটা একটু আশ্বস্ত  হ'ল যে পি জি হাসপাতালে শুধু বদমাস  দুর্নীতিবাজ নেতাদের  পুলিশের  হাত থেকে বাঁচার জন্যই নয়, সাধারণ  লোকেরও কিছু চিকিৎসা হয়। এটাই তো হওয়ার  কথা,  কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এটা দালালদের মাধ্যমে এখন রাজনৈতিক  দাদাদের কব্জায় চলে গেছে । কথায় কথায় জানলাম যে তাঁর একটা স্টেন্ট ও বসেছে নিখরচায়। ঔৎসুক্য না চেপে জিজ্ঞেস  করেই বসলাম যে পি জি হাসপাতালে দু দুবার  বিনা খরচে চিকিৎসা করালেন , কোন নেতাকে ধরে ? উনি তো পরিষ্কার  জানালেন  যে কোন নেতাকে না ধরেই আউটডোরে দেখিয়ে তাঁর চিকিৎসার  ব্যবস্থা হয়েছে যদিও  এখনও  আমার  সন্দেহটা এখনও  যায়নি। আবার  জিজ্ঞেস করলাম যে স্পাইন্যাল কর্ডের  অপারেশনের  পরে গাড়ি চালাচ্ছেন,  কোন অসুবিধা হচ্ছে না? উনি বললেন,  গাড়ি না চালালে সংসার  কি করে চালাবেন। বাড়িতে কে কে আছেন  জিজ্ঞেস করায় উনি জানালেন  যে তাঁরা স্বামী , স্ত্রী এবং তাঁদের একমাত্র  ছেলে।
" ছেলে কি করে?"
উত্তর  শুনে মাথা একদম ঘুরে গেল। ছেলে অ্যাস্ট্রোফিজিক্সে এম এস সি করে পি এইচ ডি করছে। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্র সৌহার্দ্য,  সদানন্দ  সরকারের  একমাত্র  সন্তান, ডক্টরেট  করে তার  বাবাকে গাড়ি চালানো থেকে বিরত করবে এই প্রার্থনাই  ভগবানের  কাছে করি। আরও  অনেক  সৌহার্দ্যর সমাহার আমাদের দেশে আসুক এবং দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাক এই আশা নিয়েই  বেঁচে থাকি।